অনল চট্টোপাধ্যায় (জন্ম: ২৪ অক্টোবর, ১৯২৭ – ১৭ এপ্রিল, ২০১৪) বাংলা গানের একজন গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। সাহিত্যপ্রেমী এই ব্যক্তি ১৯৪৬ সনে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা আইপিটিএ-‘র সাথে যুক্ত হন। ভারতীয় গণনাট্য সংঘে যুক্ত হবার ফলেই সেখানে পরিচয় ঘটে সলিল চৌধুরীর সংগে। সলিল চৌধুরী তাকে নিজের সহযোগী হিসেবে যুক্ত করেন। ১৯৫৪ সালে তার প্রথম রেকর্ড বের হয় হিজ মাস্টার্স ভয়েস থেকে। ১৯৫৫ সালে মৃণাল সেনের রাতভোর চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেন।
সলিল চৌধুরীর সহকারী হয়ে ‘পাশের বাড়ি’, ‘আজ সন্ধ্যায়’, ‘মহিলামহল’, ‘ভোর হয়ে এল’, ‘তাসের কেল্লা’, ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ প্রভৃতি ছবিতে কাজ করেন। এছাড়াও ‘জি টি রোড’, ‘রাজপুরুষ’, ‘দেবী গর্জন’ ইত্যাদি চলচ্চিত্রে সুরকার ও গীতিকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর লেখা গান ‘কত গান হারালাম’, ‘কৃষ্ণনগর থেকে আমি’ গেয়েছিলেন গীতা দত্ত; ‘মধুমতী যায় বয়ে যায়’ গেয়েছিলেন তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ‘মনের দুয়ারে দাঁড়িয়ে থেকো না’, ‘জানি এ ভুল’ ইত্যাদি গেয়েছিলেন আরতি মুখোপাধ্যায়। আর লোকগীতি ও ঠুংরির মিশেলে তাঁর দেয়া সুরে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় গেয়েছিলেন ‘ছলকে পড়ে কলকে ফুলে’ গানটি এবং এই গান শুনে সুরকারের উচ্ছসিত প্রশংসা করেছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। যাত্রাপালার গানেও তিনি সুরারোপ করেছিলেন।১
অনল চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম হাওড়ার সালকিয়াতে। ১৯৪৬-এ ‘দেব সাহিত্য কুটির’ হতে তাঁর লেখা বই ‘রত্নতৃষ্ণা কাহিনী’ বের হয়। সেই বছরই লেখক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তাকে নিয়ে যান প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘে। প্রগতির সাহিত্যে তখন এই সংগঠনটির অবদান অনেক। অর্থাৎ ১৯৪৬ সালে ‘প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ’ এবং ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’র সাথে যুক্ত হওয়া তার জীবনের এক অনন্য ঘটনা।২
সাহিত্যপ্রেমী এই ব্যক্তিটির অবদান বুঝতে হলে উনিশশো চল্লিশ ও পঞ্চাশের গণসংগীতের মর্ম বোঝা দরকার। বাংলা গানের বিষয় ও সুরে যে নবজাগরণ এসেছিলো তা হটাত নয়। জাতীয়তাবাদী ও স্বাদেশিক গানগুলোর পরেই বাংলা গানে আসে গণসংগীত।৩ ১৯৪৭-এর সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত ও দেশিয় দালালদের ষড়যন্ত্রের আগে-পরের সব রকমের গণআন্দোলনে যেসব গান বাঙালি গেয়েছেন ও শুনেছেন তার এক অংশে আমরা অনল চট্টোপাধ্যায়কে শ্রদ্ধার সংগে রেখেছি।
১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষকে কেন্দ্র করে লেখা তার একটি বিখ্যাত গান হচ্ছে ‘আজ বাংলার বুকে দারুণ হাহাকার’। আর সেই ধারায় তার আরেকটি বিখ্যাত গান হচ্ছে ‘অনেক ভুলের মাশুল তো ভাই দিলাম জীবন ভরে’। এই গানের বাণীতে আছে ‘আর কতদিন, এমনিভাবে, নানান দ্বিধা আসবে যাবে;/ দিন বদলের লগ্ন কি আর সত্যি অনেক দূরে,/ (তবে) পদধ্বনি কিসের শুনি আকাশ-বাতাস জুড়ে’। এভাবেই তিনি সমাজ আর দিনবদলের পক্ষে আমাদেরকে লড়াইয়ে পথ দেখান।
তথ্যসূত্র:
১. দৈনিক আজকাল, Aajkaal Publishers Limited, ১৮ এপ্রিল ২০১৪; সুরকার অনল চট্টোপাধ্যায়ের জীবনাবসান।
২. কবি অনল চট্টোপাধ্যায়; মিলনসাগর ডট কম; লিংক এইখানে। এই লিংকে তার কিছু গান অ কবিতা পাবেন।
৩. সুধীর চক্রবর্তী, বাংলা গানের সন্ধানে; অরুণা প্রকাশনী, কলকাতা; ২৫ বৈশাখ, ১৩৯৭; পৃষ্ঠা- ১৮৪।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।