এনাক্সিমেণ্ডার ছিলেন একজন গ্রিক বস্তুবাদী দার্শনিক

এনাক্সিমেণ্ডার (ইংরেজি: Anaximander; খ্রি.পূ. ৬১০-৫৪৬) ছিলেন আদি গ্রিক দার্শনিক থেলিসের শিষ্য। এনাক্সিমেণ্ডারের দর্শন বস্তুবাদী বৈশিষ্ট্যের জন্য বিখ্যাত। জীবন এবং জগৎ সম্পর্কে এনাক্সিমেণ্ডারের ব্যাখ্যা দ্বন্দ্বমূলক চরিত্রে বিশিষ্ট। বস্তুজগৎ এবং প্রাণীজগতের বিবর্তনমূলক ব্যাখ্যার আভাসও এনাক্সিমেণ্ডারের দর্শনে স্পষ্টরূপে পাওয়া যায়।

গ্রিক ভূ-বিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের আদি প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে এনাক্সিমেণ্ডার বিজ্ঞানের ইতিহাসে ষ্মরণীয় হয়ে আছেন। পৃথীবির প্রথম মানচিত্র, মহাকাশের তারকারাজির নকশা, সূর্যের দৈনিক ও বার্ষিক পরিক্রমা অনুধাবনের জন্য সূর্যঘড়ি আবিস্কার এবং পৃথিবীর গোলক তৈরির আদি কৃতিত্ব এনাক্সিমেণ্ডারের। মহাবিশ্বে পৃথিবী যে স্থির হয়ে আছে তার কারণ এই যে, মহাবিশ্ব একটা বৃত্তস্বরূপ। পৃথিবী হচ্ছে সেই বৃত্তের কেন্দ্র। বৃত্তের সর্ববিন্দু থেকে পৃথিবীর সমদূরত্বেই পৃথিবীর স্থির অবস্থাকে নিশ্চিত করেছে। থেলিসের শিষ্য হলেও পৃথিবী সম্পর্কে এনাক্সিমেণ্ডারের এই ব্যাখ্যা থেলিসের ব্যাখ্যা থেকে স্পষ্টত পৃথক। থেলিসের মতে পৃথিবী জলের সমৃদ্রে ভাসমান।

প্রাকৃতিক জগতের বিকাশ সম্পর্কে এনাক্সিমেণ্ডারের অভিমতও সুনির্দিষ্টরূপে বৈজ্ঞানিক। পৌরাণিক কোনো কল্পনা কিংবা অতিপ্রাকৃতিক ঐশ্বরিক শক্তির আশ্রয় নিয়ে তিনি প্রাকৃতিক জগৎকে ব্যাখ্যা করতে চান নাই। এনাক্সিমেণ্ডারের মতে আপেরিয়ন বা অসীমতা থেকেই বিশ্বের শুরু। আপেরিয়ন বা সৃষ্টির মূলশক্তি তাপ এবং শৈত্যের সম্মেলন। আপেরিয়ন থেকে অগ্নির সৃষ্টি। আদি অগ্নি বায়মুণ্ডলকে পরিবেষ্টিত করলে তা থেকেই সৃষ্ট হয়েছে চন্দ্র, সূর্য এবং তারকারাজি। নিসর্গ জগতের এই সৃষ্টিসমূহ এক একটি অগ্নির চক্র হয়ে মহাবিশ্বে নিয়ত ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং মাঝে মাঝে অগ্নির হল্কা ছুঁড়ে দিচ্ছে।

আদিতে বিশ্ব কেবল বাষ্পময় ছিল। সমুদ্র বাষ্পেরই সৃষ্টি। আদি বাস্পের অবশিষ্ট অংশই বাতাস এবং শুষ্ক পৃতিবীর রূপ গ্রহণ করেছে। এভাবে বিশ্বের যা-কিছু সৃষ্টি, আকাশ, বাতাস, সমুদ্র, ভূখণ্ড সবই আদি শক্তি তাপ এবং শৈত্যের চিরন্তন সংঘর্ষ এবং বিচ্ছুরণের ফল। এনাক্সিমেণ্ডারের মতে আদিশক্তি তাপ এবং শৈত্যের সংঘর্ষকে স্বীকার করে নিলে বৃষ্টি, বিদ্যুৎ, বজ্র কোনো কিছুর সঠিক ব্যাখ্যা পেতে আমাদের অসুবিধা হবে না।

আরো পড়ুন:  লুক্রেশিয়াস ছিলেন প্রাচীন রোমের কবি এবং বস্তুবাদী দার্শনিক

জীবনের বিকাশও তাপ এবং শৈত্যের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটেছে। জীবনের আদি সৃষ্টি জলজ – প্রাণ হিসাবে ঘটে। পরবর্তী পর্যায়ে জীবন শুষ্ক ভূখণ্ডে আশ্রয় গ্রহণ করে। এনাক্সিমেণ্ডারের বিবর্তনবাদী এই মতে মানুষের রুপও আদিতে বর্তমানের ন্যায় ছিল না। বিশেষ করে মানব শিশু বর্তমানে যেরূপ দুর্বল প্রাণী তাতে প্রকৃতির আদি অবস্থায় বর্তমান রূপে সে নিশ্চয় রক্ষা পেতে পারত না। মানবশিশুর তুলনায় অপরাপর পশু শিশু অবস্থায় অনেক বেশি শক্তিশালী। সে কারণে অনুমান করতে হবে যে, মানুষ আদিতে অবশ্যই অপর কোনো প্রাণী থেকে উদ্ভূত হয়েছে। প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে এনাক্সিমেণ্ডারের গদ্যে লেখা গ্রন্থই আদি দার্শনিক গ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃত।

তথ্যসূত্র:

১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ৫৬।

Leave a Comment

error: Content is protected !!