আনাক্সিমেনিস ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিক

এনাক্সিমেনিস বা আনাক্সিমেনিস বা মিলেতুসের আনাক্সিমেনিস (ইংরেজি: Anaximenes; ৫৮৮-৫২৫ খ্রি. পূ.) ছিলেন প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক। তার জীবনের বিবরণ অস্পষ্ট এবং অনথিভুক্ত কারণ তার কোনও কাজ সংরক্ষিত হয়নি। গ্রীক দর্শনশাস্ত্রের ইতিহাসে এরিস্টট্ল এবং অন্যান্য লেখকদের দ্বারা তৈরি মতামত ও মন্তব্যগুলির কারণে আনাক্সিমেনের ধারণা ও দর্শন আজকে পরিচিত।

গ্রিক দর্শনের আদি যুগকে প্রাকৃতিক দর্শনের যুগ বলা হয়। বাস্তব জগতে মানুষ বাস করে। তার আকাশ, বাতাস, সমুদ্র, ঝড়-ঝঞ্বা নিয়ত মানুষের জীবনকে আঘাত করছে। তাকে অসহায় করে তুলছে। মানুষ জীবনের তাগিদেই প্রাকৃতিক শক্তির মোকাবেলা করে। ঝড় শুরু হলে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে। বন্যার পানি বাঁধ বেঁধে ঠেকাবার চেষ্টা করে। সমুদ্রের সীমানার সন্ধান করে। প্রকৃতিকে নিজের বাধ্য করতে না পারলে মানুষের রক্ষা নাই। প্রকৃতিকে বাধ্য করার জন্য আবশ্যক হচ্ছে প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা।

জগতের মূল কি? আলো, বাতাস, আর পানি? এরাই সৃষ্টির মূলে? এই জ্ঞান ব্যতিরেকে মানুষের পক্ষে প্রকৃতিকে বশ করা সম্ভব নয়। মানুষের সভ্যতা, ইতিহাস, দর্শন-সব কিছুর মূলে রয়েছে এই স্বাভাবিক প্রশ্ন। আদি গ্রিক দর্শনের খ্যাতি এই কারণে যে, আদি গ্রিক দর্শন মানুষের জীবনের সকল প্রশ্নের যথাসম্ভব জবাব দিয়ে মানুষকে জ্ঞানের শক্তিতে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছে। এই যুগের থেলিস, এনাক্সিমেণ্ডার এবং এনাক্সিমেনিসের নাম শুধু দর্শনে নয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাসে অবিষ্মরণীয় হয়ে রয়েছে।

সৃষ্টির মূল কি? এ প্রশ্নের জবাবে এনাক্সিমেনিস বলেছেন: বায়ু হচ্ছে বিশ্বের মূল শক্তি। বায়ুর শেষ নাই, সীমা নাই। বায়ু থেকেই সমস্ত অস্তিত্বের সৃষ্টি। ঈশ্বর আর দেবতা-তারাও বায়ুর প্রকাশ। বায়ুর চরিত্র হচ্ছে এই যে, বায়ু অস্থির। বায়ু সদাঘূর্ণ্যমান। আবর্তের মধ্যে বায়ুর রূপান্তর ঘটে। ঘূর্ণ্যমান বায়ু একদিকে যেমন গতির বেগে বাষ্পে পরিণত হে পারে, তেমনি অপরদিকে সে জমাট বাঁধা বায়ু আবহাওয়ার উৎপত্তি ঘটায়। আবহাওয়া থেকে সৃষ্টি হয় মেঘ। মেঘ থেকে সৃষ্টি হয় পানি। পানি জমাট বেঁধে হয় মাটির সৃষ্টি। মাটির মধ্যে তৈরি হয় প্রস্তর। এমনি করে পৃথিবীর সৃষ্টি।

আরো পড়ুন:  মার্কাস অরেলিয়াস ছিলেন স্টয়িক বা নিস্পৃহবাদী দার্শনিক

মূলশক্তি বায়ুর সাথে এনাক্সিমেনিস বস্তুর তাপ এবং শৈত্যাবস্থার ভূমিকাকেও স্বীকার করেছেন। ঘূর্ণ্যমান বায়ুর কারণে যে অস্তিত্বের সৃষ্টি হচ্ছে তার মধ্য আছে তাপ এবং শৈত্য বায়ুর গুণবিশেষ।

আমাদের পৃথিবী হচ্ছে চেপ্টা। তার গভীরতা তেমন কিছু নাই। অন্তরীক্ষের নক্ষত্ররাজী অগ্নিপিণ্ড। এগুলি নিশ্চয় অন্তরীক্ষে আপন স্থানে কোনো কিছু দিয়ে আটকা আছে। সেই অবস্থায় আকাশের দৃশ্যমান অস্তিত্বগুলি পৃথিবীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। তারকারাজি অগ্নিগোলক। কেবল দূরত্বের কারণে তার তাপ আমাদের দগ্ধ করতে পারে না। দিনরাত্রির ভেদাভেদের কারণ নিশ্চয়ই এই যে, আবর্তিত হতে হতে চন্দ্র, সূর্য এবং নক্ষত্র পৃথিবীর সুউচ্চ পাহাড়-পর্বতের আড়ালে গেলে আমরা ওদের দেখতে পাই না। জমাট বায়ু থেকে যেমন মেঘের সৃষ্টি, তেমনি জমাট বায়ুর কারণেই বৃষ্টি, শিলাবর্ষণ এবং বিদ্যুৎ ও বজ্রের উৎপত্তি।

বিশ্বে যে একটা নিয়মের ব্যাপার চলেছে। তা আনাক্সিমেনিস-এর দৃষ্টি এড়ায় নি। কিন্তু নিয়মের কারণেই নিয়ম এরূপ তত্ত্বে পৌছার অবস্থা তখনো জ্ঞানান্বেষণের ক্ষেত্রে পৌঁছে নি। এনাক্সিমেনিস বললেন, কারণ বাদে কোনো কাজ হতে পারে না। নিয়মেরও নিশ্চয়ই কারণ আছে। আর সে কারণ হচ্ছে বায়ু। আমাদের আত্মা যেমন আমাদের দেহের সূত্রধর, তেমনি বায়ু সমস্ত বিশ্বকে ধারণ করে তার নিয়মের মূল বা সূত্র হিসাবে কাজ করেছে।

গ্রিকদর্শনের আদি যুগে বস্তুজগতের সৃষ্টি এবং সংগঠন সম্পর্কে যে অন্বেষা চলছিল, সে অন্বেষার ক্ষেত্রে এনাক্সিমেনিসের উপরোক্ত অভিমতসমূহের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। ‘ঘূর্ণ্যমান বায়ু পর্যায় বিশেষের সঙ্গে মিলিত হতে পারে, এবং নতুন অস্তিত্ব তৈরি করতে পারে’ এনাক্সিমেনিসের এই অভিমতের মধ্যে ‘সংখ্যা থেকে গুণে রূপান্তরের’ দ্বন্দ্বমূলক বৈজ্ঞানিক সত্যোপলব্ধির স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়।

তথ্যসূত্র:

১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ৫৭-৫৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!