বের্টোল্ট ব্রেশট আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় কবি

বের্টোল্ট ব্রেশট (১০ ফেব্রুয়ারী ১৮৯৮ – ১৪ আগস্ট ১৯৫৬) একজন বিখ্যাত জার্মান কবি, নাট্যকার ও মঞ্চ পরিচালক। বিগত উনিশ শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকে আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম বিতর্কিত কবি বের্টোল্ট ব্রেশটের জন্ম আগসবুর্গের একটি শহর বেভেরিয়ানের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে।

কৈশোের থেকেই পারিবারিক সুখ স্বাচ্ছন্দ্য তার মনে গভীর বিতৃষ্ণা জাগায়, তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন অহেতুক অতিরেক অথবা কোলাহল থেকে নিজেকে দুর্লভ নির্জনতায় সরিয়ে রাখতে। এমন কি ছাত্রাবস্থাতেই ধরা পড়ে এমন একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, পরবর্তীকালে যা তিক্ত যন্ত্রণা, হতাশা আর নিঃসঙ্গতায় অনুরণনিত। ১৯১৬ সালে ডাক্তারি পড়ার জন্যে চলে আসেন মিউনিখে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মেডিকেল আরদালী হিসাবে কাজ করেন সামরিক বাহিনীতে।

১৯১৮ সালে মৃত সৈনিকের জন্যে লােকগাথা প্রকাশিত হবার পর থেকেই তার কবি খ্যাতির সূচনা। অন্য অনেক তরুণ জার্মান কবিদের মতো ব্রেশটও প্রথম জীবনে ইম্প্রেসনিস্ট কাব্যআন্দোলনের দ্বারা দারুণ প্রভাবিত হন। পরে অবশ্য নিহিলিস্ট ব্রেশট ইম্প্রেসনিজম থেকে ফিরে আসেন ‘ফাংশনালিজম’ বা ফ্রান্স ও স্পেনের বামপন্থী শিল্পী-সাহিত্যিক পরিচালিত সুররিয়ালিস্ট কাব্য আন্দোলনের মাঝে। রাজনৈতিক ভাবনার বিস্তীর্ণতায় ব্রেশট এই সময়ে সমাজবাদী শিবিরের নিয়মিত লেখক, এবং সম্ভবত ব্যাভেরীয় বিপ্লবেও প্রত্যক্ষ ভূমিকায় অবতীর্ণ।

১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় কাব্যগন্থ ডি হাউসপােস্টিলে, যুদ্ধোত্তর জার্মানির বিপ্লব এবং অবক্ষয়ী অর্থনৈতিক শােষণই যে অভিজ্ঞতাব অন্যতম পটভূমি। তবু তার এই সময়কার মানসিকতা যতটা র‍্যাঁবাের পৃথিবীর, ততটা মার্কসের পৃথিবীর নয়। ১৯২৭ সালের প্রায় শেষার্ধ থেকেই ছন্নছাড়া ভবঘুরে ব্রেশটের নতুন এক অভিযান সন্ত্রাসমূলক চরম বিপ্লববাদ থেকে মার্কসবাদের পথে, সর্বহারার কঠিন আদর্শে; পরবর্তীকালে যা তার সমগ্র সাহিত্যভাবনা ও মননের সংকীর্ণ পৃথিবীকে চুরমার করে স্পষ্ট উদ্ভাসিত করে তােলে এক নতুন স্বর্ণদিগন্ত। বিতর্কিত ব্রেশট তখন বার্লিনে। তার আগেই তিনি খ্যাতি কুখ্যাতি উভয়ই অর্জন করেছেন নাটক ও সমালােচনার জন্যে। অন্যান্য বহু বিপ্লবী শিল্পী সাহিত্যিকদের মতো তিনিও তখন চাবুকে চাবুকে রক্তাক্ত করতে শুরু করছেন শােষণের নগ্ন মুখােশ।

আরো পড়ুন:  বিমলচন্দ্র ঘোষ ছিলেন বামপন্থী কবি ও গীতিকার

১৯৩৩ সাল, রাইখস্টাগ পতনের পর নাৎসি অত্যাচারে হিটলারের জার্মানি ছেড়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হলেন সুইজারল্যাণ্ডে। সেখান থেকে ফ্রান্স এবং ডেনমার্কে। সেই থেকে শুরু হলো এক নির্বাসিত জীবন। যে অভিজ্ঞতা তার দ্বিতীয় পর্যায়ের কবিতা, ‘স্বেডনবার্গের গেভিস্টে’ ১৯৩৯ কাব্যগ্রন্থের অন্যতম ফলশ্রুতি। প্রথম দিকের কবিতায় নিচের মহলের অবহেলিত শােষিত মানুষের প্রতি আন্তরিক ভালােবাসা এবং যুদ্ধ সম্পর্কিত তীব্র ঘৃণার মধ্যে সুপ্ত ছিলাে এই পর্যায়ে বিপ্লবী ভাবনারই নগ্ন প্রতিভাস।

ডেনমার্কে কাটালেন সাতটা বছর। নাৎসি অবরােধের সময় ডেনমার্ক ছেড়ে পালিয়ে এলেন ফিনল্যাণ্ডে। সেখান থেকে আবার সাইবেরিয়া পেরিয়ে সােজা আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায়। সেখানকার অস্থায়ী তাঁবুতেও কাটলাে জীবনের সাতটা বছর। সারা আমেরিকা জুড়ে যখন গড়ে উঠলো কমিউনিস্ট বিরােধী এক আশ্চর্য তৎপরতা, ব্রেশটকে তখন আবার ফিরে আসতে হলাে সুইজারল্যাণ্ডে। ১৯৪৮ সালে ফিরে এলেন পূর্ব বালিনে। বিখ্যাত অভিনেত্রী, তাঁর স্ত্রী হেলেন ভাইগেলের সঙ্গে এপিক থিয়েটারের আদর্শে গড়ে তুললেন ‘বার্লিনার আসম্বল’। আমৃত্যু তিনি এরই সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

১৯৪৮ – ৫৬ সাল পর্যন্ত তাঁর সাহিত্যের তৃতীয় পযায়। প্রথম দিকের নৈরাশ্য বা পরবর্তী পর্যায়ের ‘জটিল আত্মসচেতনতা’র তুলনায় এই পর্যায়ে তিনি লিখেছেন অত্যন্ত কম, অথচ নানান ভাঙা গড়ার আশ্চর্য বৈপ্লবিক চেতনায় যা নিঃসন্দেহে আগের চাইতে অনেক অনেক বেশি সােচ্চার আর সমৃদ্ধ।

শুধু ভাবনার গভীরতাতেই নয়, চিত্রকল্প এবং আঙ্গিকেও চালালেন নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা। চিরাচরিত শ্লথ ধ্রুপদী রীতি, বিশেষ করে লিরিকের ছন্দকে ভাঙলেন নিপুণ হাতে, প্রাচীন চীনা কবিতা এবং জাপানী হাইকুকে মেশালেন তার স্কেচ ঢঙের ছােট ছােট কবিতায়, ছন্দমুক্ত আধুনিক গদ্য কবিতার ধারাকে তিনিই ব্যবহার করলেন প্রথম। মনন এবং আদর্শের প্রতিভাত সমীকরণে, সংঘাত ও দ্বন্দ্বে বের্টোল্ট ব্রেশট আজ আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় নাম। জার্মানির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি এবং নাট্যকার ব্রেশট যখন খ্যাতির চরম শীর্ষে, তখনই সহসা কবির মৃত্যু হয় ১৯৫৬ সালে পূর্ব বার্লিনে। মৃত্যুর পর এ পর্যন্ত নটি খণ্ডে প্রকাশিত হয় তার কাব্যসমগ্র ‘গেডিস্টে’।

আরো পড়ুন:  সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী শ্রেণিসংগ্রামের লড়াইয়ের পথের পথিকদের আলোকবর্তিকা

ব্রেশটের প্রাণময় কথ্যভাষা জার্মানদের কানে আশ্চর্য বৈপ্লবিক, যার দীপ্ত প্রতিফলন সারা দুনিয়ায় ছড়িয়েছে। তাঁর কাব্য ও চিন্তা বিংশ শতাব্দীর অমূল্য সম্পদ। বের্টোল্ট ব্রেশট অমর রহে।

তথ্যসূত্র:

১. অসিত সরকার, ব্রেশটের শ্রেষ্ঠ কবিতা, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা ৯ প্রথম প্রকাশ, ২৫ বৈশাখ ১৩৬৫ পৃষ্ঠা ঙ-চ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!