এম্পেডোক্লিস বা এমপিডকলিস বা এম্পেদোক্লেস (ইংরেজি: Empedocles; ৪৯৪-৪৩৪ খ্রি.) প্রাচীন গ্রিসের অন্যতম কবি, বৈজ্ঞানিক এবং বস্তুবাদী দার্শনিক। তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে এরূপ কাহিনী আছে যে, তিনি ইটনা পর্বতের গহ্বরের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ‘প্রকৃতি’ নামে তাঁর বিখ্যাত দার্শনিক কবিতার মধ্যেই এমপিডকলিস নিজের দার্শনিক অভিমতসমূহ প্রকাশ করেন।
এম্পেডোক্লিসের দর্শনের মধ্যে পূর্বগামী দার্শনিক পিথাগোরাস, হিরাক্লিটাস এবং পারমিনাইডসের ভাবধারার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এঁরা সকলেই সেকালের বস্তুবাদী বা প্রকৃতিবাদী দার্শনিক ছিলেন। এঁদের সকলের মতামতই এম্পেডোক্লিস কমবেশী গ্রহণ করেন। পারমিনাইডিসকে স্বীকার করে এম্পেডোক্লি বলেনঃ বস্তু হচ্ছে অ-সৃষ্ট অর্থাৎ বস্তুর কোনো স্রষ্টা নেই এবং বস্তুর কোনো বিলয় নেই। হিরাক্লিটার্স বলেছিলেন বস্তুর ক্ষেত্রে বিরামহীন গতি আর পরিবর্তনই একমাত্র সত্য। বস্তু অ-সৃষ্ট এবং পরিবর্তনশীল এই দুই অভিমতকে সংযুক্ত করে এম্পেডোক্লি বলেন যে, দৃশ্যবস্তুপুঞ্জের মধ্যে পরিবর্তন আছে, তার সৃষ্টি এবং লয় দেখা যায় একথা সত্য; কিন্তু দৃশ্যবস্তু মূলত যে সত্তা বা উপাদানে গঠিত তার কোনো শুরু, শেষ বা পরিবর্তন নেই। বস্তুর মূলে রয়েছে চারটি সত্তা যথা, মাটি, পানি, বাতাস এবং আগুন। দৃশ্যবস্তুর সৃষ্টি, লয় এবং পরিবর্তন সাধিত হয় বস্তুর মৌলিক উপাদান মাটি, বায়ু, পানি আর আগুনের পারস্পরিক সংযোজন এবং বিয়োজনের মাধ্যমে।
এম্পেডোক্লিসের মতে সংযোজন এবং বিয়োজন আকর্ষণ এবং বিকর্ষণ, প্রেম, অ-প্রেম, ভালবাসা, ঘৃণা বস্তুর মূল উপাদানের মধ্যে সতত সংঘাতের মাধ্যমে ক্রিয়াশীল। সংযোজন, আকর্ষণ, প্রেম, ভালবাসা যেখানে জয়ী, সেখানে সৃষ্টি এবং বৃদ্ধি। আর বিয়োজন, বিকর্ষণ, ঘৃণা যেখানে জয়ী সেখানে ক্ষয় এবং ধ্বংস। আকর্ষণ বিকর্ষণের তত্ত্বের ভিত্তিতে এম্পেডোক্লিস প্রকৃতির ক্ষেত্রে তাঁর বৃত্তের তত্ত্বও তৈরি করেন। আকর্ষণ বা প্রেম জয়ী হতে হতে ক্ষুদ্রকে মহৎ করে, অসম্পূর্ণকে সম্পূর্ণ করে। কিন্তু এ অবস্থাও স্থায়ী হতে পারে না। সম্পূর্ণের মধ্যে আবার বিকর্ষণ, ঘৃণা বা অ-প্রেম উদ্ভুত হয়। ক্রমান্বয়ে ঘৃণা প্রেমকে পরাভূত করে বৃহৎকে ক্ষুদ্র করে এবং সম্পূর্ণকে অসম্পূর্ণতে পর্যবসিত করে। এম্পেডোক্লিসের এই তত্ত্বের মধ্যে প্রকৃতির জগতের দ্বান্দ্বিক গতির স্পষ্ট স্বীকৃতি পাওয়া যায়। কিন্তু কেবল চক্রাকারে আবর্তন নয়।
এম্পেডোক্লিস এরূপও মনে করতেন যে, প্রাকৃতিক জগতের একটা বিকাশও আছে। স্বধর্মী অস্তিত্বের মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ ও সংযোজন বিকর্ষণের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী অস্তিত্ব সৃষ্টি করে, বিকর্ষণকে পরাভূত করে, আকর্ষণ ও প্রেম সৃষ্টিকে ধারাবাহিকভাবে রক্ষা করে চলে। এমপিডকলিসের এরূপ চিন্তার মধ্যে আধুনিক বিবর্তনবাদের পূর্বাভাস পাওয়া যায়।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৪৮-১৪৯।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।