ফ্রানয মেহরিং জার্মানির সমাজ-গণতন্ত্রীর বামপন্থি অংশের তাত্ত্বিক ও নেতা

ফ্রানয মেহরিং (১৮৪৬-১৯১৯ Franz Erdmann Mehring) জার্মান শ্রমিক আন্দোলনের বিখ্যাত কর্মী, জার্মান সমাজ-গণতন্ত্রীর বামপন্থি অংশের অন্যতম নেতা, তত্ত্বকার, প্রচারক, রাজনিতিক ও ইতিহাসবিদ।

তিনি ১৮৪৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পোল্যান্ডের, পোমেরানিয়ার স্লানোতে এক বুর্জোয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কর্মজীবনে নানা দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। তিনি সাপ্তাহিক De Neue Zeit বা নবযুগ-এর অন্যতম সম্পাদক ছিলেন। ১৮৮৪ সালে তিনি বার্লিনের উদার পত্রিকা Volks-Zeitung-এর প্রধান সম্পাদক হন। বিসমার্ক (১৮১৫-১৮৯৮) সমাজতন্ত্রকে নিষিদ্ধ করে যে আইন প্রণয়ন করেন তার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন।[১]    

১৮৯১ সালে তিনি জার্মানির সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টিতে (Social Democratic Party of Germany, SPD) যোগদান করেন এবং ক্রমান্বয়ে পার্টির মুখপত্রের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯০২ থেকে ১৯০৭ সালের ভেতরে তিনি সমাজ-গণতন্ত্রীদের পত্রিকা Leipziger Volkszeitung, ’র প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯০৬-১১ সাল পর্যন্ত তিনি পার্টির স্কুল পরিচালনা করেন।[১] ১৯১৭-১৮ সালে তিনি প্রুসিয়ার পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন।    

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তার সাথে জার্মানির সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টির দুরত্ব তৈরি হয়। ১৯১৬ সালে তিনি কার্ল লাইবনেখত (১৮৭১-১৯১৯) ও রোজা লুক্সেমবার্গের (১৮৭১-১৯১৯) সাথে মার্কসবাদী বিপ্লবী স্পার্তাকাস লিগ গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করেন[১] এবং সেইসময় সাম্রাজ্যবাদী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি তার দল কর্তৃক সরকারকে সমর্থনের সমালোচনা করে রোজা লুক্সেমবার্গের সাথে যোগ দেন। ১৯১৭-তে আনুষ্ঠানিকভাবে ইন্ডিপেন্ডেন্ট সোশ্যাল ডেমক্র্যাট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হলে তাতে যোগ দেন।[২]

তিনি অনেকগুলো গ্রন্থ ও প্রবন্ধ লিখেছিলেন; সেগুলো হচ্ছে জার্মান মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির উৎপত্তিসমূহ: লেইসিং লেজেন্ড, (১৮৯২-১৮৯৩); ঐতিহাসিক বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, (১৮৯৩) (বিকল্প অনুবাদ); ইবসেনের মহিমা ও সীমাবদ্ধতা, (১৯০০); ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস, (১৯০৬); হারমান শ্লুটারের আমেরিকার জার্মান শ্রমিক আন্দোলনের প্রারম্ভের রিভিউ, (১৯০৭); দর্শনশাস্ত্র এবং দর্শনশাস্ত্র, (১৯০৯); অ্যাংলো-জার্মান সম্পর্ক, (১৯১১); চার্লস ডিকেন্স, (১৯১২); আমাদের পুরাতন প্রভু এবং তাদের আধুনিক উপাধি, (১৯১৭); মার্কসের দ্য ডিভাইন রাইট অফ হোহেনঝোলার্ন, (১৯১৮); জার্মানিতে সমাজতান্ত্রিক ভাগসমূহ, (১৯১৮); কার্ল মার্কস: তার জীবন গল্প, (১৯১৮); একটি অস্বাভাবিক বন্ধুত্ব, (১৯১৯) ইত্যাদি।

আরো পড়ুন:  নয়া বাম আন্দোলন ছিলো পাশ্চাত্যের বিদ্যমান পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার মধ্যে প্রচ্ছন্ন প্রতিবাদ

তার লিখিত সর্বপ্রথম কার্ল মার্কসের জীবনী ১৯১৮ সালে প্রকাশিত হয় এবং এটিই কার্ল মার্কসের ধ্রুপদী জীবনী হিসেবে উল্লেখিত হয়। বইটি তিনি ক্লারা জেটকিনকে উৎসর্গ করেন। বইটি বিভিন্ন ভাষাতে প্রকাশিত হয় যেমন, রুশ (১৯২০), ড্যানিশ (১৯২২), হাঙ্গেরিয়ান (১৯২৫), জাপানিজ (১৯৩০) এবং ইংরেজি (১৯৩৫)।[৩] তিনি জার্মান সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টির ইতিহাস রচনা করেন। এই গ্রন্থে তিনি লাসালে ও বুখারিনকে (১৮৮৮-১৯৩৮) উল্লেখযোগ্য নানা জায়গায় সমর্থন জানান। তিনি সমাজতাত্ত্বিক সাহিত্য ও ইতিহাস-ধারার আলোচনা করেন। তত্ত্ব নির্ণয়কারী, সিদ্ধান্ত-ধর্মী ভাবনার প্রাধান্য ছিল বলে ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস (১৮২০-১৮৯৫) তার সমালোচনা করেন।[২]  

ফ্রানয মেহরিং সমীপে ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ১৪ জানুয়ারি ১৮৯৩ সালে এক চিঠি পাঠান। সেই চিঠিতে এঙ্গেলস ভাবাদর্শকে (Ideology) ‘ভ্রান্ত চেতনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। চিঠিতে লেখেন,

“ভাবাদর্শ এমন একটি প্রক্রিয়া যা তথাকথিত মনিষী যে সচেতনভাবে সম্পাদন করেন সেকথা ঠিক, কিন্তু এ সচেতনতা ভ্রান্ত সচেতনতা। তাঁকে চালিত করে যে প্রকৃত প্রেরণাশক্তি তা তাঁর কাছে অজ্ঞাত থেকে যায়, অন্যথায় তা ভাবাদর্শগত প্রক্রিয়াই হত না।”[৪]  

মেহরিং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস সম্পর্কে লিখিত প্রবন্ধে বিপ্লবীদের প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে বলেছেন যে; “আমরা সেইসব বিপ্লবীর কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি যারা একটি নতুন বিপ্লবী যুগ শুরু করছে, যেই যুগটি বর্তমানে বিরাজমান শোষক এবং শোষিতদের নিয়ে গঠিত সমাজ ব্যবস্থার প্রতিস্থাপন করবে।”[৫]

কার্ল লাইবনেখত ও রোজা লুক্সেমবার্গের হত্যাকাণ্ডের পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং দুসপ্তাহ পরে ১৮১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি বার্লিনে মৃত্যুবরণ করেন।

১৯১৭ সালের মহান বলশেভিক বিপ্লবের প্রতি সহানুভূতিশীল ফ্রানয মেহরিং দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের অভ্যন্তরে সুবিধাবাদসংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে দাঁড়ান, কাউতস্কিপন্থা সমালোচনা করেন, কিন্তু সেই সংগে জার্মান বামপন্থিদের ভুল করে বসেন, যারা সুবিধাবাদের সংগে সাংগঠনিক সম্পর্কচ্ছেদে ভয় পায়।[৬]  

তথ্যসূত্র ও টিকাঃ

১. Pierre Broué, The German Revolution, 1917-1923 (1971). John Archer, trans. Chicago: Haymarket Books, 2006; pg. 977  

আরো পড়ুন:  বাংলায় রাজনৈতিক আন্দোলন হচ্ছে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবী সাম্যবাদ অভিমুখী আন্দোলন

২. সমীরণ মজুমদার; মার্কসবাদঃ বাস্তবে ও মননে; স্বপ্রকাশ, কলকাতা; ১ বৈশাখ, ১৪০২; পৃষ্ঠা- ১৬১;

৩. McLellan, David (1995). Karl Marx: A Biography. London: Papermac. p. 444. ISBN 0-333-63947-2.

৪. অনুবাদ; মার্কস-এঙ্গেলস নির্বাচিত রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, দ্বিতীয় অংশ; পৃষ্ঠা-১৮৫। ইংরেজি অনুবাদটি হলওঃ Ideology is a process accomplished by the so-called thinker consciously, indeed, but with a false consciousness. The real motives impelling him remain unknown to him, otherwise it would not be an ideological process at all.

৫. ফ্রানয মেহরিং, ১৯০৫, Frederick Engels, Social Democrat, Vol.9. no.10, 15 October 1905, pp.550-552., সংগ্রহের তারিখ, ২৮ অক্টোবর, ২০১৭; লিংক https://www.marxistsfr.org/archive/mehring/1905/10/engels.htm

৬. লেনিন; আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঐক্য প্রসঙ্গে; প্রগতি প্রকাশন মস্কো; বাংলা অনুবাদ, ১৯৭৩; পৃষ্ঠা- ৪৫৭-৪৫৮।

রচনাকাল ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

Leave a Comment

error: Content is protected !!