গঙ্গাধর মোরেশ্বর অধিকারী সিপিআই-য়ের তাত্ত্বিক নেতা

গঙ্গাধর মোরেশ্বর অধিকারী সিপিআই বা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক নেতা! বার্লিনে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়ে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের প্রভাবে মার্কসীয় দর্শনে দীক্ষিত হন। ১৯২৮ খ্রি শেষ দিকে তিনি রায়ের কাছ থেকে একটি পরিচয়পত্র নিয়ে ভারতে আসেন এবং অনতিকাল পরে মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় কারারুদ্ধ হন। কমিন্টার্ন থেকে মানবেন্দ্রনাথ বহিষ্কৃত (১৯২৯) হবার পর অধিকারী কমিন্টার্ন-স্বীকৃত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতেই থেকে যান। আমৃত্যুকাল তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সদস্য ছিলেন (১৯৩৩-৮১)। তাঁর লেখা বিভিন্ন বইপত্রের মধ্যে পার্টির প্রথম আট বছরের দলিলসমৃদ্ধ পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত ইতিহাস বিশেষ উল্লেখযােগ্য। 

মার্কসীয় দৃষ্টিতে ভারতীয় রাজনীতির বিশ্লেষণসুত্রে ১৯৪২ খ্রি এদেশের মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং ভারতভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হবার অধিকার তথা পাকিস্তান দাবি সম্পর্কে অধিকারীর একটি থিসিস বিতর্কের সৃষ্টি করে। সমাজ-বিবর্তনে শ্রেণিসংগ্রামের মূল ধারার অনুষঙ্গী অনেক ছােটবড় ঘটনাপ্রবাহ মার্কসীয় রাষ্ট্রচিন্তায় স্বীকৃত। ভারতীয় প্রেক্ষাপটে তার অন্যতম অভিব্যক্তি হলো ধর্ম ও জাতির রাজনীতিকরণ, যার পরিণতি হলো পাকিস্তান সৃষ্টির দাবি। অনুরূপ দাবি প্রাক-স্বাধীন ভারতে তুলেছিল আরও কোনও কোনও জাতি। অধিকারী গরিষ্ঠসংখ্যক মুসলমানদের আত্মস্বাতন্ত্র্য তথা ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হবার দাবিকে যুক্তিগ্রাহ্য মনে করেছিলেন, ভারত যেমন চেয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন এক স্বাধীন সার্বভৌম সত্তা।

মার্কসের এশীয় উৎপাদন পদ্ধতি ও তার উপরিকাঠামাে প্রাচ্যের স্বৈরতন্ত্র-ভিত্তিক বিশ্লেষণ অনুসরণ করে গঙ্গাধর মোরেশ্বর অধিকারী দেখিয়েছেন যে ভারতের বর্ণব্যবস্থাগত শ্রেণিবিভাজন কৃষিভিত্তিক, স্বয়ম্বর এবং এক স্থাণু সমাজব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে কীভাবে হিন্দু-মুসলমান বিভেদ ও অসংখ্য ক্ষুদে জাতির ভেদাভেদ ভারতীয় একজাতি (নেশন) প্রত্যয়কে ভুল প্রমাণিত করে। মার্কস ভেবেছিলেন সৃষ্টি ও লয়, রক্ষণশীলতা ও আধুনিকতার দ্বন্দ্ব এবং ব্রিটিশ বুর্জোয়া সভ্যতার অভিঘাতে ভারতীয় সমাজে যে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া ঘটে তার ফলে ইংরেজের সৃষ্ট হিন্দু-মুসলমান বিভেদ ও অন্যান্য জাতিভেদ ঘুচে যাবে। লেনিনেরও ছিল অনুরূপ প্রত্যাশা যে, খিলাফত আন্দোলন উল্লিখিত বিভেদকে প্রশমিত করবে এবং বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীদের সমন্বিত করবে।

আরো পড়ুন:  গের্তসেন স্মরণে

অধিকারী ভারতীয় সমাজের ভিন্ন প্রবণতা প্রত্যক্ষ করেন যার সঙ্গে সঙ্গতি বজায় রেখে এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে গড়ে তােলার অভিমত তিনি পােষণ করতেন। তাঁর দৃষ্টিতে সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধী যে মুসলিম মানসকে আধাবিপ্লবী পথে মুসলিম লিগ চালিত করে, সেটি হিন্দু-বিরােধের রূপ নেয় এবং পাকিস্তান-রাষ্ট্র সৃষ্টি করে। কালক্রমে পাকিস্তানও স্বাভাবিক দুটি ভিন্ন আবেগের তাড়নায় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পশ্চিমে পাকিস্তান ও পূর্বে স্বতন্ত্র বাংলাদেশ রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের রাজনীতিকরণকে মেনে নিয়ে কমিউনিস্ট রাজনীতি সঞ্চার করার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। শ্রমিক আন্দোলনে অগ্রসর তামিলনাড়ু এবং কৃষক আন্দোলনে অগ্রসর অন্ধ্রপ্রদেশে একদা শক্তিশালী কমিউনিস্ট রাজনীতি সংকীর্ণ প্রাদেশিক জাতিগত আন্দোলনে পর্যবসিত হয়। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ তথা পূর্ব ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নামে গণশত্রু কংগ্রেসকে সমর্থনের এক স্বৈরতন্ত্রী ইতিহাসের শিকড় বিস্তার করেছে।

তথ্যসূত্র:

১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ১৫-১৬।

Leave a Comment

error: Content is protected !!