গিওর্গি ভালেন্তিনোভিচ প্লেখানভ ছিলেন প্রখ্যাত রুশ চিন্তাবিদ এবং মার্কসবাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাতা

গিওর্গি ভালেন্তিনোভিচ প্লেখানভ (ইংরেজি: Georgi Valentinovich Plekhanov, ২৯ নভেম্বর, ১৮৫৭-৩১ মে, ১৯১৮) মার্কসবাদী পণ্ডিত ও তাত্ত্বিক, প্রখ্যাত রুশ চিন্তাবিদ, রুশ সমাজ-গণতন্ত্রী দলের এবং রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি রাশিয়ায় প্রথমদিকের সেইসব ব্যক্তিদের একজন যিনি নিজেকে মার্কসবাদী হিসেবে পরিচিত করেন।  ভি. আই. লেনিন তাকে ‘মার্কসবাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাতা’ হিসেবে বর্ণনা করেন।

পুরনো ক্যালেন্ডারে ১৮৫৭ সনে ২৬শে নভেম্বর রাশিয়ার তাম্বোভ প্রদেশের এক সভ্রান্ত পরিবারে প্লেখানভ জন্মগ্রহণ করেন। গিওর্গি প্লেখানভের পিতা, ভ্যালেন্তিন প্লেখানভ, তাতার নৃতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের সম্ভ্রান্ত সামন্তপ্রভু ছিলেন। 

প্লেখানভের লেখাপড়া ১৮৬৬ সালে ১০ বছর বয়সে শুরু হয় যখন তিনি ভরোনেঝের কন্সতান্তিনভ মিলিটারি একাডেমিতে প্রবেশ করেন। ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত সেখানেই তার শিক্ষকদের দ্বারা ভালোভাবে লেখাপড়া শেখেন। এরপর পিতার মৃত্যু হলে তিনি মিলিটারি একাডেমি ছেড়ে যান এবং সেন্ট পিটার্সবুর্গ Metallurgical Institute-এ ভর্তি হন। এখানে ছাত্র থাকাকালিন তিনি ১৮৭৫ সালে একজন তরুণ বিপ্লবি বুদ্ধিজীবী পাভেল আক্সেলরদের (১৮৫০-১৯২৮) সাথে পরিচিত হয়েছিলেন এবং পরে পাভেল আক্সেলরদ লিখেছিলেন যে প্লেখানভ তাৎক্ষনিকভাবে তার মনে ভাল ছাপ ফেলতে সক্ষম হন। 

“He spoke well in a business-like fashion, simply and yet in a literary way. One perceived in him a love for knowledge, a habit of reading, thinking, working. He dreamed at the time of going abroad to complete his training in chemistry. This plan didn’t please me… This is a luxury! I said to the young man. If you take so long to complete your studies in chemistry, when will you begin to work for the revolution?”[১]

আক্সেলরদের প্রভাবে প্লেখানভ কর্মী হিসেবে পপুলিস্ট (নারোদনিক) আন্দোলনে ১৮৫৭ সনের দিকের সেইসময়ের বিপ্লবি প্রতিষ্ঠান ‘জমি ও স্বাধীনতা’য় যোগ দেন। প্লেখানভ ১৮৭৭ এবং ১৮৭৮ সালে দুবার গ্রেপ্তার হন এবং কিছুদিন পরই মুক্তি পান। তিনি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড প্রবণতার জন্য এই সংগঠন ত্যাগ করেন। তিনি রাশিয়া ত্যাগ করেন ১৮৮০ সালে এর পরবর্তী প্রায় চল্লিশ বছর যাবত নির্বাসনে থাকেন, অধিকাংশ সময়ই তিনি ছিলেন সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে।

আরো পড়ুন:  ইউজিন পতিয়ের বা ওজেন পোতিয়ে, তাঁর মৃত্যুর ২৫তম বার্ষিকী

নির্বাসনে থাকাকালে তিনি মার্কস এবং এঙ্গেলস এর রচনাবলী পাঠ করেন এবং পশ্চিম ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে সংযোগ স্থাপন করেন। এই পর্যায়ে তিনি নারোদবাদ বা সংস্কারবাদী জনতা দল পরিত্যাগ করতে সক্ষম হন।[২] ১৮৮৩ সালে জেনেভাতে বিপ্লবী মার্কসবাদের আদর্শে ‘শ্রমিক মুক্তি সংঘ’ (liberation of labor) গ্রুপ গঠন করেন। এই ‘শ্রমিক মুক্তি সংঘ’ রুশ মার্কসবাদী আন্দোলন তথা রুশ সমাজ-গণতন্ত্রী আন্দোলনে ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। 

১৮৮৫ সালে প্লেখানভ তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইতিহাসের অদ্বৈতবাদী ব্যাখ্যা বিষয়ে আলোচনা’ (The Development of the Monist View of History) প্রকাশ করেন। লেনিন বলেন, রুশ দেশে মার্কসবাদীদের গোটা একটা জীবনকালকে শিক্ষিত করে তুলতে এই গ্রন্থটি প্রভূত সাহায্য করে। এছাড়া তিনি ‘সমাজতন্ত্র ও রাজনৈতিক সংগ্রাম’ (Socialism and the Political Struggle, 1883), ‘আমাদের মতবিরোধ’ ইত্যাদি গ্রন্থ রচনা করেন। এসব পুস্তক রচনা ছাড়া তিনি রুশ ভাষায় মার্কস ও এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তেহার ১৮৮২ সনে অনুবাদ করেন, যার ভূমিকা লেখেন কার্ল মার্কস। তিনি ও তার সহকর্মী ভেরা জাসুলিচ (১৮৪৯-১৯১৯), আক্সেলরদ প্রমুখ মার্কস ও এঙ্গেলসের ‘মজুরি শ্রম ও পুঁজি’, ‘বৈজ্ঞানিক ও কাল্পনিক সমাজতন্ত্র’ প্রভৃতি প্রখ্যাত গ্রন্থ অনুবাদ করেন। মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব গ্রন্থটি তিনি সম্পাদনা করেন। তাদের এসব কর্মকাণ্ড রাশিয়ার মার্কসবাদী আন্দোলনের মূল তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। তিনি তাঁর তত্ত্বগত রচনায় নারোদবাদ, আইনগত মার্কসবাদ, সংস্কারবাদ এবং বুর্জোয়া দর্শনকে খন্ডন করার চেষ্টা করেন। 

১৯০০ সালে শ্রমিক মুক্তি সংঘের সহযোগিতায় প্লেখানভ, আক্সেলরদ, জাসুলিচ, পেত্রসভ, মার্তভ প্রমুখের বিশেষ উদ্যোগে লেনিন সারা রাশিয়ার প্রথম মার্কসবাদী পত্রিকা ‘স্ফুলিঙ্গ’ বা ‘ইস্ক্রা’ প্রকাশ করেন। এসব যাবতীয় কর্মকাণ্ডের অন্যতম পুরোধা ছিলেন প্লেখানভ। ১৯০৩ সালে রুশ সমাজ-গণতন্ত্রী শ্রমিক দল প্রতিষ্ঠিত হয়। দলে প্লেখানভ এবং তার অনুসারীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন। কিন্তু লেনিনের মতের বিরুদ্ধে যাওয়ায় পার্টিতে মেনশেভিক ও বলশেভিক এই দুটি পরস্পর বিরোধী ধারা পোক্ত হতে থাকে যা পরবর্তীকালে মতাদর্শগত বিরোধে পরিণত হয়। তিনি ১৯০৫ সনে রাশিয়ার বিপ্লব প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেননি। এবং তারপর থেকেই নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন।

আরো পড়ুন:  নিকোলাই বুখারিন রুশ বিপ্লবের একজন প্রখ্যাত রাজনৈতিক তাত্ত্বিক

১৯০৩ এর পরবর্তী পর্যায়ে মার্কসবাদের সঙ্গে প্লেখানভের মতদ্বৈধ দেখা যায়। মার্কসবাদের অনুসারীগণ বলেন যে, ১৯০৫ এর অভ্যুত্থান এবং প্রতিক্রিয়ার হাতে তার পরাজয়ের তাৎপর্য অনুধাবনে প্লেখানভ ব্যর্থ হন। পরিণামে তিনি বলশেভিকদের বিরোধীপক্ষ মেনশেভিকদের পক্ষ অবলম্বন করেন।[২]

১৯১২ সালের জানুয়ারি মাসে প্রাগে ঐ দলের ষষ্ঠ সারা রুশ পার্টি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এই কনফারেন্সে মেনশেভিকরা অর্থাৎ প্লেখানভ ও তার দল পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হন। তার ‘শিল্পকলা ও সমাজ জীবন’ (Art and Social Life; 1912–1913) এবং ‘ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা’ গ্রন্থদ্বয়ে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে শিল্প সাহিত্যকে দেখার চমৎকার বিশ্লেষণ রয়েছে।[৩]

মার্কসের তত্ত্বকে ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ’ নামে তিনিই প্রথম ভূষিত করেন। তিনিই সর্বজনীনভাবে দ্বন্দ্বনীতি ও বস্তুবাদকে কেবল সমাজ অর্থনীতির গণ্ডি ছাড়িয়ে সাহিত্য দর্শন ও বিজ্ঞানে সার্বিকভাবে প্রযোজ্য বলে তুলে ধরেন। তিনি বলেন রাশিয়াতে বিপ্লব হবে দুই স্তরে। সামন্তবাদ ও জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক বিপ্লব। এরপর পুঁজিবাদী পর্যায়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। দুটির ভিতর বিরাট ব্যবধান কিছু নাও থাকতে পারে। এই কাজে শ্রমিকদেরই এগিয়ে আসা প্রয়োজন। তবে রাশিয়ায় শ্রমিক-সংখ্যা কম, চেতনায় তারা পিছিয়ে সুতরাং এই বিপ্লবে বুদ্ধিজীবী অংশের এগিয়ে আসতে হবে।

তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়াতে ফিরে এসে যুদ্ধ সমর্থন করেন। অক্টোবর বিপ্লবকেও তিনি অপ্রস্তুত এবং অপরিণত বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে বিপর্যয় ডেকে আনবে। ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা গ্রন্থ ও অন্যান্য কাজের জন্য প্রশংসা জানালেও লেনিন কঠোরভাবে প্লেখানভের সমালোচনা করেন।[৪] ১৯১৭ সালের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তাৎপর্যও তিনি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন। কিন্তু তা হলেও লেনিন এবং মার্কসবাদীগণ প্লেখানভের তাত্ত্বিক রচনাসমূহকে মার্কসবাদের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বিশেষ মূল্যায়ন বলে মনে করেন। তাঁর রচনাসমূহের মধ্যে ‘ইতিহাসের অদ্বৈতবাদী ব্যাখ্যার বিকাশ’, ‘বস্তুবাদের প্রসঙ্গ’ ‘ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা’ প্রভৃতি গ্রন্থগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

 তিনি ১৯১৭ সনের রুশ বিপ্লবকে ‘বুর্জোয়া’ বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করেন। ১৯১৮ সনের ৩০ মে তিনি ফিনল্যান্ডের তেরিজোকিতে নির্বাসিত অবস্থায় যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে ৬১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে সেন্ট-পিটার্সবুর্গের ভল্কোভো সিমেট্রিতে সমাহিত করা হয়।  

আরো পড়ুন:  বাব্যুফ বা ফ্রান্সিস-নোয়েল ব্যাবুফ ছিলেন ফরাসি বিপ্লবী

তথ্যসূত্র ও টিকাঃ

১. Samuel H. Baron, Plekhanov: The Father of Russian Marxism. Stanford, CA: Stanford University Press, 1963; pg. 31.

২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ৩১১-৩১২। 

৩. আফজালুল বাসার; বিশ শতকের সাহিত্যতত্ত্ব; বাংলা একাডেমী, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি, ২০০৩; পৃষ্ঠা- ৩০১-২।

৪. সমীরণ মজুমদার; মার্কসবাদ, বাস্তবে ও মননে; স্বপ্রকাশ, কলকাতা; ১ বৈশাখ, ১৪০২। পৃষ্ঠা- ১৬৩।  

Leave a Comment

error: Content is protected !!