“শুক-শারী সংবাদ” বা ‘বৃন্দাবন বিলাসিনী রাই আমাদের’ কীর্তন গানটি আমরা লোপামুদ্রা মিত্রের এবং কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯২৪ – ২০০০) কণ্ঠে শুনেছি বহুবার। এই গানটি উত্তম কুমার (১৯২৬- ৮০) অভিনীত ‘রাইকমল’ সিনেমাতেও গাওয়া হয়েছিল। সেই বিখ্যাত গানটির গীতিকারের নাম গোবিন্দ অধিকারী।
গোবিন্দ অধিকারী (১৮০০-১৮৭২) বাংলা ১২০৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। হুগলী জেলার জাঙ্গিপাড়া গ্রামে বৈরাগীকুলে জন্ম। স্বগ্রামে বাল্যশিক্ষা শেষ করে তিনি হাওড়া জেলার ধুরখালি গ্রামের গোলোকদাস অধিকারীর নিকট কীর্তন শিক্ষা করেন। তিনি জাতিতে বৈষ্ণব শ্রেণিভুক্ত ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি জগদীশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের যাত্রাদলে ‘ছোকরা’ হিসেবে প্রথম খ্যাতি অর্জন করেন। প্রথমে নিজেই কীর্তনিয়া দল ও পরে ‘কালীয় দমন’ যাত্রাদল গঠন করে অভিনয় আরম্ভ করেন। ‘রাধাকৃষ্ণের লীলা’ অভিনয়ে তিনি স্বয়ং দূতীর ভূমিকায় খ্যাতিমান হন ও প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। তারপর তিনি জাঙ্গিপাড়া-কৃষ্ণনগর ছেড়ে কলকাতার নিকটস্থ সালিখায় আসেন। যাত্রাদলের জন্য তাঁর রচিত বহু পদাবলী ও সংগীত বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি সাধনে সহায়ক হয়েছে। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য যাত্রাপালা হচ্ছে শুকসারীর পালা ও চূড়া-নূপুরের দ্বন্দ্ব।
গোবিন্দ অধিকারী ছিলেন উনিশ শতকের একজন বিখ্যাত যাত্রাভিনেতা। সেসময় শিশুরাম অধিকারী, পরমানন্দ অধিকারী, গোবিন্দ অধিকারী ছিলেন কৃষ্ণ যাত্রার পালাকার। ১৬ শতক থেকে ১৮ শতক কৃষ্ণ যাত্রা, শক্তি যাত্রা, পাল যাত্রা, নাথ যাত্রা, সেই সঙ্গে সংকীর্তন ও কবির গান বাংলাদেশে প্রচলিত ছিল।
যাত্রার ভেতর কৃষ্ণ যাত্রার শুরু হয় ১৬ শতকে। সেই ধারার কৃষ্ণযাত্রায় গোবিন্দ অধিকারীর দুতীগিরি দেখবার জন্য দশ ক্রোশ বা বিশ মাইল রাস্তা হেঁটে লোকে যাত্রা দেখতে যেত। “চুক্তির টাকা” ছাড়াও তিনি আসরে অনেক টাকা উপহার পেতেন। তাঁর গানে মোহিত হয়ে অর্থহীন লোকে গায়ের উত্তরীয় পর্যন্ত খুলে পারিতোষিক দিতেন।[১]
গোবিন্দ অধিকারী (১৭৯৮-১৮৭০) বাংলা ১২০৫ সালে হুগলী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১২৭৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি কীর্তনের দোহারও গাইতেন। যাত্রার গানে তাঁর লেখা অনুপ্রাস বেশ মনোগ্রাহী।[১] তিনি ছাড়াও উনিশ শতকের নগর কলকাতার শ্রোতাদের মন অন্য যে দুজনের কৃষ্ণযাত্রার গানের দ্বারা ছুঁয়েছিল তাঁরা হলেন কৃষ্ণকমল গোস্বামী (১৮১০ – ১৮৮৮) ও নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায় (১৮৪২-১৯১১)। এঁদের তিনজনেরই জন্ম কলকাতার বাইরে এবং জনপ্রিয়তা গ্রামে গঞ্জে কিন্তু নগর কলকাতার বিদগ্ধসমাজ এঁদের যথেষ্ট সমাদর করেছে।[২]
তাঁর এই চমৎকার শুক-শারী সংবাদ গানটির অনুসরণে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩) লিখেছিলেন “কৃষ্ণ বলে আমার রাধে বদন তুলে চাও” গানটি। গোবিন্দ অধিকারীর এই গান শুনলে মনে হবে রাধার প্রেম আসলেই অনন্য, এ ভালবাসা অবশ্যই স্বর্গীয়। এছাড়াও গোবিন্দ অধিকারীর অন্য আরেকটি বিখ্যাত গান হচ্ছে ‘চম্পক বরণী বলি, দিলি যে চমক কলি/ এ ফুলে এ কল আছে কে জানে …।
তথ্যসূত্র:
১. কাজী মোতাহার হোসেন রচনাবলী, আবদুল হক (১৯১৮-৯৭) সম্পাদিত; বাংলা একাডেমী, ঢাকা; ৩ ডিসেম্বর, ১৯৮৪; প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭১-৭২।
২. সুধীর চক্রবর্তী; বাংলা গানের সন্ধানে; অরুণা প্রকাশনী কলকাতা; ২৫ বৈশাখ, ১৩৯৭; পৃষ্ঠা- ৪৭।
বি দ্র: আপনারা যারা ‘বৃন্দাবন বিলাসিনী রাই আমাদের’ গানটি শোনেননি তারা ইউটিউবে লোপামুদ্রা মিত্রের গাওয়া গানটি শুনতে পারবেন এই লিংক থেকে এবং কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া গানটি শুনতে পারবেন এই লিংক থেকে।
রচনাকাল ২৫ মার্চ, ২০১৪।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।