হিপোক্রেটিস প্রাচীন গ্রিসের চিকিৎসাবিদ ছিলেন

হিপোক্রেটিস বা হিপোক্রাটিস বা কসের হিপোক্রেটিস (Hippocrates of Kos) প্রাচীন গ্রিসের চিকিৎসাবিদ ছিলেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক বলে তিনি পরিচিত। সততার সঙ্গে মানুষের সেবাই হবে একজন চিকিৎসকদের নীতি বা ধর্ম – এই মর্মে চিকিৎসকের শপথ নেওয়ার যে কথা তিনি বলেচিলেন তা আজো ‘হিপোক্রেটিসের শপথ’ বলে সম্মানিত।

হিপোক্রেটিস তাঁর জীবনকালে গ্রিসের বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ করে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তাঁর চিকিৎসার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল মানুষকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা। পর্যবেক্ষণ হচ্ছে বিজ্ঞানের প্রথম শর্ত। সেকালেও রোগের ক্ষেত্রে শল্য চিকিৎসা বা অস্ত্রোপচারের তিনি একজন প্রবক্তা ছিলেন। মানুষের রোগের মূলে রয়েছে দেহের রক্তের সংশ্লেষণ ব্যত্যয়ের উদ্ভব এরূপ অভিমত পোষণ করে দেহের জলীয় পদার্থকে তিনি বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেন।

ধীর, স্থির চরিত্রের অধিকারী হিপোক্রাটিসের মন তাঁর রোগীদের জন্য যেমন সহানুভূতিতে পূর্ণ ছিল, তেমনি তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান দ্বারা তাঁর সহকর্মী ও উত্তরাধিকারী চিকৎসক-সমাজও যেন লাভবান হতে পারে, তেমন একটি দার্শনিক এবং সহৃদয় বোধ দ্বারা হিপোক্রাটিস উদ্ধুদ্ধ ছিলেন। বিজ্ঞানের সেই সূচনাকালে যেখানে কল্পনা এবং দর্শনেরই ছিল প্রাধান্য সেখানে হিপোক্রাটিস সেই পথিকৃৎদের অন্যতম যাঁরা যুক্তিকে বাস্তব পর্যবেক্ষণে প্রয়োগ করে প্রমাণযোগ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বস্তুত হিপোক্রাটিসের অনুসৃত পদ্ধতিই আরোহী বিজ্ঞান তথা ‘ইনডাকটিভ সায়েন্স’-এর ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল।

আরোহী বিজ্ঞানের কারণে হিপোক্রাটিস এবং তাঁর অনুসারীদের রচনাসমূহের তাৎপর্য কেবল চিকিৎসাশাস্ত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সেকালে হঠাৎ মূর্ছা যাওয়া এবং অন্যান্য দুরারোগ্য ব্যাধিকে ভৌতিক বা অলৌকিক বলে সাধারণ মানুষ ধারণা করত। রোগের কার্যকারণবোধ স্বীকৃত ছিল না। কিন্তু এই কালেই হিপোক্রাটিসের একজন অনুসারী মূর্ছা যাওয়ার ঘটনাকে কার্যকারণের ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেন। এ প্রসঙ্গে খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় ৪০০ বৎসর পূর্বে হিপোক্রাটিসের রচিত ‘অলৌকিক রোগ’ বা ‘সেকরেড ডিজিজ’ নামক রচনায় তার নিম্নোক্ত উক্তিটি বিশেষ তাৎপর্যময় উক্তি বলে বোধ হয়।

“যেসব রোগকে অলৌকিক বলে অভিহিত করা হয় তারাও কারণবিহীন নয়। অন্য রোগের মতো এ সকলেও উৎস হচ্ছে দেহের মধ্যে শৈত্য, তাপ, বায়ু এবং এরূপ নিত্য-অস্থির উপাদানসমূহের প্রবেশ ও নিষ্ক্রমণ। সব ঘটনারই পূর্ব ঘটনা থাকে। যে তার অন্বেষণ করে সে অবশ্যই তার সাক্ষাৎ লাভে সক্ষম হয়”।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক, খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের চিকিৎসাবিদ হিপোক্রাটিস অসুস্থ মানুষের সেবায় নিঃস্বার্থ এবং সততার সঙ্গে চিকিৎসকমাত্রের করণীয় হিসাবে যে শপথনামা তৈরি করেছিলেন তা চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে পৃথিবীব্যাপী হিপোক্রেটিসের শপথ বা ‘হিপোক্রেটিক ওথ’ (ইংরেজি: Hippocratic Oath) নামে পরিচিত। হিপোক্রাটিসের শপথের মর্মকথা ছিল এরূপ:

“যে গুরু আমাদের শিক্ষাদান করেছেন মহৎ এই শাস্ত্র, তিনি আমার পিতার মতো: আমার জীবন তাঁর জীবনেরই অঙ্গস্বরূপ আমার যা কিছু সুখ, তাকে আমি ভোগ করব আমার সেই পিতার সঙ্গে মিলিতভাবে। তাঁর সন্তানরা আমরা নিজের সহোদর সম। আমার কর্তব্য আমার এ সহোদরদের শিক্ষাদান করা আমার গুরুর প্রদত্ত এই শাস্ত্র-কৌশলকে। এই শাস্ত্রকে আয়ত্ত করার অধিকার কেবল তাদেরই যারা এই শাস্ত্রের নীতিকে মান্য করার প্রতিশ্রুতিতে স্বইচ্ছাতে আবদ্ধ। আমার জ্ঞান, ক্ষমতা এবং বিবেচনাবোধ দ্বারা আমি আমার রোগীদের তেমন নিরাময়পত্রই প্রদান করব, যা তাদের মঙ্গল সাধন করবে, উপশমে সাহায্য করবে এবং ক্ষতির কোনো কারণ হবে না। কোনো মারাত্মক ঔষধ যা আমার রোগীর মৃত্যু ঘটাতে পারে, আমি তেমন কোনো ঔষধের ব্যবস্থা আমার রোগীকে প্রদান করব না কিংবা মাতার গর্ভজাত ভ্রুণকে বিনষ্টকারী কোনো উপায়েরও আমি উৎস হবো না। আমার জীবনের এবং এই শাস্ত্রের পবিত্রতা রক্ষা করা হবে আমার পালনীয় ব্রত। আমার রোগীর দেহে বিষাক্ত পদার্থের বিমোক্ষণে শল্য ক্রিয়ার প্রয়োজন হলে তা সম্পন্ন করার দায়িত্ব কেবল এমন ক্রিয়ার বিশেষজ্ঞেরই: অবিশেষজ্ঞের নয়। আমার রোগীর গৃহে প্রবেশ ঘটবে তার উপশম এবং মঙ্গলের জন্য: স্ত্রী কিংবা পুরুষ, দাস কিংবা অ-দাস কারুর প্রতি কোনো মোহাকর্ষণ আমার জন্য অপবিত্র। আমার চিকিৎসাকর্মকালে আমার রোগীর যা কিছু তথ্য আমার জ্ঞানের মধ্যে আসুক না কেন তাকে গোপন রাখা এবং প্রকাশ না করা হবে আমার শাস্ত্রীয় কর্তব্য। আমার এই আনুগত্যই হবে আমার জীবনের সকল সুখ ও সম্মানের একমাত্র ভিত্তি। এবং এর কোনো ব্যত্যয় নিয়ে আসবে আমার জীবনে এর বিপরীত তথা অভিশাপ এই হোক আমার জীবনের প্রত্যয় এবং প্রত্যাশা”।

হিপোক্রেটিসের শৈলী দর্শন ও ধর্মীয় রীতিনীতি থেকে পৃথক করে চিকিৎসাশাস্ত্রকে একটি পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে প্রাচীন গ্রিক চিকিৎসাশাস্ত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে।

আরো পড়ুন:  লুইস হেনরী মর্গান ছিলেন একজন বিখ্যাত মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী ও নৃতাত্ত্বিক

তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৯৬-১৯৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!