হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশে বিরাজিত লুটপাটের অর্থনীতির লাঠিয়াল

১৯৭১ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের পাঁচ প্রতিক্রিয়াশীল জনপ্রিয় লেখকের একজন হুমায়ুন আহমেদ (১৩ নভেম্বর, ১৯৪৮ – ১৯ জুলাই, ২০১২)। হিমু, মিসির আলীর মতো দায়িত্ব ও কাণ্ডজ্ঞানহীন চরিত্র সৃষ্টি করে তিনি লক্ষ লক্ষ তারুণ্যকে পথভ্রষ্ট করেছিলেন। বাংলাদেশের এক বিশাল সংখ্যার তারুণ্যকে অরাজনৈতিক, দায়িত্বহীন, কাণ্ডজ্ঞানহীন, অবৈজ্ঞানিক, যৌনতাগ্রস্ত, হতাশাগ্রস্ত, অবসাদগ্রস্ত, উন্নাসিক, আত্মভোলা, নিস্ক্রিয়, ব্যধিগ্রস্ত, কর্মবিমুখ ও প্রতিক্রিয়াশীল করতে হুমায়ুন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্রগুলো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে গত চার দশকে। এর মাঝেও দুটি উপন্যাস ও দু’একটি নাটকের জন্য তিনি কিছু মানুষের শ্রদ্ধা ও ব্যবসায়িক মুনাফার জন্য প্রকাশকদের সম্মান পাবেন আরো বেশ কিছু দিন।

যে মানুষ মানুষ গড়ার পেশা শিক্ষকতা ছেড়ে প্রকাশক আর প্রযোজকদের কাছে বিক্রি হয়ে চাহিদামাফিক নানা বাজে লেখা লিখেন, প্রকাশকদের লালসার শিকার হন, কোটি টাকা কামান, তার সৃষ্টিশীলতা নিয়ে আরো অনেক প্রশ্ন উঠবে। একজন লেখককে নৈতিক দিক দিয়েও সৎ হতে হয়।

হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পরে তাকে নিয়ে পত্রিকা ও টিভিগুলোর কান্নার ফোয়ারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি ব্যবসায়ীদের কাছে ছিলেন একজন বিক্রয়যোগ্য মুনাফাকেন্দ্রিক পণ্য। হুমায়ুন আহমেদের লেখালেখির ছোট ছোট অংশগুলো হয়ত দেখতে উপরের চাকচিক্যে সুন্দর, কিন্তু সেগুলো ময়লা-আবর্জনা-নর্দমার মধ্যে পড়ে থাকা গোলাপের তোড়া! দেখে ভালো লাগলেও ওই নর্দমা থেকে কেউ সেগুলো তুলে নেয় না। এখন যে ধান্দাবাজ ও মতলববাজ ব্যবসায়ি মধ্যবিত্তরা তুলে নিয়েছেন তারাও তাকে একদিন আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন। কেবল আর একজন জনপ্রিয় তৈরি করার ও বিক্রি শুরু করার জন্য অপেক্ষা যতদিন।

বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদ মূল্যায়নে সমস্যা

বাংলাদেশের প্রচারমাধ্যমের কাছে পাহাড়ধ্বসে ১০০ মানুষ মারা গেলে তা নিয়ে যে আলোচনার ঝড় উঠে তার চেয়ে শত গুণ বেশি ঝড় উঠেছিল হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যুতে। আর এটা দেখেই বোঝা যায় হুমায়ুন আহমেদ কোন শ্রেণির জন্য সারা জীবন কাজ করে গেছেন। তিনি নিজে শহুরে প্রতিক্রিয়াশীল উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের বিনোদনের জন্য লিখেছেন। হুমায়ুন আহমেদ মারা যাওয়ায় দেখা গেছে কতিপয় বামদের আসল চেহারা, কার্ল মার্কস মরলেও কী তারা এতো কষ্ট পেতেন! এই বামেরা এখন উগ্র-জাতীয়তা ও সাম্প্রদায়িকতার কথাও ছড়ান। গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার বিবৃতিতে একটি লাইন ছিলো,    

“জনপ্রিয় ধারার সাহিত্যকে তিনি কোলকাতাকেন্দ্রিক প্রভাব বলয়ের বাইরে বাংলাদেশের বাস্তবতায় একটা স্বতন্ত্র ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছেন।”[১]  

কিন্তু ঘটনা কী আলাদা নয়? প্রকৃতপক্ষে হুমায়ুন যে ভিত্তির উপর বাংলাদেশের সাহিত্যকে দাঁড় করেছিলেন সেটা উঠতি মুসলমান মধ্যবিত্ত যে ধরনের বই পড়ে তাতে মুসলমান নামধারী চরিত্র আমদানি করা। কোলকাতার সাহিত্যের বদলে তিনি ঢাকার একটি ধারা তৈরি করেছিলেন যে ধারা কোলকাতার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকে সচেতনভাবে বাদ দেবার উদ্দেশ্যে; আর সেই কথাই ফুটে উঠেছে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার বিবৃতিতে। গণতান্ত্রিক বাম মোর্চাও কী সেটাই চায়? তাহলে বামপন্থিরা যে আন্তর্জাতিকতার কথা বলে তা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়?

হুমায়ূনের সাহিত্য বিচার করে বাংলাদেশের আরেক বামপন্থী এবং জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি  বদরুদ্দীন উমর বলেন,

“হুমায়ূন আহমেদ তার গল্প বলার মস্ত বড় শক্তির ইতিবাচক ক্ষমতাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করেননি।”[২]  

বদরুদ্দিন উমরকে জিগাইতে মন চায়, মীরজাফরও তো তার মস্ত বড় শক্তির ইতিবাচক ক্ষমতাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করেননি; মীর জাফরও তো তার মস্ত বড় শক্তির ইতিবাচক ক্ষমতাকে কাজে লাগাইলে বাংলা পরাধীন হইতো না। আমাদের জিজ্ঞাসা, বদরুদ্দীন উমর এইভাবে মানেন কী না? হুমায়ুন মনে হয় এই “মস্ত বড় শক্তির ইতিবাচক ক্ষমতাকে যথাযথভাবে ব্যবহার” করলে বিপ্লব করে ফেলতেন? তা এই ব্যবহার না করার জন্য কমরেড হুমায়ুন আহমেদের বিচার করা যায় কীনা?

২৪ জুলাই, ২০১২-তে ফেসবুকে আনু মুহাম্মদ যে ক্ষুদ্র মন্তব্যটি করেন তাতে একটি লাইন ছিলো,  

হুমায়ূন আহমেদ প্রসঙ্গে আনু মুহাম্মদ
“বাণিজ্যের জালে কাবু না হলে আমরা হয়তো তাঁকে আরও বহুদূর যেতে দেখতাম।”—আনু মুহাম্মদ

“বাণিজ্যের জালে কাবু না হলে আমরা হয়তো তাঁকে আরও বহুদূর যেতে দেখতাম।”[৩]   

আনু মুহাম্মদের ক্ষেত্রেও একই কথা জিগ্যেস করা যায়, ইংরেজদের জালে কাবু না হলে আমরা মীরজাফরকে আরও বহুদূর যেতে দেখতাম_ এইভাবে আনু মুহাম্মদ মানেন কীনা? মানুষকে কী এইভাবে বামপন্থিরা মূল্যায়ন করেন?

মানুষকে মূল্যায়ন করতে হয় তার সমস্ত কাজ দিয়ে। কী করলে কী হতো তা ওইতিহাসিক বিচারে অগ্রহণযোগ্য, যে যেটুকু কাজ করেছে সেটুকু দিয়েই তাকে মূল্যায়ন করতে হবে। কার কাজ কোন শ্রেণির পক্ষে গেছে তা বিবেচনা করেই মানুষকে মূল্যায়ন করতে হবে।

বদরুদ্দীন উমর বা আনু মুহাম্মদ ভুলে গেছেন শংকর, আশুতোশ মুখোপাধ্যায়, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, যাযাবর, নিমাই ভট্টাচার্য, আশাপূর্ণা দেবী, প্রভাবতী দেবী, নীহাররঞ্জন রায় বা সাম্প্রতিককালের কাজী আনোয়ার হোসেনের নাম। এইসব বামপন্থীরা ভুলে যান শরৎচন্দ্রের সময় শিক্ষার হার কত ছিলো। বদরুদ্দীন উমর ভুলে গেছেন উল্লেখিত লেখকেরাও তাদের সময়ে অনেক জনপ্রিয় ছিলেন এবং এখন সবাই তাদেরকে ভুলে গেছেন।

হুমায়ূন আহমেদের চরিত্রচিত্রণ

হুমায়ূন আহমেদের ভাঁড়, কৌতুককর, হাস্যকর, জোকার, সং চরিত্রগুলো গ্রামীণ অভাবী জনগণের ব্যর্থতাকে কলুষিতভাবে উপস্থাপন করেছে। তার ছোট ছোট উপন্যাসগুলোতে তিনি কাজের বুয়া, কাজের মেয়ে, আর গ্রামের বোকা ছেলেটির নগরে এসে চটকদার মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্ত পরিবারে নাস্তানাবুদ হবার চিত্রকে হাস্যকর ও কৌতুককরভাবে উপস্থাপন করেছেন। শ্রমিক ও কৃষক চরিত্রগুলোকে তিনি এমন ভাঁড় হিসেবে দেখিয়েছেন যেন এই গরিবদের জন্মই হয়েছে উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্তদের বিনোদন ও মজা লুটার জন্য। অথচ বাঙলার হাজার বছরের কৃষক-শ্রমিক জনগণের বিপ্লবী লড়াকু সংগ্রামকে এই প্রতিক্রিয়াশীল লোকটি চক্ষে দেখেননি। তার লেখার ফলে অর্থবিত্তের আরো মালিক হবার সুযোগ পেয়েছে উচ্চবিত্তরাই।

হুমায়ুন আহমেদের চরিত্রগুলোকে যেসব বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে_ নির্জীব, চিন্তাহীন, মৃদু, অলস, অরাজনৈতিক ইত্যাদি। এর বাইরেও হুমায়ুনের চরিত্রগুলোর প্রধানত সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে উদাসীন ও দায়িত্বজ্ঞানহীন। বাংলাদেশের কিশোর-তরুণেরা যে উদাসীন ও দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে বেড়ে উঠলো তার দায় হুমায়ুন আহমেদ ও ইমদাদুল হক মিলনেরা এড়াতে পারেন না। হুমায়ুন আহমেদ যেই সময়টাতে জনপ্রিয় হচ্ছেন সেই সময়টাতেই দুর্নীতি অন্যায় ও অগণতান্ত্রিকতায় বাংলাদেশ ছেয়ে যাচ্ছে। হুমায়ুন আহমেদের জনপ্রিয়তাকে আমরা ধরতে পারি বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের পচনের সূচক হিসেবে। তিনি যেই পরিমাণে জনপ্রিয় হয়েছেন সেই পরিমাণেই বাংলাদেশের মধ্যবিত্তরা দুর্নীতি অন্যায় ও অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে এবং মধ্যবিত্তের একটা অংশ নিজেদেরকে লুটপাটে জড়িয়ে উচ্চবিত্তে রূপান্তরিত করেছে।

হুমায়ুন আহমেদ সম্পর্কে মশিউল আলমের মুল্যায়ন যথার্থ; মশিউল আলম ফেসবুকে নোট আকারে লিখেছেন,

“তাঁর কোনো রাজনৈতিক বোধ ছিল না, তাঁর মন ছিল অ্যা-পলিটিক্যাল।”[৪]  

তিনি আরো লিখেছেন,  

“হুমায়ুন বাস্তববাদী কাহিনীকারও নন, তাঁর কাহিনিতে যে সমাজের দেখা মেলে, সেই সমাজ বাস্তবে বাংলাদেশে কখনো ছিল না, এখনও নেই। সেই সমাজ বাঙালি মধ্যবিত্তের কল্পনার সমাজ। হিমু, মিসির আলী, ইত্যাদি চরিত্র বাস্তবে পাওয়া যাবে না, পাওয়া যাবে মধ্যবিত্তের কল্পনায়। এগুলো মধ্যবিত্তের ইচ্ছাপূরণকারী চরিত্র। আমাদের মধ্যবিত্ত বাস্তবে যে জীবন যাপন করে, হুমায়ূন যদি সেই ছবিই তাঁর পাঠকের সামনে বাস্তবরূপে হাজির করতেন, তাহলে পাঠক তাঁর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিত, কারণ সেই ছবি সুন্দর নয়। হুমায়ূন জনপ্রিয় হয়েছেন তার উল্টো কাজটি করেছেন বলে।”[৫]   

১৯৭১ সালের পটভূমিতে লেখা একটি গল্পের প্রধান চরিত্রটি সুবিধাবাদী পরজীবী একজন মাষ্টার। অবাস্তব এই গল্পটি একজন মাস্টারের নির্বুবুদ্ধিতাকে ফুটিয়ে তুলছে। থুথু দেবার পরেও তাকে পাকি বাহিনী বাঁচিয়ে রাখবে না, অথচ তাকে হুমায়ূন জোর করে বাঁচিয়ে রাখছে, শুধু রাখছেই না, তাকে পাগল বানাচ্ছে। অথচ তার কথা প্রতিবাদী হবার। এইভাবে সে অবাস্তব গল্পকে বাস্তবের রঙ দিয়েছে।

লেখক শাহাদুজ্জামান বাংলাদেশে চিন্তাশ্রয়ী উপন্যাস, গল্প ও প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি হুমায়ুন আহমেদ সম্পর্কে লিখেছেন যে, 

‘পাঠক প্রিয়তা, ব্যক্তিজীবন ইত্যাদি মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সাহিত্যের একজন কৌতূহলোদ্দীক চরিত্র। অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়সে হুমায়ূন আহমেদের প্রথম পর্যায়ের লেখা নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, নিশিকাব্য ইত্যাদি মনোযোগের সঙ্গে পড়েছি, ভালো লেগেছে। … … … … হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য জনপ্রিয় কিন্তু তার অধিকাংশ লেখাতেই আমার প্রত্যাশিত সেই সাহিত্যিক মর্যাদা নেই।’[৬]

ফলে এই সত্য প্রকাশিত হচ্ছে যে হুমায়ূন আহমেদ কৃষক ও জনগণের শত্রু প্রতিক্রিয়াশীল এক ব্যক্তি যিনি শিল্প মানে সর্বদাই নিচু স্তরের।

গল্পের হুমায়ূন

হুমায়ূন আহমেদের একটা গল্পের নাম হচ্ছে ‘সৌরভ’। এই গল্পের প্রধান চরিত্র একজন চাকরিজীবী মধ্যবিত্তের, যে একজন পরজীবী। এই ক্ষুদে চাকরিজীবী তার মেয়ের সেন্ট মাখার আবদারকে প্রশ্রয় দেয়, শুধু প্রশ্রয় দেয় না, পকেট থেকে টাকা চুরি হয়ে গেলেও বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে মেয়ের জন্য ফরাসী পারফিউম কিনে আনে; অথচ মহান শ্রমজীবী মানুষদের শরীরের ঘামের গন্ধকে মেয়ের কাছে পরিচিত করায় না।

মূলত লোভী পরজীবী ক্রেতা মধ্যবিত্ত তৈরি করতে হুমায়ুনের ভূমিকাটি আমরা দারুচিনি দ্বীপ সিনেমাতেও দেখতে পাব। গরীব ছেলেকে ধনী বন্ধুদের সাথে মিশে সমাজের বাস্তবতাকে অস্বীকার করে দারুচিনি দ্বীপে বা কক্সবাজারে ঘুরতে যাওয়া দেখব সেই সিনেমায়। টিউশনি করে লেখাপড়া চালানো একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত ছেলের প্রমোদ ভ্রমণে বের হওয়ার দৃষ্টান্ত আছে ‘দারুচিনি দ্বীপ’ গল্পে। পরবর্তীকালে এই ভ্রমণগুলোর আভিজাত্যিক নাম হবে  পর্যটনশিল্প যা ভূমিকা রাখবে পরিবেশের ক্ষতি করায়। সন্তানদের ফুটানি মার্কা আবদার পূরণ করার গল্প হচ্ছে ‘দারুচিনি দ্বীপ’ এবং ‘সৌরভ’।

ক্ষয়িষ্ণু জমিদার, যার নাম জমিদার সরকার, তার নষ্টামি, ক্ষমতা দেখানো, নারীর প্রতি লোলুপতা, নিষ্ঠুরতা সবই এই একটা চরিত্রের ভেতর হুমায়ূন আহমেদ দিয়েছেন। বোঝাই যায় হুমায়ূন চন্দ্রকথা চলচ্চিত্রে সামন্তবাদের এসব কাজের বিরোধী, কিন্তু হুমায়ূন বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সমর্থক নন।

বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের অন্যায় সমর্থনের জন্য ‘দারুচিনি দ্বীপ’ এবং ‘সৌরভ’ গল্প দুটিও উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। আমরা যে দায়িত্বহীন অজস্র তরুণ এখন পাচ্ছি তা এই ক্ষুদে মালিকানার সমর্থক প্রতিক্রিয়াশীল হুমায়ুনের কুকীর্তি। আপনাদের মনে থাকতে পারে একটি খবর বেরিয়েছিল এক বছর আগে; ‘নতুন মোটরসাইকেল কিনে না দেয়ায় মা-বাবাকে আগুনে পোড়ালো ছেলে’।[৭]

পুরুষতান্ত্রিক ও সামন্তবাদী হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ুন আহমেদকে তসলিমা নাসরিন বলেছেন পুরুষতন্ত্রের সম্রাট।[৮] সেই কথায় যে সত্যতা আছে তা আমরা পাবো ইমদাদুল হক মিলন ২০১১ সালের ৪ নভেম্বর কালের কণ্ঠের শিলালিপিতে যে স্মৃতিচারণ করেন তাতে। সেখানে দেখা যাচ্ছে হুমায়ুন আহমেদ এক বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠানে গেছেন; সবাই খেতে শুরু করেছে। আর সে ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন ইমদাদুল হক মিলন এভাবে,

“হুমায়ুন ভাই একবার মাত্র সামান্য বিরানি মুখে দিয়েই প্রচণ্ড রেগে গেলেন। হাতের ধাক্কায় প্লেট সরিয়ে প্রিয় মানুষটিকে বললেন, ‘তুমি জানো না আমি ঠাণ্ডা খাবার খাই না’।”[৯]   

মিলন আরো লিখছেন হুমায়ুন রান্না করা মাছ একবার মুখে দিয়েই টের পেতেন রান্নার আগে মাছটি তাজা কি মরা ছিলো। তা উনার সেইটা হয়তো টের পাওয়া সম্ভব!! কিন্তু যারা অভাবের তাড়নায় পচা খাবার ডাস্টবিন থেকে তুলে খায় তাদের জন্য তিনি কী করেছিলেন। আমরা আরো প্রশ্ন করতে পারি উনার খাবারগুলো কে সব সময় গরম করে দিত? এর উত্তরে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মনক্ষুন্ন হলেও চরম সত্য এটিই যে হুমায়ুনের আগের স্ত্রী গুলতেকিনই তার খাবার সর্বদা গরম করে দিত এবং তাকে সময়ে অসময়ে খাবার গরম করে খাইয়েছে।

পুরুষতন্ত্র গত ছয় হাজার বছর ধরেই নারীকে শোষণ করছে। হুমায়ুন শুধু সেই পুরুষতন্ত্রের সম্রাট ছিলেন তাই নয়; তিনি বাংলাদেশের সেই লুটপাটের অর্থনীতির লাঠিয়াল ছিলেন যে অর্থনীতি গত ৪০ বছরে ফুলে-ফেঁপে উঠে এখন সমস্ত কৃষক-শ্রমিককে শ্রমদাসে রূপান্তর করেছে।

হুমায়ন আহমেদ যে পুরুষতান্ত্রিক সামন্তীয় এক প্রতিক্রিয়াশীল লাটসাহেব তা বহুবিধ উপায়ে ফুটে উঠেছে। প্রথমত, তিনি সামন্তীয় লাট সাহেবদের মতো বিলাসি। হুমায়ুনের মারা যাবার পরে আতিক রহমান পূর্ণিয়া গুলতেকিনের যে সাক্ষাতকার নেন, তাতেও দেখা যাবে হুমায়ূন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন বাসায় জমিদারের ন্যায় গানের আসর বসাতেন, আর গুলতেকিনের কাজ ছিল হুমায়ূন পূজারিদের জন্য মজার খাবার তৈরি করে সরবরাহ করা।[১০] তার লেখা বইয়ের বিভিন্ন নামে বিলাস শব্দটিরও বহুল ব্যবহার আছে।

আশির দশকে বৃহৎ মালিকানার বৃদ্ধি

হুমায়ুন আহমেদ যেই সময়ে জনপ্রিয় হচ্ছেন সেই সময়ের অর্থনীতির দিকে একটু তাকান। সেই সময়েই ব্যক্তিখাতের অর্থনীতির বিস্তৃতি ঘটছে শনৈ শনৈ গতিতে। দেশের জাতীয় অর্থনীতির টাকা লুটপাট করে গড়ে উঠছে ব্যক্তিখাতের বিশাল পুঁজি যা আজকে দেশের সমস্ত কৃষক-শ্রমিককে বন্দি করে শ্রমদাস হিসেবে কাজ করিয়ে নিচ্ছে। সেই সময় যে পুঁজি গড়ে উঠে তাই আজকে মহীরূহ আকার ধারণ করেছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে তখন থেকে সচেতনভাবে দূর্বল করে দেয়া হয়েছে।

আশি ও নব্বইয়ের দশকে একদিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হাসপাতালগুলো ধ্বংস হয় আর অন্যদিকে চিকিৎসাক্ষেত্রে ল্যাবএইড, পপুলার, স্কয়ার, বেক্সিমকো গড়ে উঠে; শিক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পেছনে পড়ে যায়, সামনে আসে নর্থ-সাউথ, ব্র্যাকসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়; যোগাযোগে সরকারি রেল পেছনে পড়ে যায়, সামনে আসে এস আলম, হানিফ, সৌদিয়া বাস প্রভৃতি; কৃষিতে দেশি বীজ বিলুপ্ত করে দিয়ে আসে ব্র্যাক, প্রশিকাসহ হাইব্রিড বীজের ব্যবসায়ীরা। একইভাবে আসে খাদ্যে বিডিফুড, ফ্রেশফুড, তীর, রুচি; বস্ত্রে প্রাইড, ড্যান্ডি, আড়ং; বাসস্থানে আমিন মোহাম্মদ, বসুন্ধরা; ব্যাংক ব্যবসায় গ্রামীণ ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইসলামি ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকগুলো, বিদ্যুতে সামিট গ্রুপ, প্রকাশনায় অন্যপ্রকাশ, দিব্যপ্রকাশ, আগামী, সময়।

আমাদের বর্ণনার বিশ শতকের শেষ দুই দশকের বাংলাদেশের পুরো অর্থনীতিটাই লুটপাটের অর্থনীতি। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় খাতের পরাজয় এবং হুমায়ুন আহমদদের বিজয় একই সুত্রে গাঁথা। এমনকি যে বাকের ভাই হুমায়ুনের কল্যাণে জনপ্রিয় হয়ে রাজনীতিতে নাম লিখাইয়া সংসদ ভবনে বসে এখন কোটি টাকার গাড়ি হাঁকান এবং যে হুমায়ুন গাজীপুরে রাজপ্রাসাদ তৈরি করেছিলেন এবং সেইখানে চাঁদের আলোয় অবগাহন করেছেন তারা সেই সমাজের প্রতিনিধি যারা চাঁদের আলো দেখে কিন্তু খরা দেখে না; বর্ষা দেখে কিন্তু বন্যা বা ‘শহরে বৃষ্টি মানে শুধু কাদাজল নোংরা’ দেখে না। এই পুরো লুটপাটের অর্থনীতির বাইপ্রোডাক্ট বাংলাদেশে হুমায়ুন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, তসলিমা নাসরিন, আনিসুল হক, সুমন্ত আসলামেরা।

হুমায়ূন আহমেদের প্রতিক্রিয়াশীলতা

বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল ভিত্তিটা হচ্ছে কৃষকের জমির মালিকানা অর্জন। এই বিষয়ে চন্দ্রকথা সিনেমায় কোনো নির্দেশনা নেই। অথচ ইতিহাস দেখাচ্ছে ‘টঙ্ক ও তেভাগা আন্দোলন’। এই সিনেমাটিতেও হুমায়ূন সামন্তবাদের সংস্কার চান, কৃষি বিপ্লব চান না। কৃষকের সাথে প্রভুর মূল দ্বন্দ্বটিকে হুমায়ূন দেখতে ব্যর্থ হয়ে ছোটখাট দ্বন্দ্বগুলাকে সামনে আনছেন।

হুমায়ূন আহমেদ শ্রমিকশ্রেণিকে নেতা ও অগ্রগামি মনে করেন না। তিনি মুনাফাবিহিন একটি সমাজের কথা ভাবতে পারেন না, উৎপাদিত দ্রব্য যে মানুষের ভোগের জন্য, এটা যে মুনাফা ছাড়াও লেনদেন হতে পারে তা মানেন না। হুমায়ূন কৃষকের লড়াকু রূপটি দেখেন না, কৃষককে তিনি যেভাবে উপস্থাপন করেন তা কৃষকদের বিদ্রোহী লড়াকু মনোভাবকে তুলে ধরে না।

বাংলা অঞ্চলের বড় সংগ্রামগুলোকে তিনি কীভাবে দেখেছেন? অষ্টাদশ ও উনিশ শতকের বুর্জোয়া ব্যবস্থা জন্ম দিতেও প্রয়োজন হয়েছিল শোর্যের, প্রয়োজন হয়েছিল দাঁতোঁ এবং রোবসপিয়েরের। হুমায়ূন গণতন্ত্রবিরোধী সামন্তবাদী লাটসাহেব। শ্রাবণ মেঘের দিন চলচ্চিত্রে যেমন গ্রামীণ ভূস্বামীকে ‘৭১ সালের কৃতকর্মের জন্য মাফ চাওয়াতে দেখি, তেমনি আবার সেই সিনেমাতেই দেখি ডাক্তার মেয়েটির সামনে কৃষক সাষ্টাঙ্গে লুটিয়ে পড়ে; যা সামন্তবাদী, বিজ্ঞানকে ব্যাখ্যার চেষ্টা নেই। আবার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক চোখ গোটা বিশ্ব ঘুরে প্রকৃতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের যে জ্ঞান সংগ্রহ করেছে, সেগুলার কতটুকুর সাথে হুমায়ুনের পরিচয় ছিলো? আমার তো মনে হয় হুমায়ূন এক্ষেত্রে ব্যর্থই।

হুমায়ূন চলতি ব্যবস্থা মেনে নেয়া মানুষ, এখন এরকম মানুষ যদি ভিত্তি বদলানোর লড়াইয়ে না থাকেন তবে তাঁকে মূল্যায়নে কীভাবে এগোনো যায়, হয়ত কিছু জায়গায় তাকে সামন্তবাদবিরোধী হিসেবে পাব, কিন্তু তাতেই কি গণতান্ত্রিক বলা যাবে? রবীন্দ্রনাথ কৃষকদের জন্য ব্যথিত কিন্তু তিনি গণতান্ত্রিক বিপ্লবের বিরোধী, তাহলে? তারা যেটুকু এগোতে পারেন, সেটুকু শুধু সংস্কার করতে চান বলেই। রবীন্দ্রনাথের মতোই হুমায়ূনও অভিজাততন্ত্রের সমর্থক, এবং নুহাশ পল্লী নামে যে বাড়িটা তিনি বানাবেন, সেটিও জমিদারী রীতিকে অনুসরণ করেই বানানো।

তথ্যসূত্র ও টীকা:    

১. গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা বাংলাদেশে বামপন্থিদের একটি জোট। বিবৃতিতে ছিলো ‘তাঁর অকাল মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্য ও শিল্পচর্চার অপূরণীয় ক্ষতি হলো’। লিংক- http://www.unmochon.com/2012/07/21/11709.html#.UaY73tiQyda
২. বদরুদ্দীন উমর, ২১ জুলাই, ২০১২, উন্মোচন ডট কম, তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আমি বরাবরই বলে এসেছি শরৎচন্দ্রের পর বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয়তম ‘কথক’ হচ্ছেন হুমায়ুন আহমেদ। এরপর আর হয়নি। অথচ আমরা উপরে দেখিয়েছি আরো অনেক গল্প বলিয়ে লেখক ছিলেন। এখনো ১৯৪০-১৯৮০ সাল পর্যন্ত তাদেরই প্রতাপ ছিলো। লিংক- http://www.unmochon.com/2012/07/21/11603.html#.UaY9G9iQydY  ৩. আনু মুহাম্মদ, ফেসবুক পোস্ট, ২৪ জুলাই, ২০১২, ফেসবুক পোস্টের লিংক https://www.facebook.com/permalink.php?story_fbid=413194055393449&id=143716985674492
৪. মশিউল আলম, ২৪ জুলাই, ২০১২, ফেসবুকে প্রকাশিত মশিউল আলমের নোট, নোটের লিংক- https://www.facebook.com/notes/10150929564130978/
৫. পূর্বোক্ত,
৬. শাহাদুজ্জামান, দূরগামী কথার ভেতর: সংকলন। তাঁর সাক্ষাৎকারেও এই বিষয়টি ফুটে উঠেছে। শাহাদুজ্জামান ৪ জুলাই, ২০১২ এক সাক্ষাৎকারে উক্ত কথা বলেন। সাক্ষাতকারটি পড়ুন এই লিংক থেকে।  
৭. স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬, “নতুন মোটরসাইকেল কিনে না দেয়ায় মা-বাবাকে আগুনে পোড়ালো ছেলে”, https://www.banglanews24.com/national/news/bd/518337.details  
৮. তসলিমা নাসরিন, ১৫ ই আগস্ট, ২০১২, সামহয়্যারইনব্লগ ডট নেট। তসলিমা আরো লিখেছেন ‘যাদের এক সময় পায়ে ঠেলে দিয়েছিলে তুমি, তারাই এখন তোমার পায়ের কাছে এসে কাঁদছে। কারণ তুমি পুরুষ, তুমি ধনী, তুমি জনপ্রিয়, তুমি রাজা, তুমি বাদশাহ, তুমি সম্রাট, তোমার সাত খুন মাফ।’ লেখার লিংক-http://www.somewhereinblog.net/blog/G_M_MONOWAR/29657766 
৯. দৈনিক কালের কণ্ঠ; ৪ নভেম্বর, ২০১১। সাহিত্য সাময়িকী শিলালিপি, পৃষ্ঠা, ৬-৭।  
১০. আতিক রহমান পূর্ণিয়া, জুলাই ২০, ২০১৬, সে আমাকে খুব আন্ডারএস্টিমেইট করত, http://www.poriborton.news, সাক্ষাতকারটি সম্পর্কে আতিক রহমান পুর্ণিয়ার ইউটিউবে মন্তব্য দেখুন এই লিংক থেকে।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: যদিও লেখাটির রচনাকাল জুলাই-আগস্ট, ২০১২, কিন্তু লেখাটিকে বিভিন্ন সময়ে উন্নত করা হয়েছে।

আরো পড়ুন:  ল্যেভ আব্রামোভিচ লিয়েনতিয়েভ ছিলেন রুশ অর্থনীতিবিদ

3 thoughts on “হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশে বিরাজিত লুটপাটের অর্থনীতির লাঠিয়াল”

  1. শনৈ শনৈ কথাটির অর্থ ধীরে ধীরে। এখানে শব্দটির ব‍্যবহার দেখে মনে হলো, লেখক দ্রূতগতি অর্থে ব‍্যবহার করেছেন; আমার মনে হওয়া ভূলও হতে পারে!

    Reply
  2. কোনো এক সময় হুমায়ুন স্যারের লেখা ভালো লাগতো… কিন্তু আপনার মতো Out of Box চিন্তা করে দেখলাম এতো দিন আমি অন্ধের রাজ্যে ছিলাম। এমন লেখা আরো আশা করি যেগুলো আমাদের মতো তরুণদের নৈতিকতা-মূল্যবোধ সৃষ্টি এবং বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। ধন্যবাদ দিয়ে আপনার উপকারের পরিধি সংকীর্ণ করতে চাই না।

    Reply

Leave a Comment

error: Content is protected !!