ইবনে খালদুন আরব সভ্যতার সমাজতাত্ত্বিক এবং ইতিহাসের দার্শনিক

আরব সভ্যতার ঐতিহাসিক, সমাজতাত্ত্বিক এবং ইতিহাসের দার্শনিক হিসাবে ইবনে খালদুন-(ইংরেজি: Ibn Khaldun; ২৭ মে ১৩৩২ – ১৭ মার্চ ১৪০৬ খ্রি.) এর নাম সুবিখ্যাত। উত্তর আফ্রিকার তিউনিসে তাঁর জন্ম। তাঁর শিক্ষাগত ও রাজনৈতিক জীবনের বিচিত্র কর্মকান্ডের কেন্দ্র প্রধানত উত্তর আফ্রিকা। মাত্র বিশ বছর বয়সে দেশের সুলতানের অধীনে গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি নিযুক্ত হন। তারপর কখনো সুলতানের কর্মসচিব, কখনো সুলতানের কাজি, কখনো রাষ্ট্রদূত হিসেবে বিচিত্র দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন।

ইবনে খালদুনের জীবনে উত্থান পতন কম ছিল না। সুলতানের বিরাগভাজন হওয়াতে দুবার তিনি কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। মঙ্গোল বাদশাহ তৈমুর লঙ এর দিগ্বিজয়ের অভিযানে সিরিয়া আক্রান্ত হলে মিসরের সুলতানের সঙ্গে যে যুদ্ধ ঘটে তাতে তৈমুর লঙ এর বাহিনীর হাতে ইবনে খালদুন বন্দী হন। তাঁকে তৈমুর লঙ এর দরবারে হাজির করা হয়। তৈমুর লঙ তাঁর পান্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে মুক্তি দিয়ে মিসরে প্রেরণ করেন। ইবনু খালদুন কায়রোর আল আজহার মসজিদের শিক্ষাকেন্দ্রের অধ্যাপকও নিযুক্ত হয়েছিলেন। কায়রোতেই তাঁর মৃত্যু ঘটে।

আত্মজীবনী ব্যতীত ইবনে খালদুন এর প্রধান এবং সুবিপুল ইতিহাস সম্পর্কিত গ্রন্থের নাম হচ্ছে ‘কিতাব উল ইবার ওয়া দেওয়ান উল মুরতাদা ওয়া আল খবর ফি আয়াম উল আরব ওয়া আল আজম ওয়া আল বারবার’। এই গ্রন্থে ইতিহাসের বিবরণগত অংশে লেখক প্রথমে আরব এবং তার প্রতিবেশী জাতিসমূহের ইতিহাস এবং তারপরে বারবার ও উত্তর আফ্রিকার রাষ্ট্রসমূহের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। কিন্তু এই বিবরণের পূর্বে তিনি ইতিহাস পাঠের তত্ত্বগত যে ভূমিকা বা ‘মুকাদ্দিমা’ রচনা করেন তা ইতিহাস তত্ত্বে এক আশ্চর্য অমর অবদান বলে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে।

মুকাদ্দিমার মধ্যে ইবনে খালদুন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বন্ধনের মূল কি এবং কোনো স্থান বা রাষ্ট্রের অধিবাসীর চরিত্র তাদের চারিপাশের জলবায়ু ও জীবিকার্জনের উপায় দ্বারা কিভাবে প্রভাবিত ও গঠিত হয় এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় বিধি বিধানে কিভাবে পরিবর্তন সংঘটিত হয় তার মৌলিক ও বিশ্লেষণমূলক আলোচনা পেশ করেন। সমাজ ও ইতিহাসের ক্ষেত্রে এরূপ বস্তুবাদী বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং আলোচনা জ্ঞানের ইতিহাসে এই প্রথম। এ কারণে ইবনে খালদুন সমাজতত্ত্ব ও ইতিহাসের দর্শনের অবিসংবাদী জনক বলে স্বীকৃতি লাভ করেন।

আরো পড়ুন:  রবার্ট ফিলমার ছিলেন সপ্তদশ শতকের ইংল্যাণ্ডের একজন রাষ্ট্রচিন্তাবিদ

ইবনে খালদুনের বিবরণ আরব দেশসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ইতিহাসকে বিজ্ঞান হিসাবে তিনিই প্রথম প্রমাণ করেন। আধুনিক পাশ্চাত্য জগতের অন্যতম ইতিহাসকার আর্নল্ট টয়েনবি তাঁর সুবিখ্যাত ‘স্টাডি অব হিস্টরি’ গ্রন্থে ইবনে খালদুনের মূল্যায়ণ করে বলেছেন, ‘খালদুনের ইতিহাসের দর্শন জ্ঞানের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত অনতিক্রান্ত সৃষ্টির মর্যাদায় মহিমান্বিত’। জর্জ সারটন তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘ইনট্রোডাকশন টু দ্য হিস্টরি অব সায়েন্স’ গ্রন্থে এরূপ উল্লেখ করেছেন যে, কেবলমাত্র মধ্যযুগেরই নয়, প্রাচীন ঐতিহাসিকগণের পর ম্যাকিয়াভেলি পর্যন্ত ইতিহাসের তত্ত্ব ও মানুষের অভিজ্ঞতার দর্শনের ক্ষেত্রে ইবনে খালদুনের সমকক্ষ অপর কেউ জন্মগ্রহণ করেন নি।

ইউরোপীয় ইতিহাসের মধ্যযুগের এক পর্বে আরবী ভাষার রচনাবলী ল্যাটিন ভাষায় অনুদিত হওয়ার মরসুম শুরু হয়েছিল। এই সময়ে অনুবাদের মাধ্যমে ইউরোপ আরবী সভ্যতার মহৎ সৃষ্টি এবং প্রাচীন গ্রিসের দর্শনের পরিচয় লাভ করে। ইবনে খালদুনের জন্ম অনুবাদের এই মরসুমের পরে ঘটায় ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ইবনে খালদুনের আরবি রচনাবলি ও তাঁর উৎকর্ষ ইউরোপে ছিল অপরিচিত। ১৮৬২-৬৮ সালের দিকে ফরাসি দেশে ফরাসি ভাষায় সর্বপ্রথম তাঁর ঐতিহাসিক গ্রন্থের অনুবাদ হয়। ইংরেজি অনুবাদ ঘটে মাত্র অতি সাম্প্রতিককালে ১৯৫৮ সালে।

তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২০৪-২০৫।

Leave a Comment

error: Content is protected !!