আইসোক্রাটিস (ইংরেজি: Isocrates, ৪৩৬-৪৩৮ খৃ.পূর্ব) ছিলেন প্লেটোর সমকালীন বিখ্যাত চিন্তাবিদ ও শিক্ষক। বাগ্মী হিসাবে আইসোক্রাটিসকে এথেন্সের দশজন বাগ্মীর একজন বলে গণ্য করা হতো। অর্থবান পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও পিলোপশানীয় যুদ্ধে আইসোক্রাটিস এর পরিবার বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। যুদ্ধের পরে আইসোক্রাটিস শিক্ষকতাকে প্রধান পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন। শিক্ষক হিসাবে তিনি এরূপ প্রতিষ্ঠা লাভ করেন যে তাঁর নিজের ছাত্রসংখ্যা একসময় ১০০ তে উন্নীত হয়েছিল। এই ছাত্রগণ চার বছর তাঁর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করত এবং তাদের শিক্ষার দেয় ছিল ছাত্রপতি দশমিনা।
শিক্ষকতা পেশাতেই আইসোক্রাটিস এত বেশি অর্থ উপার্জন করেন যে তাকে এথেন্স এর সবচেয়ে অর্থবান নাগরিকদের মধ্যে একজন বলে গণ্য করা হতো। কিন্তু গ্রীক দর্শনের ইতিহাসে শিক্ষকদের সম্পর্কে সফিস্ট বলে যে আখ্যা প্রচলিত আছে, আইসোক্রাটিস নিজেকে তাদের মধ্যে গণ্য করতে চাইতেন না। এজন্য ‘সফিস্টদের বিরুদ্ধে’ এই নামে তিনি একটি প্রচার পুস্তিকাও রচনা করেন। এই পুস্তিকায় আইসোক্রাটিস খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের সফিস্টদের শিক্ষানীতি ও দর্শন থেকে তাঁর নিজের শিক্ষানীতি ও দর্শন যে পৃথক তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। তাঁর এই পুস্তিকায় তিনি সফিস্টদের বৈশিষ্ট্য হিসাবে কূটতর্কের কৌশল শিক্ষাদানকে উল্লেখ করেন। সফিস্টদের বিরুদ্ধে একটি মনোভাব তৈরি এবং সফিস্টগণ প্রশংসা বা শ্রদ্ধার পাত্র নয় এরূপ আবহাওয়া সৃষ্টিতে আইসোক্রাটিস এর পুস্তিকার বিশেষ প্রভাব ছিল।
আইসোক্রাটিসের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাপীঠ পঞ্চাশ বছরের অধিককালে স্থায়ী ছিল। আইসোক্রাটিস জীবন ও জগতের বিভিন্ন প্রশ্নে তাঁর নিজস্ব একটি দর্শন দাঁড় করার চেষ্টা করেন। এদিক দিয়ে সক্রেটিস এবং প্লেটোর সঙ্গে আইসোক্রাটিস এর একটি সাদৃশ্য আছে। কিন্তু সক্রেটিসের দর্শন এবং আইসোক্রাটিসের দর্শনের মধ্যে পার্থক্যও উল্লেখযোগ্য। সক্রেটিস যেখানে সাধারণ অভিমতকে সত্য লাভের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম বলে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছেন এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের উপর জোর দিয়েছেন সেখানে আইসোক্রাটিস বিজ্ঞানের চেয়ে দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ অভিমতকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন। আইসোক্রাটিস বলতেন অকেজো ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক নিশ্চিত সত্যের চেয়ে কাজের ব্যাপারে সম্ভাব্য সত্যের মূল্য অত্যধিক।
শিক্ষার ক্ষেত্রেও আইসোক্রাটিস প্লেটোর চেয়ে ভিন্নমত পোষণ করতেন। শিক্ষাক্ষেত্রে প্লেটো অঙ্কশাস্ত্র এবং বিজ্ঞানের উপর জোর দিতেন। কিন্তু আইসোক্রাটিস মনে করতেন, রাষ্ট্রনীতিক বিষয়ে সঠিক অভিমত পোষণ করা এবং তাকে সঠিকভাবে প্রকাশ করার দক্ষতা শিক্ষাদানই হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থার মূল করণীয়। আর তাই আইসোক্রাটিস এর দর্শন রাষ্ট্রীয় জীবনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের জন্য রাজনীতিক প্রশ্নে উপযুক্ত অভিমত পোষণ এবং বাগ্মীতার সঙ্গে তার সুকৌশল প্রকাশের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৪২।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।