জাঁ জ্যাক রুশো ফরাসি বিপ্লবের তাত্ত্বিক এক পুঁজিবাদী দার্শনিক, লেখক ও সুরকার

জাঁ জ্যাক রুশো বা জঁ-জাক রুসো (ইংরেজি: Jean Jacques Rousseau) (১৭১২-১৭৭৮ খ্রি.) অষ্টাদশ শতকের ফরাসি বিপ্লবে পুঁজিবাদী পথিকৃৎদের অন্যতম তাত্ত্বিক ব্যক্তিত্ব, যিনি একাধারে দার্শনিক, লেখক এবং সুরকার ছিলেন। দার্শনিক, সমাজতত্ত্ববিদ, সৌন্দর্যতত্ত্ববিদ এবং শিক্ষণের ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক হিসাবে রুশো তাঁর জীবৎকালেই প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে একদল বিশ্বকোষিক সংঘবদ্ধভাবে সামন্তবাদ, কুসংস্কার এবং প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে পুঁজিবাদী স্বাধীনতার চর্চা করেন। এঁদের মধ্যে দিদেরো, ডি এ্যালেদার্ট, মন্টেস্কু, ভলটেয়ার, হেলভেটিয়াস এবং হলকের সঙ্গে রুশোর নামও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁদের রচনাবলী ভাবগতভাবে ফরাসি বিপ্লবের পথ উন্মুক্ত করে দেয়।

রুশো জন্ম গ্রহণ করেন সুইজারল্যাণ্ডের জেনেভা শহরে। তার পিতা ছিলেন একজন দরিদ্র ঘড়ি নির্মাতা। ১৭৪২ সনে রুশো ৩০ বৎসর বয়সে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস গমন করেন। নিজের জীবনধারণের জন্য শৈশবকাল থেকে রুশো বিচিত্র জীবিকা অবলম্বন করেন। এভাবে তিনি জীবনে বিপুল অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হন। প্যারিসে আসার পরে দিন একাডেমী ঘোষিত একটি রচনা প্রতিযোগিতার প্রতি রুশোর দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় (১৭৪৯)। একাডেমী ঘোষিত প্রতিযোগিতার বিষয় ছিল বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং শিল্প কি মানুষের জীবনকে উন্নত করেছে, না তাকে অধিকতর কলুষময় করেছে? রুশো এই প্রতিযোগিতার জন্য একটি প্রবন্ধ পেশ করেন। তার এই প্রবন্ধ একাডেমী কর্তৃক সর্বোত্তম বিবেচিত হয় এবং তাঁকে প্রথম পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হয়। তাঁর এই রচনাতেই রুশোর রাষ্ট্র এবং সমাজদর্শনের মূল দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায়। প্রচলিত চিন্তাধারার বিরুদ্ধতা করে রুশো তার এই প্রবন্ধেই দেখাতে চেষ্টা করেন যে, তথাকথিত সভ্যতার পূর্ব-যুগেই মানুষ অধিকতর স্বাভাবিক এবং যথার্থ মানুষ ছিল। সভ্য মানুষের শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, তার অন্তরের পরশ্রীকাতরতা, সন্দেহ, ভয়, হৃদয়হীনতা, আত্মম্ভরিতা, ঘৃণা এবং প্রতারণাকে আড়াল করে রাখার আচ্ছাদন বৈ আর কিছু নয়।

রুশোর মতে ইতিহাসে সভ্যতা যত অগ্রসর হয়েছে মানুষের জীবন তত কৃত্রিম এবং জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সভ্যতার পূর্বেই মানুষ সহজ ও স্বাভাবিক ছিল। তিনি লিখেছেন যে, “মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে মূলত ভালো। যা হোক, এই প্রাকৃতিক নিষ্কলুষতা সমাজের মন্দ দ্বারা দূষিত হয়।” রুশোর এই অভিমতের অধিকতর যুক্তিসহ সুবিস্তারিত প্রকাশ ঘটে তার ১৭৬২ সনে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘দি সোস্যাল কন্ট্রাক্ট’ বা ‘সামাজিক চুক্তি’র মধ্যে।

জন লক এবং টমাস হবস-এর ন্যায় রুশোও এই অভিমত পোষণ করেছেন যে, রাষ্ট্রের সংগঠনের পূর্বে মানুষ একটা প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস করত। এই প্রাকৃতিক পরিবেশ বা অবস্থা সম্পর্কে হবস মনে করতেন যে, প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষ সর্বক্ষণ আত্মঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। কারণ মানুষ প্রধানত আত্মকেন্দ্রিক, আত্মসুখান্বেষী এবং পরদ্বেষী। কিন্তু আত্মঘাতী সংঘর্ষের চরম অবস্থা মানুষের মনে এই চেতনার সৃষ্টি করেছিল যে, কোনো শাসক বা শক্তির কাছে নিজেদের ব্যক্তিগত অধিকার সমর্পণ করে শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং শাসকের বিধান মতো জীবন-যাপন না করলে ব্যক্তির পক্ষে নিরাপদ জীবন-যাপন সম্ভব নয়। এই চেতনা থেকে মানুষ একসঙ্গে চুক্তির মারফত শাসক সৃষ্টি করে নিয়মবদ্ধ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে।

হবসের মতো রুশোও একথা স্বীকার করেন যে, মানুষ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু প্রাকৃতিক অবস্থার রূপ এবং চুক্তির প্রকার সম্পর্কে রুশো হবস থেকে পৃথক মত পোষণ করেন। রুশোর মতে, মানুষের চরিত্র মূলত স্বার্থপর নয়। প্রাকৃতিক অবস্থাতে মানুষ পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল জীবই ছিল। অপরের প্রতি সহানুভূতিবোধ করা মানুষেরই বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তার এই বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে। লকের মতোই একদিকে যেমন রুশো প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষের চরিত্রকে একেবারে আদর্শ হিসাবে কল্পনা করেন নি, তেমনি হবস-এর ন্যায় তিনি মানুষকে অধমও ভাবেন নি।

রুশোর মতে মানুষ প্রাকৃতিক অবস্থায় সাধারণ ও স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে চাইত। কিন্তু একটা পর্যায়ে সে দেখতে পেল যে, ব্যক্তির একার পক্ষে অপরের সঙ্গে সংযোগহীনভাবে প্রতিকূল শক্তির বিরুদ্ধে নিরাপদ জীবন-যাপন করা এবং নিজের অধিকারসমূহ প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। এই বোধ থেকে মানুষ চুক্তি করে রাষ্ট্র অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় নিয়ম-কানুন, বিধি-নিষেধের সৃষ্টি করেছিল।

রুশোর সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব

রুশোর রাষ্ট্র-তত্ত্বমূলক বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সোস্যাল কণ্ট্রাক্ট’ বা ‘সমাজ চুক্তি’ কিংবা ‘সামাজিক চুক্তি’র একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয় হচ্ছে ‘জেনারেল উইল’ বা ‘সাধারণ ইচ্ছা’।[২] রুশোর মতে সামাজিক চুক্তি সে অপর কোনো শাসক বা অধিনায়কের সঙ্গে করে নি কিংবা চুক্তি মারফত কোনো নিরঙ্কুশ একচ্ছত্র শাসককে সে তৈরি করে নি। ব্যক্তি চুক্তি করেছে ব্যক্তির সঙ্গে অর্থাৎ প্রত্যেকে প্রত্যেকের সঙ্গে। চুক্তির মূলকথা হচ্ছে, একে অপরের অধিকারে হস্তক্ষেপ করবে না। এমনিভাবে প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের (নিজের সঙ্গে নিজের) চুক্তিতে সৃষ্ট হয়েছে এক সাধারণ ইচ্ছা বা সাধারণ শক্তি। এই সাধারণ ইচ্ছাই রাষ্ট্রীয় জীবনে মানুষের নিয়ামক। এ ইচ্ছা কোনো ব্যক্তিরই যথার্থ স্বার্থের বৈরী নয়। প্রত্যেকের ইচ্ছা দিয়ে এর সৃষ্টি বলে কোনো ব্যক্তির পক্ষেই যেমন এই সাধারণ ইচ্ছাকে জবরদস্তি মনে করা চলে না—তেমনি এই সাধারণ ইচ্ছা ব্যক্তির যথার্থ স্বার্থের বিরোধী কোনো নিয়ম বা নিষেধ আকারেও প্রকাশিত হতে পারে না।

রুশোর মতে, সামাজিক চুক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজের একটা পর্যায়ে অর্থাৎ প্রাকৃতিক জীবনে মানুষ যে স্বাধিকার ভোগ করত, সভ্যতার পর্যায়েও যৌথ-সম্মতির ভিত্তিতে মানুষ যেন নিরাপদভাবে সেই অধিকার ভোগ করতে পারে তার ব্যবস্থা করা। হবস এবং রুশোর চুক্তির মধ্যে একটা সাদৃশ্য এই যে, উভয় ক্ষেত্রে মানুষ তার চুক্তি-পূর্ব ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে সর্বতোভাবে অপর এক শক্তির কাছে সমর্পণ করে দিচ্ছে। কিন্তু হবস-এর তত্ত্বে ব্যক্তি যেখানে একচ্ছত্র শাসকের নিকট শর্তহীনভাবে তার স্বাধীনতাকে ত্যাগ করেছে সেখানে রুশোর ব্যাখ্যায় ব্যক্তির আত্মসমর্পণ কোনো শাসকের কাছে নয়; এ আত্মসমর্পণ পরস্পরের কাছে। এখানে শাসকের কাছে অধিকার ত্যাগ করে ব্যক্তি কি লাভ করবে? শান্তি? রুশোর মতে শৃঙ্খলিত বন্দিও তো বন্দিশালায় নিরাপদ শান্তি লাভ করতে পারে কিন্তু তাই বলে সে শান্তি কি মানুষের কাম্য হতে পারে? কাজেই সামাজিক চুক্তি ব্যক্তির অধিকার বিনষ্টির জন্য নয়, তা রক্ষার জন্য। রুশোর মতে, মানুষ পারস্পরিকভাবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে এই চেতনা থেকে যে এককভাবে তার অধিকার ভোগ করা সম্ভব নয়। এই চেতনা থেকে সকলে সকলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এ চুক্তির মাধ্যমে ব্যক্তি তার কোনো যথার্থ স্বার্থ থেকে বঞ্চিত হয় নি। কারণ চুক্তিবদ্ধ এক ব্যক্তি এমন কোনো অধিকার অপর ব্যক্তিকে অর্পণ করে দিচ্ছে না যার পরিবর্তে ঠিক সেই অধিকারই সে অপরের নিকট থেকেও লাভ করছে না।

দর্শনের ক্ষেত্রে রুশো ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং আত্মার অমরতা উভয়কেই স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু আবার বস্তুকেও তিনি শাশ্বত বলেছেন। সমাজতাত্ত্বিক হিসাবে রুশো সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার তীব্র সমালোচক ছিলেন। সামন্তবাদের শোষণ ও শ্রেণীবিন্যাসের উচ্ছেদ করে সকল মানুষের সমান অধিকারের ভিত্তিতে নতুন যে বিপ্লবীচেতনা দেশের ধনিক শ্রেণী ও কৃষক সমাজের মধ্যে বিস্তার লাভ করছিল বুর্জোয়া বিপ্লবের সে চিন্তাধারাকে রুশো সমর্থন করেছিলেন। সমাজের অসাম্য ও অবিচারের মূল ব্যক্তিগত সম্পত্তির অস্তিত্বকে প্রধান হিসাবে চিহ্নিত করলেও রুশো ব্যক্তির জন্য অল্প পরিমাণ ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষার মতও পোষণ করতেন। শিক্ষার প্রশ্নেও রুশো প্রগতিশীল অভিমত পোষণ করতেন। তাঁর মতে সামন্তবাদী শ্রেণীভিত্তিক শিক্ষার পরিবর্তে এমন এক শিক্ষার প্রবর্তন করতে হবে যে শিক্ষা সকল নাগরিককে শ্রমের মার্যাদায় উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হবে।

রুশোর বিপ্লবী চিন্তায় ফরাসি সরকার এবং সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল-শক্তিসমূহ রুষ্ট হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রীয় নিগ্রহের আশঙ্কায় তিনি এক সময় ফ্রান্স পরিত্যাগ করেন। কিন্তু ১৭৬৬ খ্রিষ্টাব্দে বার্ন প্রজাতন্ত্র তাঁকে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করায় তিনি ইংরেজ দার্শনিক হিউমের আমন্ত্রণে ইংল্যাণ্ড গমন করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে হিউমের সঙ্গে তার মতদ্বৈধ উপস্থিত হয় এবং তিনি ফ্রান্সেই প্রত্যাবর্তন করেন।[২]

রুশোর রচনাবলীর মধ্যে ‘দি সোস্যাল কন্ট্রাক্ট’ বা সামাজিক চুক্তি ব্যতীত তাঁর ‘কনফেশনস’ বা আত্মচরিত এবং দিদেরোর সম্পাদনায় প্রকাশিত ফরাসি বিশ্বকোষে প্রকাশিত ‘ডিসকোর্স অন পলিটিক্যাল ইকনমি’ এবং ‘এমিলি’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

তথ্যসূত্র:

১. অনুপ সাদি, ২৭ মে ২০১৮, “জাঁ জ্যাক রুশো ফরাসি বিপ্লবের তাত্ত্বিক এক পুঁজিবাদী দার্শনিক”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/jean-jacques-rousseau/
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ৩৪০-৩৪২

রচনাকাল ২৭ মে ২০১৮, মোহাম্মদপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!