ইয়োহান গটলিব ফিকটে ছিলেন জার্মান ভাববাদী দার্শনিক

ইয়োহান গটলিব ফিকটে (ইংরেজি: Johann Gottlieb Fichte; ১৯ মে, ১৭৬২ – ২৭ জানুয়ারি, ১৮১৪) ছিলেন জার্মান ভাববাদী দার্শনিক। জার্মান ভাববাদী দর্শনে কাণ্টের পরেই ফিকটের স্থান। দরিদ্র ঘরের সন্তান ফিকটে কিশোর বয়স থেকেই অসাধারণ বুদ্ধির পরিচয় দেন। তাঁর জীবনে প্রথম খ্যাতি আসে আকস্মিকভাবে। ১৭৯০ সালে কাণ্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তিনি বেনামীতে কাণ্টীয় দর্শনের ব্যাখ্যামূলক একটি প্রবন্ধ লেখেন। প্রবন্ধটি প্রকাশিত হলে বুদ্ধিজীবী মহল একে কাণ্টের নিজের রচনা বলে মনে করেন। কিন্তু কাণ্ট বললেন, এ লেখা তাঁর নয়। প্রবন্ধের লেখকের নাম প্রকাশিত হলে লেখক ইয়োহান গটলিব ফিকটে জার্মানির সাহিত্যিক ও দার্শনিক মহলে প্রখ্যাত হয়ে পড়েন।

১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়। ফরাসি বিপ্লবের ভাবধারা, বিশেষ করে বুদ্ধির মুক্তির জোয়ার ফিকটেকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। মানুষের চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতা জন্মগত। এই অভিমত প্রচার করে ফিকটে দুখানি পুস্তিকা লেখেন। ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর বয়স যখন মাত্র ৩১ বৎসর, তখন ফিকটে জেনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যক্ষ নিয়োজিত হন। কিন্তু ছাত্র এবং তরুণদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা এবং ধর্মের নীতিগত ব্যাখ্যার কারণে ফিকটে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হয়ে দর্শন বিভাগ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

কাণ্টের পরবর্তীকালে ফিকটের দর্শনের গভীরতাই উনিশ শতকের গোড়ায় ইউরোপে জার্মানীকে দর্শনের বিশিষ্ট কেন্দ্রে পরিণত করে। ফিকটে ভাববাদী হলেও তিনি কাণ্টের দর্শনের অন্তর্নিহিত অসামঞ্জস্যের সমালোচনা করেন। কাণ্ট তাঁর দর্শনকে বুদ্ধি, বিচার এবং নীতি এই তিন ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। ফিকটে সমালোচনা করে বলেন, কাণ্টের বিভাগগুলি পরস্পর বিচ্ছিন্ন। ফিকটের মতে দর্শনের এরূপ বিভাগ অসঙ্গত। দর্শন হচ্ছে অবিভাজ্য এক সত্তা। মানুষের বুদ্ধি, বিচার এবং নীতি সবই সেই অবিভাজ্য সত্তারই প্রকাশ।

কাণ্টের সত্তার সত্তা বা ‘থিং ইন ইটসেলফ’-এর তত্ত্বকে ফিকটে অস্বীকার করেন। মানুষের জীবনের নিয়ামক অবাস্তব চিন্তা নয়, বাস্তব কর্মই মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে। মানুষের বাস্তব কর্ম নির্দিষ্ট হবে মানুষের নীতিবোধ দ্বারা। জ্ঞানের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ভিত্তিতেই মানুষ বাস্তব জীবন যাপন করবে। সত্তার প্রকাশ এবং অপ্রকাশ এ দুই-এর মধ্যে কোনো বিরোধ থাকতে পারে না। আসলে এরূপ দ্বৈত অস্তিত্বের কোনো সত্তা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। ফিকটের ভাববাদকে আত্ম-ভাববাদ বলা চলে। চরম আত্মাই সব সৃষ্টির মূল। চেতনার চরম নৈতিক উপলব্ধি হচ্ছে চরম আত্মা। ব্যক্তিক আত্মা চরম আত্মার অনুকূল।

আরো পড়ুন:  এনাক্সিমেণ্ডার ছিলেন একজন গ্রিক বস্তুবাদী দার্শনিক

ফিকটের নীতি-দর্শনের একটি মূল আলোচ্য বিষয় ছিল ব্যক্তির স্বাধীনতার সমস্যা। ফিকটে মনে করতেন, ব্যক্তি স্বাধীন বলতে এ কথা বুঝায় না যে ব্যক্তি আদৌ কোনো বিধানের অনিবার্যতার উপলব্ধিতেই ব্যক্তির স্বাধীনতা নিহিত। ইতিহাসের কোনো বিশেষ যুগে ব্যক্তির স্বাধীনতা ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে যুগের বাস্তব অবস্থার উপর। ফিকটের মধ্যে জার্মান পুঁজিবাদের বিকাশের বৈপরীত্যগুলির প্রকাশ দেখা যায়। বুদ্ধির মুক্তি এবং বাস্তব জীবনের স্বীকৃতির ক্ষেত্রে তিনি অগ্রসর চিন্তাবিদ। কিন্তু বিশ্বজগতের ব্যাখ্যায় তিনি ভাববাদের সীমানার মধ্যেই আবদ্ধ।

তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৭২-১৭৩।

Leave a Comment

error: Content is protected !!