মিশেল ফুকো প্রতিক্রিয়াশীল গণবিরোধী ফরাসি দার্শনিক

ফরাশি দার্শনিক মিশেল ফুকো (১৯২৬-১৯৮৪) Clermont-Farrand, Paris-Vincennes এবং College de France-এ অধ্যাপক ছিলেন। তিনি চিন্তার ইতিহাসের অধ্যাপক হলেও The Archaeology of Knowledge (১৯৬৯, ১৯৭২) গ্রন্থে একে ‘চিন্তার ইতিহাস‘ হিসেবে অভিহিত করে বর্ণনা করেন অতীত লিখনের একীভূত ক্ষেত্র হিসেবে। ইতিহাসের সাধারণ বিষয় হিসেবে পূর্বানুমিত কোনো কিছুকে তিনি সমালোচনা করেন Madness and Civilization (১৯৬১, ১৯৬৭) গ্রন্থে। The Order of Things (১৯৬৬, ১৯৭০) গ্রন্থে তিনি বলেন, মানুষ আধুনিক সময়ের আবিষ্কার এবং ধ্বংসই তার নিয়তি।

তার মতে, episteme বা জ্ঞান-কাঠামো হলো ‘ইতস্তত’ ছাড়া ছাড়া, (discursive formation), কখনো উদ্ভব ঘটে কখনো মিলিয়ে যায়। জ্ঞানের রূপের উদ্ভব ও বিলয়ের ইতিহাস পাঠ কি জ্ঞানের ধারণাকে ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে যথেষ্ট কার্যকর হতে পারে? ফুকোর উত্তর—না। জ্ঞান উদ্ভূত হয়ে ভেঙে যাওয়ার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে ‘বস্তুর জগতে’ (in the regime of materiality), এর বিবিধি সামাজিক প্রতিষ্ঠানে। এইসব সামাজিক প্রতিষ্ঠানেই নিহিত আছে ছাড়া ছাড়া ঘটনার সংগঠন। তাই জ্ঞানকে ব্যাখ্যা করতে হবে প্রতিষ্ঠানের আঙ্গিকে, প্রতিষ্ঠানে ঘটিত প্রযুক্তিগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের আঙ্গিকে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান যেহেতু শক্তির ব্যবহার ছাড়া গতিশীল থাকে না, তাই শক্তির স্বরূপ ব্যাখ্যায় আগ্রসর হন তিনি।

তিনি দেখেন, শক্তি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকাশ পায় বিধায় এর উৎস এবং প্রকৃতি ব্যক্তিক বা প্রাতিস্বিক নয়। মার্কসবাদীদের বিপরীতে তিনি বলেন, শক্তির স্বপ্নকে বুঝা যাবে না মালিকানার যান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাখ্যায়, একে বুঝা যাবে শক্তি “কৌশলে’ (stretegies)। নৃতত্ত্বকেন্দ্রিকতাকে (anthropocentrism) এড়িয়ে যেতে ফুকো বলেন, এই কৌশল কোনো ব্যক্তি বা গ্রুপের সচেতন পরিকল্পনা বা রূপরেখা নয়, এ হলো ‘কৌশলগত অবস্থানের ‘অনিবার্যতা’ (the effect of a strategic position)। ফলে, জ্ঞানের বর্ণনাত্মক বা সাংগঠনিক দৃষ্টিভঙ্গির বদলে এখন পাওয়া গেল সত্যিকার নতুন রূপে জ্ঞান উদ্ভবের ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি, সততই বস্তুবাদী এক দৃষ্টিভঙ্গি।

আরো পড়ুন:  জ্যাঁ ব্যাপ্তিস্ত আলেম্বার্ট ছিলেন ফরাসি দার্শনিক এবং গণিতশাস্ত্রবিদ

মিশেল ফুকো বলেন, শক্তিকে পাওয়া যাবে যে-কোনো স্তরের প্রতিষ্ঠানে গৃহীত কৌশলে ক্রিয়ারত : একে সীমিত করে দেখা যাবে না রাষ্ট্রীয় কিংবা শাসক শ্রেণির শক্তি হিসেবে। শক্তিই সৃজনশক্তি, শক্তিই জ্ঞানের স্রষ্টা। তিনি বলেন শক্তির রূপাণুর (microphysics of power) কথা, সমগ্র সমাজে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রূপে শক্তি ছড়িয়ে ব্যাপ্ত হয়ে, বিক্ষিপ্ত ভাবে রয়েছে। বিচিত্ররূপে, বিচিত্র নামে, বিচিত্রভাবে ছড়িয়ে আছে শক্তির কৌশল এবং রয়েছে এদের আন্তর-দ্বন্দ্ব। কিন্তু এ সব দ্বন্দ্ব এবং প্রক্রিয়ার পরবর্তী ফলাফলকে কিভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে? (কারণ শক্তি সৃষ্টির কোনো সাধারণ প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন নি ফুকো)।

তাই তাত্ত্বিক পর্যায়ে ফুকোর শক্তির স্বরূপকে সমালোচনা করা হয় অধিবিদ্যক আখ্যা (mataphysics of power) দিয়ে। ফুকোর শক্তির স্বরূপ অধিবিদ্যক হলেও রূপাণুমূলক। ফুকোর চিন্তাকে পুঁজি করে অঁদ্রে গ্রুকমান এবং অন্যান্যেরা (Nouveaux Philosophes) কড়া মার্ক্সবিরোধী রাষ্ট্রীয় অধিবিদ্যার (totalitarianism) তত্ত্বের জন্ম দেয়।

তথ্যসূত্র:

১. আফজালুল বাসার; বিশ শতকের সাহিত্যতত্ত্ব; বাংলা একাডেমী, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি, ১৯৯১; পৃষ্ঠা ৩১০-৩১১।

Leave a Comment

error: Content is protected !!