পিটার “পিট” সিগার বা পিট সীগার (৩ মে, ১৯১৯ – ২৭ জানুয়ারি, ২০১৪) ছিলেন একজন মার্কিন লোকসঙ্গীত শিল্পী, পরিবেশবাদী এবং গণঅধিকারকর্মী। তিনি ১৯৪০’র দশকে জাতীয় বেতারের অনুষ্ঠানে, দ্য উয়িভারস-এর সদস্য হিসেবে ১৯৫০’র দশকে যন্ত্রসংগীতে জননন্দিত রেকর্ড করেন, ১৯৫০’র দশকে ১৩ সপ্তাহ ধরে টপচার্টে অবস্থান করা ‘লীড বেলি’র “গুডনাইট, ইরিন”-এর রেকর্ডিঙের জন্য অধিক খ্যাত হন। দ্য উয়িভারসের সদস্য হয়ে তিনি ম্যাক কার্থির আমলে কালোতালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন। প্রায় ঋষিসুলভ এই মানুষটির গোটা জীবনে সমালোচক ও শত্রুর অভাব ছিলো না। তাঁর গান বহু বছর রেডিয়ো এবং টিভিতে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলো মার্কিন সরকার। ১৯৬০’র দশকে তিনি জনগণের সামনে বিখ্যাত শিল্পী হিসেবে মার্কিন জনতার বিভিন্ন সমস্যার পাশাপাশি তাঁর গানে মানবাধিকার, গণঅধিকার, পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ, ১৯৬০’র দশকের প্রতিসংস্কৃতি, পরিবেশবাদ, জনসংখ্যাবৃদ্ধি এবং জাতিগত-বর্ণগত সমস্যার মতো আন্তর্জাতিক বিষয়কে সমর্থন করে প্রতিবাদী সংগীত নিয়ে পুনরায় আবির্ভূত হন। পাশাপাশি আমেরিকার লোক সংগীতের সংরক্ষণ, প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বিভিন্ন রকম প্রতিকূলতা পেরিয়ে তিনি গান গেয়েছেন একটি পরিপূর্ণ জীবন ধরে। মার্কিন মুলুকের লোকগান, জীবনের গান, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের গান, প্রতিবাদের গানের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিলেন পিট সিগার।
প্রবাদপ্রতিম এই মার্কিন লোকসঙ্গীত শিল্পী পিট সিগার মারা যান ২৭ জানুয়ারি, ২০১৪ তারিখে। বিশ্বের প্রতিবাদী গণসঙ্গীত আন্দোলনের অন্যতম কাণ্ডারী পিট সিগার। তিনি লোকসঙ্গীতকে হাতিয়ার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ নিপীড়িত মানুষের পক্ষে আজীবন লড়াই করে গিয়েছেন। এজন্য তাঁকে বিভিন্ন সময় শাসকের রোষের মুখে পড়তে হয়েছে। তবুও কোনও প্রতিকূলতাই পিট সিগারকে ভীত করতে পারেনি।
সমাজ সচেতন ও ঐতিহ্য সংরক্ষক এই মহান শিল্পী ১৯১৯ সালের ৩ মে নিউ ইয়র্কের উপকণ্ঠে প্যাটারসন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিন ভাই-বোনের মধ্যে পিট সিগার ছিলেন সবার ছোট। পিট এমন এক পারিবারিক আবহে বেড়ে উঠেছেন যেখানে তিনি ছেলেবেলা থেকে একই সাথে পেয়েছিলেন সুরের মূর্ছনা এবং রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনার উৎস। তাঁর মা কনসট্যান্ট এডসন সিগার ছিলেন একজন নিপুণ বেহালা বাদক এবং বাবা চার্লস সিগার ছিলেন একজন সংগীতজ্ঞ ও বিশ্ব শান্তি আন্দোলনের অন্যতম সমর্থক। আমেরিকার গ্রামেগঞ্জে ‘ভাল’ মিউজিক, অর্থাৎ বাখ, মোৎসার্ট, ভিভালডি-র সঙ্গীত পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন পিটের বাবা এবং সেই উদ্দেশ্যেই সপরিবারে চষে বেড়াতেন সারা দেশ, অনুষ্ঠান করতেন বিভিন্ন অঞ্চলে। সারা দেশ ঘুরতে ঘুরতে চার্লস নিজেই আকৃষ্ট হয়ে পড়েন লোকসঙ্গীতে এবং পিতার হাত ধরে পিটও পছন্দ করতে থাকেন লোকসংগীত।
পারিবারিক পরিমন্ডলে আট বছর বয়সেই পরিচিত হন ইউকিলিলি নামের অনেকটা ছোট গিটারের মতো একটি যন্ত্রের সাথে। সেই যন্ত্র বাজিয়ে ছোট্ট পিট শিখতে থাকেন নানা রকম প্রচলিত আমেরিকান লোকসঙ্গীত স্কিপ টু মাই লু, ও সুজানা, ইয়াঙ্কি ডুড্ল ও আরও অনেক গান। যদিও সংগীতের প্রতি তাঁর কোনো ঝোঁক ছিলো না। শুধুমাত্র পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে ছোট্ট পিটকে ধ্রুপদীর অনুশীলন করতে হতো প্রতিদিন। এভাবে শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে তারুণ্যে পা রাখেন পিট সিগার। তিনি এসময় সাংবাদিকতা করলেও এ বিষয়ে আগের মতো উৎসাহ পাচ্ছিলেন না বলে তিনি খুঁজছিলেন মনের মতো কোনো বিষয়। ১৯৩৬ সালের এক গ্রীষ্মে পিট ঘুরতে যান এ্যাশভিলেনের একটি লোকজ মেলায় আর সেখানেই তাঁর চোখ আটকে যায় একটি অন্যরকম বাদ্যযন্ত্রের উপর। পুরনো ধরনের ব্যাঞ্জোর প্রতি এই আকর্ষণ তাঁর সঙ্গীতের প্রতি নতুন করে আগ্রহ সৃষ্টি করে। পরবর্তী সময়ে নিউইয়র্কে দুগ্ধজাত শিল্পের কর্মীদের ধর্মঘটে অংশ নিয়ে বামপন্থী রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন তিনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তিনি কমিউনিস্ট মতাদর্শের সংগে পরিচিত হন। হিটলার বিরোধী ভাবধারা ও সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো সাম্যবাদী জগত তাঁকে অনুপ্রাণিত করে। পিট ১৯৩৬ সালে তরুণ সাম্যবাদী লিগে (YCL) যোগ দেন এবং ১৯৪২ সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে নাম লেখান। বিভিন্ন শ্রমিক সমাবেশে গান গেয়ে বেড়াতে বেড়াতে এক দিন আলাপ হয় প্রবাদপ্রতিম লোকসঙ্গীত গায়ক উডি গাথরির (১৯১২ –১৯৬৭) সঙ্গে। উডির সঙ্গে আমেরিকার নানা প্রান্তে ঘুরে ঘুরে অনুষ্ঠান করতে করতে দেশকে এবং দেশের মানুষকে আরও ভাল করে চিনতে শেখেন পিট সিগার। উডির ‘দিস ল্যান্ড ইজ ইয়োর ল্যান্ড’ গানে ফুটে ওঠা আমেরিকার সঙ্গে পরিচয় ঘটে পিটের।
১৯৪১ সালের বসন্তকালে ২১ বছরের পিট উডি গাথরি ও অন্যান্যদের সঙ্গে অ্যালম্যানাক সিঙ্গার্স নামে একটি গানের দলে একটি অনুষ্ঠানে গান করেন। সেই সময়ের তাঁর কাজের মূল্যায়ন করে শৌভিক মিশ্র আনন্দবাজার পত্রিকায় এক প্রবন্ধে লিখেছেন,
বছর দুয়েক তাঁরা চুটিয়ে লোকগান, প্রতিবাদী গান, বর্ণবিদ্বেষ-বিরোধী গান গেয়ে বেড়ান নানা জায়গায়, বেশ নামও হয়। কিন্তু গান গেয়ে অর্থ বা খ্যাতি উপার্জন করা নয়, পিটের লক্ষ্য ছিল গানের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছনো এবং গানকে মানুষের কাছে পৌঁছনো। কিছু দিন পর দল ভেঙে যায়, পিট [১৯৪৮ সালে] তৈরি করেন উইভার্স বলে আর একটি দল। দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে দলটি। তাঁদের গান ‘টার্ন টার্ন টার্ন’ এখনও বিভিন্ন শিল্পী রেকর্ড করেন। হুডি লেডবেটার-এর কাছে শেখা ‘গুডনাইট আইরিন’ গানটিও খুব জনপ্রিয় হয় সেই সময়ে। … … কিন্তু বিধি বাম! এফ বি আই বামপন্থী স্ট্যাম্প লাগিয়ে দেয় উইভার্স-এর ওপর। তাঁদের গানে সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। কমিউনিস্টদের সমর্থনের জন্য পিটকে আদালতে যেতে হয়। গানের ওপর নেমে আসে কারফিউ![১]
পিট ছিলেন স্পেনের গৃহযুদ্ধের প্রজাতন্ত্রীদের বাহিনীর সমর্থক এবং তাদের সমর্থনে গান গেয়েছেন। টম গ্লাজারের (১৯১৪ – ২০০৩) সাথে ‘Songs of the Lincoln Battalion’ নামে একটি অ্যালবাম রেকর্ড করেছেন। পরবর্তীকালে সিগারেটের বিজ্ঞাপন করার জন্য পিট উইভার্স থেকে পদত্যাগ করেন।
১৯৫৩ থেকে ১৯৬০ সালের দিকে তিনি স্কুলে স্কুলে গিয়ে ছোটদের পরিচয় করিয়ে দেন তাদের শিকড়ের সঙ্গে; ডার্লিং ক্লেমেন্টাইন, জন হেনরি, মাইকেল রো দ্য বোট অ্যাশোর-এর মতো গান প্রথম বার শোনে তারা। কলেজে কলেজে গিয়ে তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে থাকেন সাম্যের গান। ছাত্ররা তাঁর গান প্রাণভরে সমর্থন করে। ১৯৬২ সালে কমিউনিস্ট হওয়ার অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়ে পিট সপরিবার বেরিয়ে পড়েন গোটা পৃথিবী ভ্রমণে। বিভিন্ন দেশ ঘুরে অসংখ্য লোকগান সংগ্রহ করেন। পরবর্তী কালে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অ্যাফ্রিকান লোকসংগীত উইমওয়েহ্, হোসে মার্তির (১৮৫৩ – ১৮৯৫) রচিত স্প্যানিশ গান গুয়ানতানামেরা ও আরও অনেক দেশের লোকগান তাঁর অনবদ্য গায়কীতে প্রথম বার আমেরিকান দর্শক-শ্রোতার কাছে প্রকাশ পায়।
১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে যুদ্ধবিরোধী গানে তিনি আলোড়ন তোলেন গোটা দুনিয়ায়। সেসময় সারা মার্কিন মুলুকে ফোক গানের দল গড়ে উঠতে থাকে। বিটলস এবং রোলিং স্টোন দল লোকসংগীতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পিট সিগারও স্বাভাবিকভাবেই যুক্ত হয়ে গেলেন লোকসংগীতের পুনরুজ্জীবন আন্দোলনের সঙ্গে। ম্যালভিনা রেনল্ডসের (১৯০০ – ১৯৭৮) ‘লিটল বক্সেস’, টম প্যাক্সটনের (জন্ম ১৯৩৭) ‘হোয়াট ডিড ইউ লার্ন ইন স্কুল টুডে’ বা বব ডিলানের ‘হার্ড রেনস আ গ’না ফল’ গানগুলো পিটের ব্যাঞ্জো বেয়ে পৌঁছে গেল শ্রোতার কাছে।
মধ্যবিত্তদের বাক্সবন্দি জীবন, ব্যঙ্গার্থে মধ্যবিত্তের গৃহকে নিয়ে তিনি গেয়েছিলেন ম্যালভিনা রেনল্ডসের ছোট বাক্স, ছোট বাক্স, সব বাক্স একই রকমের। সেই গান শতশতবার শুনেও ক্লান্তি আসে না। শিশুসুলভ এই গানটি এক দার্শনিকতা ফুটিয়ে তোলে আমাদের মনে। বহুবার ভেবেও উত্তর পাই না এ-গান কীভাবে রচনা করেন এক শিল্পী। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিপীড়িত নপুংসক মধ্যবিত্তের ছোট বাক্স জন্ম দেবার আর নিজ খোলসে ঢুকে কচ্ছপ-জীবন ধারণ করার এমন চিহ্ন কী পৃথিবীর আর কোনো কবিতায় বা গানে আছে।
—–And they all get put in boxes, and they all come out the same
And the boys go into business and marry and raise a family
And they all get put in boxes, little boxes all the same
There’s a green one, and a pink one
And a blue one and a yellow one
And they’re all made out of ticky-tacky
And they all look just the same.
পিটের গানে এসেছে হাজারো বিষয়, কিন্তু তার কেন্দ্রে সবসময় থেকেছে শ্রমিক-কৃষক; তাদের হাতুড়ি, কাস্তে, ট্রাক্টর, বাঁশি, পোশাক, পত্রিকা, পোষা প্রাণী, ইত্যাদি। আর আছে রাশি রাশি দুঃখ-যন্ত্রণা হতাশা যুদ্ধ স্বাধীনতা স্লোগান আর গান। ‘গুডনাইট, ইরিন,’ ‘ইফ আই হ্যাড এ হ্যামার’, ‘হোয়্যার হ্যাভ অল দ্য ফ্লাওয়ার্স গন?’-এর মতো পিট সিগারের অসংখ্য সৃষ্টি বিশ্ব সঙ্গীত জগতে চির ভাস্বর হয়ে থাকবে বহুদিন।
তিনি বলেছেন গানের মধ্যে
“গণঅধিকার আন্দোলনের কথা সবচেয়ে বেশি শুনতে পাই। একতার জন্য গান অনেক কিছু করে, তাছাড়া গান ব্যতীত অন্য কিছুর দ্বারা গণঅধিকার আন্দোলনকে এত বেশি প্রভাবিত করা যেত না। মানুষ যত অত্যাচারিত হয় তাদের তত গুনগুনানি বাড়ে। তারা গানে নিজেদের ঐক্য খুঁজে পায়। জেলে, পিকেটিঙে, প্যারেডে তারা এক সঙ্গে গান গায়।”[২]
এই মূল্যায়নের ভেতরেই রয়েছে পিট সীগারের গানের এবং জনগণের শক্তি। আমরা গেয়েছি তার গান এই গ্রহের দশদিকে। পিটের কথা আসলেই আসে আরো ছয়জন জগতখ্যাত শিল্পীর কথা। এঁরা হলেন পল রোবসন (১৮৯৮ – ১৯৭৬), জন লেনন (১৯৪০ – ১৯৮০) বব ডিলন (জন্ম- ১৯৪১), জোয়ান বায়েজ (জন্ম-১৯৪১), জর্জ হ্যারিসন (১৯৪৩-২০০১) এবং জন ডেনভার (১৯৪৩-১৯৯৭)। এদের ভেতর পল রোবসন ছিলেন স্বল্পায়ুর অধিকারী এবং জন ডেনভার ছিলেন জিমি কার্টারের (জন্ম ১৯২৪) ও মার্কিন প্রতিক্রিয়াশীল ডেমোক্র্যাটিক দলের সমর্থক।
পল রোবসন সম্পর্কে পিট লিখেছিলেন, ১৯৪০’র বছরগুলোতে পল
আমাদেরকে-আমাদের সকলকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। … …. বিভিন্ন র্যালি ও কনসার্টে রোবসন-কে কথা বলতে ও গাইতে শুনে, একই ব্যক্তির মধ্যে অসাধারণ শক্তি, গভীর মমতা ও অতুলনীয় পাণ্ডিত্যের সংমিশ্রণ দেখে আমি বার বার মুগ্ধ না হয়ে পারিনি। একজন মানুষের মধ্যে এসব গুণের একসাথে বিরাজ করত চমৎকারভাবে। আমার যৌবনের নায়ক ছিলেন রোবসন। আরো লক্ষ লক্ষ তরুণ শ্বেতাঙ্গও নিশ্চয় আমার মতই ভাবত।[৩]
হেমাঙ্গ বিশ্বাস গেয়েছিলেন পিটের গান ‘জন ব্রাউনের দেহ শুয়ে সমাধি তলে’ এবং ‘আমরা করবো জয়’। আমেরিকার নিগ্রো মুক্তি আন্দোলনের প্রথম শ্বেতাঙ্গ শহীদ জন ব্রাউনকে নিয়ে রচিত আমেরিকায় অত্যন্ত জনপ্রিয় পিটের গানটির বাংলা অনুবাদ, সুরারোপ ও কন্ঠ দেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। ‘আমরা করবো জয়’ গানটির অনুবাদের একটি ইতিহাস আছে। ১৯৬৫ সালে আইপিটিএ এবং সিপিআই-এর যৌথ উদ্যোগে কলকাতায় এক গানের অনুষ্ঠান হয়। সেখানে এসেছিলেন পিট সিগার। উপস্থিত ছিলেন ভুপেন হাজারিকা (১৯২৬-২০১১) ও হেমাঙ্গ বিশ্বাস। একসময় মঞ্চ থেকে পিট সিগার হেমাঙ্গকে ইঙ্গিত করে আহবান করলেন ‘এখানে একজন বিশ্বখ্যাত লোকগায়ক বসে রয়েছেন, তিনি যেন দয়া করে মঞ্চে আসেন’। তৎক্ষণাৎ দুজন লোক এসে হেমাঙ্গকে পাঁজাকোলা করে মঞ্চে তুলে দিলেন। করমর্দনের পর পিট শুরু করলেন গান,
We shall overcome
We shall overcome
We shall overcome
someday
Oh! deep in my heart
I know that
I do believe
We shall overcome someday… …. …
আর হেমাঙ্গ বিশ্বাস তৎক্ষণাৎ অনুবাদ করে গাইলেন ‘আমরা করবো জয়’। গানটি তখন থেকেই রেডিও ও টিভির মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিলো। উল্লেখ্য যে ‘আমরা করবো জয়’ সমগ্র আমেরিকার বর্ণবিদ্বেষ নীতির বিরুদ্ধে এবং কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের নাগরিক অধিকারের দাবিতে কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ মানুষের ঐতিহাসিক সমাবেশগুলির মধ্যে গানটির জন্ম। আমেরিকায় নাগরিক অধিকার আন্দোলন (African-American Civil Rights Movement) চলার সময় মার্টিন লুথার কিং’র (১৯২৯-১৯৬৮) একটি সমাবেশে পিট প্রথম বার গাইলেন বহু দিন আগের একটি গসপেল প্রভাবিত গান: উই উইল ওভারকাম। গানটির একটি শব্দ পাল্টে নিয়ে পিট করে নিলেন ‘উই শ্যাল ওভারকাম’। একটি নতুন স্তবকও জুড়ে দেন গানে: উই ওয়াক হ্যান্ড ইন হ্যান্ড। তারপর গানটি নাগরিক অধিকার আন্দোলনের প্রধান সংগীত (anthem) হয়ে ওঠে। বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য ভাষায় অনুবাদ করা হয় এ গান। যেখানেই সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ জানাতে চেয়েছেন, এ গান তাঁদের লড়াইয়ের ভাষা হয়ে উঠেছে। লড়াইয়ে প্রেরণা দিয়েছে। মার্টিন লুথার কিং গুলিবিদ্ধ হবার সময় এই গানটি মিছিলে সবাই একসাথে গেয়েছিলেন।
সেই বছর ১৯৬৫ সালেই হেমাঙ্গ বিশ্বাস অনুবাদ করেন পিটের আরেকটি গান ‘ফুলগুলি কোথায় গেল?’ তাঁর সেই বিশ্ববিখ্যাত গান লেখা হয় ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধবিরোধী ভূমিকাকে দৃঢ়ভাবে তুলে ধরতে,
‘Where have all the flowers gone,
Long time passing?
Where have all the flowers gone, long time ago?[৪]
তিনি সারাজীবন একটি হাতুড়ির জয়গান গেয়েছিলেন; সেই হাতুড়ি দিয়েই তিনি স্বাধীনতার ঘণ্টা বাজাতেন, নাকি তিনি একটি হাতুড়ি পেয়েছিলেন, যে হাতুড়ি ন্যায়পরতার আর ভাই–বোনের আর শ্রমিকের মুক্তির।
Well, I’ve got a hammer
and I’ve got a bell
and I’ve got a song to sing
all over this land
It’s the hammer of justice
It’s the bell of freedom
It’s a song about love between my
brothers and my sisters
all over this land.
পিট সিগার বিশ শতকের তারুণ্যের সময়গুলো ভরিয়ে রেখেছিলেন। তাই তিনি মারা গেলেও পিট সীগারকে মনে রাখবেন বিশ শতকের সমস্ত সাম্য আকাঙ্ক্ষী প্রতিবাদী এ পৃথিবীর প্রতিটি ধূলিকণা।[৫]
তথ্যসূত্র ও টিকা:
০১. দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, বৃহস্পতিবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, লিংক: http://archives.anandabazar.com/archive/1140206/6edit3.html
০১. পিপলস ওয়ার্ল্ড–কে দেয়া সাক্ষাতকারে পিট সিগার, অনুবাদ: শাহীন মিঞা, প্রকাশক: বামপন্থা ডট কম, মানুষ যত অত্যাচারিত হয় তাদের তত গুনগুনানি বাড়ে-লিংক: http://www.bampontha.com/post_id/1251
০২. পিট সিগারের লেখা তাঁর নাম পল রোবসন, সংস্কৃতি থেকে দ্রোহ ছোট কাগজে প্রকাশিত, লেখার লিংক http://www.somewhereinblog.net/blog/dinosaur/29397313
০৩. গানটির লিরিকের লিংক: http://www.lyricsfreak.com/p/peter+paul+mary/where+have+all+the+flowers+gone_20107752.html
০৪. তাঁর মারা যাবার দিনে তাঁকে নিয়ে লিখি বাংলা উইকিপিডিয়ায়; উইকির লিংক: https://bn.wikipedia.org/wiki/পিট_সিগার
রচনাকালঃ ২৮ জানুয়ারি, ২০১৪।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।