পিয়েরে জোসেফ প্রুধোঁ, ইংরেজিতে Pierre-Joseph Proudhon, (১৫ জানুয়ারি, ১৮০৯-১৯ জানুয়ারি, ১৮৬৫) ফরাসী প্রাবন্ধিক, অর্থনীতিবিদ ও সমাজতাত্ত্বিক। তিনি ছিলেন ক্ষুদে বুর্জোয়ার তত্ত্বপ্রবক্তা ও নৈরাজ্যবাদের আদি তাত্ত্বিকদের একজন।১ তিনিই প্রথম নৈরাজ্যবাদ ও ফরাসী সিন্ডিক্যালবাদের তত্ত্ব রচনা করেন। তিনি বলেন সরকারের অবলুপ্তি আর শোষণের অবলুপ্তি একই সাথে চলবে। দুটি একই, অভিন্ন কাজ। তার মতে রাজনৈতিকভাবে নয়, অর্থনৈতিকভাবে শ্রমিকদের নিজস্ব অর্থনৈতিক সংস্থা গড়ে তুলতে হবে। বৈপ্লবিক দিক থেকে বিকেন্দ্রীভূত এবং বহুকেন্দ্রিক সামাজিক ব্যবস্থা হবে তার চরিত্র। তার গ্রন্থ ‘সম্পত্তি কী’ মার্কস কর্তৃক প্রশংসিত হয়। তিনি প্রুধোঁকে রাজনৈতিক অর্থনীতির বিজ্ঞানসম্মত রচয়িতা বলে উল্লেখ করেন। মার্কসের ‘পবিত্র পরিবার’ গ্রন্থে প্রুধোঁর প্রশংসা রয়েছে। কিন্তু প্রুধোঁর গ্রন্থ ‘দারিদ্রের দর্শন’কে বিরূপ সমালোচনা করে ‘দর্শনের দারিদ্র’ গ্রন্থে মার্কস পরবর্তী সময়ে প্রুধোঁর কঠোর সমালোচক হয়ে ওঠেন। তিনি বলেন অর্থনৈতিক বর্গগুলি হলো তাত্ত্বিক ধারনা, সামাজিক উৎপাদন সম্পর্কের বিমূর্তকরণ। কিন্তু প্রুধোঁ এই সত্য উলটোভাবে দেখেছেন, যেমন ভাববাদী দার্শনিকেরা দেখে থাকেন।২
দর্শনের ক্ষেত্রে প্রুধোঁ ছিলেন প্রধানত ভাববাদী। তিনি হেগেলের দ্বান্দ্বিকতাকে সরল ও স্থুল করে কেবলমাত্র ‘ভাল’ ও ‘মন্দ’র দ্বন্দ্ব হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। প্রুধোঁর মতে, ইতিহাস হচ্ছে ভাবের দ্বন্দ্বের ক্ষেত্র। প্রুধোঁর একটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উক্তি হচ্ছে ‘প্রপার্টি ইজ থেফট’ বা ‘সম্পত্তি চুরির ধন’। কিন্তু এমন উক্তি দ্বারা তিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে নাকচ করেননি। এ উক্তির আক্রমণের লক্ষ্য ছিল বড় পুঁজিবাদী সম্পদ। প্রুধোঁ কল্পনা করেন যে, উৎপাদনের ক্ষেত্রে একের সংগে অপরের ন্যায্য বিনিময়ের ব্যবস্থা করা হলে পুঁজিবাদের অসংগতি দূর হয়ে যাবে।৩
প্রুধোঁবাদ নামটা এসেছে তারই নামের থেকে। তিনি বৃহত পুঁজিবাদী মালিকানার সমালোচনা করেছিলেন, কিন্তু তার হাত থেকে মুক্তির পথ দেখেছিলেন অতি অবশ্যই দারিদ্র, অসমতা, মেহনতিদের শোষণের যন্ত্রস্বরূপ পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রণালীর উৎখাতসাধনের মধ্যে নয়, বরং পুঁজিবাদ ‘শোধরানোর’ মধ্যে, একাধিক সংস্কারসাধনের মাধ্যমে তার ভুলত্রুটি ও অপব্যবহার দূরীকরণের মধ্যে। বিভিন্ন ‘জনগণের’ এবং ‘বিনিময়’ ব্যাংক স্থাপন করা ছিলো তার পরিকল্পনা, তিনি মনে করতেন ঐসব ব্যাংকের সাহায্যে শ্রমিকেরা উৎপাদনের উপকরণ পেতে, কারিগর হতে, এবং তাদের উৎপাদনের ‘ন্যায্য’ বিপণন নিশ্চিত করতে পারবে। প্রলেতারিয়েতের ইতিহাসনির্দিষ্ট ভূমিকাটাকে প্রুধোঁ বোঝেননি, তাই শ্রেণিসংগ্রাম, প্রলেতারিয়ান বিপ্লব ও প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব সম্বন্ধে তার মনোভাব ছিলো নঞর্থক; নৈরাজ্যবাদী হিসেবে তিনি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করেছিলেন। নিজের দৃষ্টিভঙ্গি জবরদস্তিভাবে প্রথম আন্তর্জাতিকের উপর চাপিয়ে দেবার ব্যাপারে প্রুধোঁ যে প্রচেষ্টা চালান মার্কস ও এঙ্গেলস তার বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম করেন। প্রথম আন্তর্জাতিকে প্রুধোঁবাদের বিরুদ্ধে মার্কস, এঙ্গেলস ও তাঁদের সমর্থকদের চূড়ান্ত সংগ্রামের পরিসমাপ্তি ঘটে মার্কসবাদের পরিপূর্ণ বিজয়ের মাধ্যমে।৪
মার্কস এবং এঙ্গেলস উভয়ই প্রুধােঁর কিছু সমালােচনা করেছেন। যেমন প্রুধোঁর সমালোচনা করতে গিয়ে এঙ্গেলস বলেন, পুঁজিবাদে ব্যাপক শােষণের অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও মার্কস পুঁজির শােষণমূলক অবস্থানের জন্য সামন্তবাদ অভিমুখীনতার বিরােধিতা করেছেন। এঙ্গেলস মনে করেন, সামন্তবাদ শ্রমিককে জমির সঙ্গে বেঁধে রাখে। পুঁজিবাদ দাসত্বের বদলে তাকে স্বাধীন শ্রমিকে পরিণত করে এবং শােষণ করে। যা একই সাথে পুঁজিবাদ উচ্ছেদের শর্ত তৈরি করে। তাই শােষণ সত্ত্বেও পুঁজিবাদ সামন্তবাদের চাইতে অগ্রসর সমাজ। শােষণ অবসানের জন্য পেছনের সমাজে ফিরে যাবার বিরােধী ছিলেন মার্কস ও এঙ্গেলস। তিনি বলেন, দাস প্রবণ আত্মার জন্মদাতা গ্রামীণ ছােট শিল্প থেকে বরং মার্কস আধুনিক বৃহদায়তন শিল্পে যেখানে জমির বন্ধন ও উত্তরাধিকার মুক্ত যূথবদ্ধ প্রলেতারিয়েত থাকবে তাকেই মার্কস পছন্দ করেন।[৫] পুঁজিবাদে কৃতকৌশল, প্রযুক্তি ও উৎপাদিকাশক্তির বিকাশ ঘটার ফলে শ্রমের উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি পায়। মার্কস একে ইতিবাচকভাবে দেখেন। কেননা, যার পরিণতিতে ঘটে সামাজিক রূপান্তর, যা পুঁজিবাদের অস্তিত্বের শর্তকে লােপ করে।[৬] এ কারণেই এঙ্গেলস পুঁজিবাদে শােষণ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও সমগ্র আধুনিক শিল্পকে বেদীচ্যুত করে পুরানাে সম্ভ্রান্ত কায়িক শ্রমে ফিরে যাবার প্রতি প্রুধােঁর ইচ্ছাকে এক প্রতিবিপ্লবী পশ্চাদপদ দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেন। কার্ল মার্কসও প্রুধোঁর নানা সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেছেন। প্রুধোঁ যেসব বিষয় বুঝতে পারেননি সেগুলো সম্পর্কে মার্কস লিখেছেন,
“যে অর্থনৈতিক রূপগুলির মাধ্যমে মানুষ পণ্য উৎপাদন, ভোগ ও বিনিময় করে সেগুলি ক্ষণস্থায়ী ও ঐতিহাসিক। নতুন উৎপাদন শক্তি অর্জনের সংগে সংগে মানুষ তাদের উৎপাদন-পদ্ধতির পরিবর্তন করে এবং উৎপাদন-পদ্ধতির পরিবর্তনের সংগে সংগে পরিবর্তিত করে সমস্ত অর্থনৈতিক সম্পর্ককেই, কেননা সেগুলি ছিলো কেবলমাত্র এই বিশেষ উৎপাদন-পদ্ধতিরই আবশ্যিক সম্পর্ক।… … …
প্রুধোঁর কাছে শ্রমবিভাগ ও যন্ত্রের মধ্যকার সম্পর্ক সম্পূর্ণ রহস্যময়।… … …
আমাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রুধোঁ ইতিহাসসঞ্জাত বলে মনে করেন না, তিনি তাদের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে কিছুই বোঝেন না। তাই, সেই প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে তিনি শুধু অন্ধ গোঁড়ামিদুষ্ট সমালোচনাই করতে পারেন। … …”৭
প্রুধোঁ সেই অর্থে একজন বিপ্লবী ছিলেন যিনি সমাজের রূপান্তরকে সমর্থন করেন, কিন্তু তিনি বিপ্লবের হিংসাত্মক উত্থান বা গৃহযুদ্ধ মানেন না। সমাজের এই রূপান্তরের বৈশিষ্ট্য ছিলো মূলত নৈতিক এবং সমাজের পরিবর্তন চাওয়াকে তিনি উচ্চতর নৈতিক দাবি বলে বিবেচনা করতেন।
তথ্যসূত্র ও টিকা:
১. নামের সূচি, কার্ল মার্কস ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস নির্বাচিত রচনাবলী; দ্বিতীয় খণ্ড বারো খণ্ডে; প্রগতি প্রকাশন মস্কো; ১৯৭৯; পৃষ্ঠা-২৪২।
২. সমীরণ মজুমদার; মার্ক্সবাদ, বাস্তবে ও মননে; স্বপ্রকাশ, কলকাতা; ১ বৈশাখ, ১৪০২; পৃষ্ঠা-১৬০।
৩. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ৩২৩-২৪।
৪. টিকা অংশ, ভি. আই. লেনিন; কী করতে হবে? প্রগতি প্রকাশন, মস্কো; ১৯৮৪; পৃষ্ঠা-২২৮।
৫. দেখুন, এঙ্গেলস, বাস-সংস্থান সমস্যা, মার্কস-এঙ্গেলস রচনা সংকলন, প্রথম খণ্ড দ্বিতীয় অংশ, পৃষ্ঠা ২৩৪-৩৫।
৬. পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৩৬।
৭. প. ভ. আন্নেনকভ সমীপে লেখা মার্কসের ২৮ ডিসেম্বর, ১৮৪৬ সালে লেখা চিঠি। প্রুধোঁ সম্পর্কে মার্কসের মতামত জানার জন্য এই চিঠিটি গুরুত্বপূর্ণ।
রচনাকাল ৮ অক্টোবর, ২০১৩
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।