রবার্ট ফিলমার (ইংরেজি: Robert Filmer; ১৫৮৯- ২৬ মে ১৬৫৩ খ্রি.) সপ্তদশ শতকের ইংল্যাণ্ডের একজন রাষ্ট্রচিন্তাবিদ। রবার্ট ফিলমার অবশ্য অধিক খ্যাতিলাভ করেন তাঁর মৃত্যুর পর। ১৬৪৯-এর গৃহযুদ্ধে পার্লামেন্ট-পক্ষের বিজয় এবং রাজার বিচার ও রাজার শিরচ্ছেদ ঘটলেও ক্রমওয়েলের পার্লামেন্টীয় শাসনের পরে ইংল্যাণ্ডে পুনরায় রাজতন্ত্রের প্রবর্তন ঘটে।
সপ্তদশ শতকের সময়কার ইংল্যাণ্ডে রাজা বনাম পার্লামেন্টের বিতর্কের সঙ্গে ধর্মের ক্ষেত্রে ক্যাথলিক বনাম প্রটেস্ট্যান্টবাদও একটি বড় রকমের আলোড়নকারী বিতর্ক ছিল। ইংল্যাণ্ডের কোনো রাজা ক্যাথলিকবাদী হতে পারবে না –নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে এটা একটি সামাজিক ধর্মীয় বিধান বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় র্চালসের আসন্ন মৃত্যুর কালে সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে এই বিতর্ক পুনরায় জাগরিত হয়। তা ছাড়া গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত পার্লামেণ্টের ক্ষমতাকে ‘অস্বীকার করে ইংল্যাণ্ডের রাজা যখন নিজস্ব ক্ষমতা ব্যবহার করার প্রবণতা দেখাতে পুনরায় শুরু করে তখন সে সার্বভৌম রাজা, না পার্লামেণ্ট তথা জনসাধারণের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান, এই প্রশ্ন রাজনৈতিক বিতর্কে প্রধান হয়ে দাঁড়ায়।
সপ্তদশ শতকে আবার একপক্ষ রাজতন্ত্র তথা রাজার সার্বভৌমত্বের উপর যুক্তি প্রদর্শন করতে থাকে। অপর পক্ষ জনসাধারনের সার্বভৌমত্বের তত্ত্ব উপস্থিত করে। রবার্ট ফিলমারের খ্যাতি তখন এই কারণে ঘটে যে তিনি তাঁর জীবিতকালে ‘প্যাটরিয়ারকা’ বা ‘ন্যাচারাল পাওয়ার অব কিংস’ –অর্থাৎ রাজার ক্ষমতার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে যে পুস্তক রাজার পক্ষীয়গণ তাঁর মৃত্যুর ত্রিশ বৎসর পরে ১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম প্রকাশ করে। এই গ্রন্থে ফিলমার একদিকে যেমন ধর্মীয় যুক্তিতে আদমকে ঈশ্বরের সৃষ্ট প্রথম রাজা এবং আদমের পুত্র হিসাবে পার্থিব রাজাকে ঈশ্বরসৃষ্ট রাজারই উত্তরাধিকরকারীরূপে সার্বভৌম বলে মত প্রকাশ করেন, তেমনি জনসাধারনের সার্বভৌমত্বকে যাঁরা প্রকৃতির বিধান এবং সামাজিক চুক্তির ভিত্তিতে সমর্থন করে, তাঁদের যুক্তিকে বেশ জোরের সঙ্গে খণ্ডন করার চেষ্টা করেছিলেন।
ফিলমারের মতে ‘জনসাধারণ’ কথাটাই বাস্তবতাহীন। জনসাধারনের কোনোকালে চুক্তি করে সম্মতি জানিয়ে রাষ্ট্র এবং রাজা তৈরি করেছিল –এটা না ঐতিহাসিক, না যুক্তিভিত্তিক। জনসাধারণ আসলে ‘মুণ্ডবিহীন এবং সংখ্যা ব্যততি’ আর কিছু নয়। তাঁর কথায় ‘হেডলেস মালটিচুড’। জন লক তাঁর ঐতিহাসিক ‘টু প্রিটিজেস অব সিভিল গভর্নমেন্ট’ –নামক গ্রন্থে রবার্ট ফিলমারের যুক্তিকে খণ্ডন করেন। রাজনৈতিক এ সকল বিতর্কের একটি বাস্তব সমাধান ঘটে ১৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যাণ্ডের পার্লমেন্ট কর্তৃক রাজার শাসনের শর্তাবলী নির্ধারণপূর্বক পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব ঘোষণার মাধ্যমে।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৭৪-১৭৫ ।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।