সিগমুন্ড ফ্রয়েড ছিলেন মনোসমীক্ষণ নামক মনোচিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভাবক ও প্রবক্তা

সিগমুন্ড ফ্রয়েড বা সিগমাণ্ড ফ্রয়েড (ইংরেজি: Sigmund Freud; ৬ মে ১৮৫৬- ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯) মনোসমীক্ষণের প্রবক্তারূপে মনোবিজ্ঞানের ইতিহাসে বিখ্যাত। অস্ট্রিয়ার মোরাভিয়াতে ফ্রয়েডের জন্ম। অধ্যয়ন জীবনে আইন থেকে বিজ্ঞান এবং পরবর্তীকালে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে আত্মনিয়োগ করেন। ১৮৮৪ সনে ফ্রয়েড ভিয়েনার হাসপাতালে চিকিৎসক হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৮৮৫ সনে ফ্রয়েড ফরাসি স্নায়ুতন্ত্রবিদ চারকটের সংযোগে আসেন। চারকট মনে করতেন মৃগীরোগের মূলে মানসিক কারণ নিহিত। চারকটের নিকট থেকে মনোসমীক্ষার আগ্রহ নিয়ে ফ্রয়েড ভিয়েনায় প্রত্যাবর্তন করেন।

১৮৯৩ সালে ফ্রয়েড ব্রুয়ারের সহযোগিতায় ‘স্টাডিয়েন উবার হিস্টোরি’ নামক গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থে তিনি এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, হিপনোসিস বা সংবেশনের মাধ্যমে রোগীর অচেতন মনের অবদমিত ভাবকে অর্গলমুক্ত করে মৃগী রোগীকে রোগমুক্ত করা সম্ভব। কিন্তু এমন চিকিৎসার ফল তেমন স্থায়ী হয় না দেখে ফ্রয়েড পরবর্তীকালে হিপনোসিস বা সংবেশন পদ্ধতি পরিত্যাগ করেন। এর পরে তিনি এককভাবে তাঁর মনোসমীক্ষণের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে একাধিক গ্রন্থ প্রকাশ করেন।

ফ্রয়েডের স্বপ্নের তত্ত্বও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ফ্রয়েড মনে করতেন স্বপ্নের মধ্যে অচেতন জগতে অবদমিত বাসনা আত্মপ্রকাশ করে। কাজেই স্বপ্নের সঠিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে মানসিক রোগের কারণ নির্ণয় করা সম্ভব। মনোবিজ্ঞানে ফ্রয়েডের প্রধান অবদান হচ্ছে তাঁর ‘আনকনসাস’ বা অচেতন মনের ব্যাখ্যা। ফ্রয়েডের অচেতনকে ‘ইড’ বলেও আখ্যায়িত করা হয়। ‘ইড’ হচ্ছে ব্যক্তির আত্মস্বার্থ রক্ষামূলক সকল কামনা বাসনা প্রবৃত্তির সমাহার-সত্তা।

মানসিক রোগ যে দেহের রোগ নিরপেক্ষভাবে হতে পারে এই তত্ত্বই যে ফ্রয়েড প্রবর্তন করেন, তাই নয়। তিনি আরো বলেন, সকল মানসিক রোগের মূলে আছে যৌনকামনা বা প্রবৃত্তির অবদমন। যৌনাবেগ হচ্ছে মানুষের জীবনের মূল আবেগ। কিন্তু সমাজের এই আবেগের স্বতঃস্ফুর্ত পূরণ সম্ভব নয়। বিভিন্নভাবে যৌন আবেগ ও ইচ্ছাকে অবদমিত করা হয়। এই অবদমিত ইচ্ছা নিয়ে মনের বৃহত্তর এবং অচেতন ভাগের সংগঠন। অবদমিত ইচ্ছার আত্মপ্রকাশ এবং আত্মতৃপ্তি লাভের চেষ্টা এবং সচেতন মন বিবেক বা সেন্সরের প্রহরা ও প্রতিরোধ চেষ্টায় ব্যক্তির মধ্যে দ্বন্দ্বের উদ্ভব ঘটে। দ্বন্দ্বের তীব্রতায় ব্যক্তির মানসিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে মানসিক রোগের সৃষ্টি করে।

আরো পড়ুন:  টমাস ম্যালথাস বস্তুনিষ্ঠ ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ

ফ্রয়েড ১৮৮৯ সালে ঘোষণা করেন, যৌনানুভূতি কেবল যে মৌলিক অনুভূতি তাই নয়। সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, যৌনানুভূতি বয়সবৃদ্ধির সঙ্গে ব্যক্তির মধ্যে জন্ম লাভ করে এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু ফ্রয়েড বলেন, বয়ঃপ্রাপ্তিতে নয়, ব্যক্তির জন্ম থেকেই যৌনানুভূতির জন্ম। ফ্রয়েডের তত্ত্বের অভিনবত্ব সমকালীন চিন্তার ক্ষেত্রে আলোড়ন এবং প্রতিবাদের সৃষ্টি করে। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে, ফ্রয়েডের পূর্বে মনের এরূপ গভীর বিশ্লেষণ আর কেউ করেন নি। তাছাড়া যৌনানুভূতি যে ব্যক্তি চরিত্রের একটি শক্তিশালী নিয়ামক তা আজ সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত। কিন্তু ফ্রয়েড তাঁর এই তত্ত্বে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে যৌন অনুভূতিকে সব বিকারের একমাত্র কারণ বলে নির্দিষ্ট করার যে প্রবণতা দেখিয়েছেন তাকে গ্রাহ্য বলে অনেকে মনে করেন না।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ফ্রয়েড তাঁর তত্ত্বের অভিনবত্বে কিছুটা বিমোহিত হয়ে কল্পনাবাদীতে পরিণত হয়েছিলেন। মানসিক রোগের কারণকে তিনি ব্যক্তির দেহ এবং সামাজিক পরিবেশ বিচ্ছিন্নভাবে নির্দিষ্ট করার প্রয়াস পেয়েছেন। ফলে মানসিক রোগ নিরাময়ের সমাজ বিচ্ছিন্ন যে পদ্ধতির তিনি আবিস্কার করেছেন তা দ্বন্দ্ব সংঘাতময় সমাজে অসহায় ব্যক্তির মানসিক বিকারের নিরসনে খুব কার্যকর কোনো ভূমিকা পালনে সক্ষম হয় নি।

১৯০৩ সালে ফ্রয়েড ভিয়েতনাতে ‘মনোসমীক্ষণবিদ চক্র’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৬ সালের মধ্যে বিভিন্ন দেশে এই সংগঠনের শাখা প্রসার লাভ করে। তাঁর উদ্যোগে ১৯০৮ সালে সুইজারল্যাণ্ডের সালজবার্গে বিকৃতি নিবারণের উদ্দেশ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক মনোসমীক্ষণ সমিতি অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩৬ সালে ফ্রয়েডের আত্মজীবনীমূলক রচনা প্রকাশিত হয়। ১৯৩৮ সালে ফ্যাসিস্ট হিটলারের বাহিনী ভিয়েনা দখল করার পরে নিরাপত্তার জন্য লণ্ডনে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং ১৯৩৯ সনে লণ্ডনেই মারা যান।

তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৭৮-১৭৯।

Leave a Comment

error: Content is protected !!