ডেনমার্কের অধিবাসী সোরেন কিয়ার্কেগার্ড (ইংরেজি: Soren Kierkegaard; ৫ মে ১৮১৩ – ১১ নভেম্বর ১৮৫৫ খ্রি.) ছিলেন অস্তিত্ববাদের পূর্বসূরি। তাঁর মৃত্যু ঘটে ঊনিশ শতকের মধ্যভাগে। কিন্তু তাঁর গ্রন্থসমূহের অনুবাদ এবং তার অভিমতের প্রচার ঘটে বিশ শতকের মধ্যভাগে। জাঁপল সার্ত্রে, রেনল্ড নাইবুর এবং অপরাপর অস্তিত্ববাদী দার্শনিকের উপর কিয়ার্কেগার্ডের প্রভাবে বেশ প্রত্যক্ষ।
জ্ঞানের প্রশ্নে কিয়ার্কেগার্ড হেগেলের ‘চরম জ্ঞান’বাদের প্রতিবাদী ছিলেন। মানুষের পক্ষে চরমজ্ঞান লাভ সম্ভব এবং চরমজ্ঞান হচ্ছে যুক্তিগত জ্ঞান, হেগেলের এই তত্ত্বকে কিয়ার্কেগার্ড অগ্রাহ্য করেন। তিনি প্রাচীন দার্শনিক প্লেটো এবং এরিস্টটলের এরূপ অভিমতকেও অস্বীকার করেন যে, জ্ঞান মানুষের অন্তর্নিহিত সত্তা থেকে বহির্গত হয় এবং ব্যক্তির পক্ষে জ্ঞান অর্জনের অর্থ হচ্ছে নিজের অন্তর্নিহিত সত্য সম্পর্কে ব্যক্তির চেতনা লাভ। এর বিরোধী তত্ত্ব হিসাবে কিয়ার্কেগার্ড অভিমত প্রকাশ করেন যে, জ্ঞান অবশ্যই ব্যক্তির জন্য একটি বহিরাগত বিষয়। ব্যক্তিকে জ্ঞান আহরণ করতে হয় তার শিক্ষক কিংবা বিধাতার নিকট থেকে। বিধাতা যে কেবল আমাদের জ্ঞান দান করেন তাই নয়। বিধাতা সেই জ্ঞানকে উপলব্ধি করার ক্ষমতাও আমাদের দান করেন।
কিয়ার্কেগার্ডের কাছে ব্যক্তির ইচ্ছার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা এবং অনিবার্যতার প্রশ্নটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মতে ইচ্ছার ক্ষেত্রে ব্যক্তি স্বাধীন। ব্যক্তি নিজের অস্তিত্ব নিজেই স্বাধীনভাবে স্থির করতে পারে। ‘স্বাধীনতার সংজ্ঞা কি? ব্যক্তি যা চায় তা হতে পারাই হচ্ছে ব্যক্তির স্বাধীনতা’- কিয়ার্কেগার্ডের এই উক্তিটি পরবর্তীকালে অস্তিত্ববাদের মূল সূত্র হিসাবে প্রচারিত হয়। কিয়ার্কেগার্ড যে ঈশ্বরে বিশ্বাসী স্বীকার করা কঠিন হলেও ঈশ্বরের অস্তিত্ব তাকে স্বীকার করতে হয়। এক্ষেত্রে বিশ্বাসের উপর তাকে নির্ভর করতে হয়।
কিয়ার্কেগার্ডের গ্রন্থসমূহের শিরোনামগুলির মধ্যেই তাঁর দর্শনের আভাস পাওয়া যায়। ১৮৪৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আইদার/অর বা হয়/নয়। সংলাপের আকারে লিখিত এই গ্রন্থে তিনি সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে সমস্যার এক জবাবের বিরুদ্ধে অপর জবাব তৈরি করে জবাবের সংলাপ রচনা করেছেন। তাঁর অপর এক গ্রন্থের নাম ‘ভয়’ এবং আর একখানি শিরোনামে ‘আমৃত্যু মৃত্যু’ বা ‘সিকনেস আনটু ডেথ’। এসব গ্রন্থের মূল সুর হচ্ছে হতাশা।
ধর্মীয় বিশ্বাসে আত্মসমর্পণই হচ্ছে মানুষের পক্ষে হতাশা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়-কিয়ার্কেগার্ডের দর্শনের সিদ্ধান্ত ছিল এই। সামাজিক প্রভাবের দিক দিয়ে এই দর্শনের যে একটি প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা রয়েছে তা বুঝতে কষ্ট হয় না।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৫৩।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।