তুলসী লাহিড়ী (১৮৯৭-২২ জুন, ১৯৫৯) বিখ্যাত নাট্যকার ও অভিনেতা। তিনি বাংলা নাটককে পুরোনো বাণিজ্যিক থিয়েটারকে মধ্য ১৯৪০-এ ভারতীয় গণনাট্য সংস্থার মাধ্যমে নবনাট্য আন্দোলনের মাধ্যমে রূপান্তর করেন। তিনি পূর্ববঙ্গের রংপুরে এবং পরে কলকাতার আলিপুর কোর্টে ওকালতি করতেন। তিনি বহুমুখী আগ্রহ ও পারদর্শিতা নিয়ে জীবন শুরু করেছিলেন যেগুলো হচ্ছে সঙ্গীতবিদ, কণ্ঠশিল্পী, যন্ত্রশিল্পী, গীতিকার, অভিনেতা, নাট্যকার, সিনেমার চিত্রনাট্যকার, সুরস্রষ্টা, থিয়েটার ও সিনেমার পরিচালক এবং যেগুলোর প্রায় সবগুলোতেই বিবেচনাযোগ্য সাফল্য লাভ করেছিলেন।[১]
তাঁর জন্ম অবিভক্ত বাঙলার রংপুর, বর্তমান বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার সাদুল্লাপুর উপজেলার নলডাঙ্গা গ্রামে। পিতার নাম সুরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী। জমিদার পরিবারে জন্ম। বি. এ. ও বি. এল. পাস করে ওকালতিতে যুক্ত হন। ১৯২৮ সালে তাঁর রচিত দুইটি গান জমিরুদ্দিন খাঁ রেকর্ডিং করলে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরিচিতি লাভ ঘটে। পরবর্তীকালে এইচএমভি ও মেগাফোন গ্রামোফোন কোম্পানিতে সংগীত পরিচালক পদে নিযুক্তি লাভ। এ থেকেই শুরু হলো অজস্র গান রচনা আর সুর সংযোজন। আইনব্যবসা ত্যাগ করে চলচ্চিত্র ও নাট্যাভিনয়ে যোগদান করলেন। নির্বাক যুগ থেকে শুরু করে বাংলা চলচ্চিত্রের সংগে কয়েক দশকের ঘনিষ্ঠতা ছিলো তাঁর। নাট্যরচনা, মঞ্চাভিনয় এবং পাশাপাশি চিত্রপরিচালক ও অভিনেতারূপে তাঁর অভিজ্ঞতা ছিলো ব্যাপক, সিদ্ধি ছিলো ঈর্ষাজনক।[২] কার্ল মার্কসের মার্কসবাদী দৃষ্টি নিয়ে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার অসারতা প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে নাটক রচনায় আত্মনিয়োগ করে সার্থকতা লাভ করেন। পঞ্চাশের মন্বন্তরের পটভূমিকায় গ্রাম বাংলার, বিশেষ করে উত্তর বাংলার, দরিদ্র মানুষের অভাব-অনটন দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও তাদের উপর ধর্মীয় ও সামাজিক নিপীড়নের আলেখ্য অবলম্বনে “দুঃখীর ইমাম” (১৯৪৭) ও “ছেঁড়াতার” (১৯৫০) নাটক রচনা করে ব্যাপক সুনাম অর্জন। “মায়ের দাবি” (১৯৪১), “পথিক” (১৯৪৯), “লক্ষ্মীপ্রিয়ার সংসার” (১৯৫৯) তাঁর অপরাপর নাটক।[৩] দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৪১ সালে মায়ের দাবি বাণিজ্যিক মঞ্চে আনেন এবং ১৯৪৬ সালে শিশির ভাদুড়ি মঞ্চে আনেন দুঃখীর ইমাম। বহুরূপী ১৯৪৯ সনে পথিক প্রযোজনা করে এবং ১৯৫০ সালে শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় ছেঁড়া তার প্রদর্শিত হয়। সবিতাব্রত দত্ত ১৯৫৬ সালে বাংলার মাটি এবং নাট্যকার ১৯৫৭ সালে রূপকার মঞ্চে আনে।[১]
তুলসী লাহিড়ী একের পর এক মঞ্চে এবং প্রায় ৫০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন[৪], পরিচালনা করেছেন ১১টি সিনেমা। তিনি লিখেছেন, ১৯৪০ সালে ঠিকাদার চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন, ১৯৫৩ সালে পথিকের চিত্রনাট্য করেছেন। অভিনেতা হিসেবে তিনি সহজেই জটিল থেকে কৌতুককর এবং ভিলেইনি থেকে নিষ্পাপ; প্রায় সব চরিত্রেই অভিনয় করতে পারতেন। আঞ্চলিক উচ্চারনেও তার দক্ষতা ছিল চমৎকার।
তাঁর রচিত দুটি বিখ্যাত গান হচ্ছে ভুলো না রেখো মনে বাঁচবে যত কাল এবং কুল মজালি ঘর ছাড়ালি পর করালি আপনজনে। এই কর্মী মানুষটি ১৯৫৯ সালের ২২ জুন কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। গানের জগতে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল কাজী নজরুল ইসলামের সংগে। তাঁর লেখা বহু গান এখন নজরুলগীতি বলে প্রচলিত আছে। সহস্রাধিক জনপ্রিয় বাংলা গানের এই গীতকারের কোনো গীতসংকলন নেই।
তথ্যসুত্র ও টিকা:
১. এই লিংকে গেলে কিছু তথ্য পাবেন: Tulsi Lahiri, Indian Dramatist.
২. সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত আধুনিক বাংলা গান; প্যাপিরাস, কলকাতা; বৈশাখ, ১৩৯৪; পৃষ্ঠা- ১৭০।
৩. সেলিনা হোসেন ও নুরুল ইসলাম সম্পাদিত বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান; ঢাকা; এপ্রিল, ২০০৩; পৃষ্ঠা- ১৮৬-৮৭।
৪. তাঁর অভিনীত, পরিচালিত ও সুরারোপিত চলচ্চিত্রের একটি তালিকা পাবেন এই লিংকে গেলে।
রচনাকালঃ ৭ এপ্রিল ২০১৪
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।