
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র হচ্ছে হিন্দু রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে একটি প্রাচীন গ্রন্থ। গ্রন্থটির রচয়িতা ছিলেন তক্ষশিলার অধিবাসী বিষ্ণুগুপ্ত বা কৌটিল্য নামে জনৈক ব্রাহ্মণ। তিনি চাণক্য নামেও পরিচিত। বিশাখদত্ত রচিত মুদ্রারাক্ষস থেকে জানা যায় যে তিনি মগধে মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের (৩২২-২১৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) প্রধান মন্ত্রী ছিলেন। গ্রন্থটির রচনাকাল এবং রচয়িতা কৌটিল্য সম্পর্কে মতভেদ আছে। অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি শুধু ধনসম্পদ সম্পর্কিত নয়, তাতে রাষ্ট্রনীতি, দণ্ডনীতি, আইন, প্রশাসন, সমাজতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয় আলােচিত হয়েছে। গ্রন্থকার আন্বীক্ষিকী, ত্রয়ী, বার্তা ও দণ্ডনীতি—এই বিদ্যা চতুষ্টয়ে তাঁর অধিকারের স্বাক্ষর ছাড়াও গ্রন্থটিতে তিনি শুল্কশাস্ত্র, বাস্তুবিদ্যা, ধাতুবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, উদ্ভিদবিদ্যা, ভূগােল, ইতিহাস প্রভৃতি নানা জ্ঞানের ক্ষেত্রে গভীর বিদ্যাবত্তার পরিচয় দিয়েছেন।
গ্রন্থটি ‘অধিকরণ’ নামে ১৫টি পরিচ্ছেদে বিভক্ত এবং এক একটি অধিকরণ কিছু সংখ্যক প্রকরণে বিভক্ত। মােট ১৮০টি প্রকরণ আছে। প্রকরণগুলি ১৫০টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। পরিচ্ছেদগুলির শেষে আলােচিত বিষয়বস্তুর সার প্রদত্ত হয়েছে। গ্রন্থটি ভাষ্য ও সূত্রাকারে রচিত। মাঝে মাঝে কিছু শ্লোক অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। শ্লোকের সংখ্যা মােট ছয় হাজর। গ্রন্থকার বৃহস্পতি, শুক্র প্রমুখ পূর্বসূরিদের কাছে তাঁর ঋণ স্বীকার করেছেন। ভাষা সহজ, কিন্তু স্থানবিশেষে দুর্বোধ্য। অর্থশাস্ত্রের একাধিক টীকা আছে। অধিকরণগুলিতে আলােচিত বিষয়সমূহের কয়েকটির সংক্ষিপ্ত রূপরেখা নীচে দেওয়া হল:
আলােচনার সুবিধার্থে সুবিশাল এই গ্রন্থের বিভিন্ন অধিকরণকে মােটামুটি তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম পর্যায়ে প্রথম, ষষ্ঠ ও অষ্টম অধিকরণে আলােচ্য বিষয় হলো রাজধর্ম তথা রাজার কর্তব্য। রাষ্ট্রের সাতটি অঙ্গের (সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব) মধ্যে স্বামী (রাজা), অমাত্য, জনপদ, দুর্গ, কোষ, দণ্ড এবং মিত্রের কথা বলা হয়েছে। এই সপ্তাঙ্গ তত্ত্বের মধ্যেই রাষ্ট্রের প্রত্যয় সম্পর্কে আধুনিক যে সব লক্ষণের কথা বলা হয় অর্থাৎ সার্বভৌমত্ব, সরকার, ভূখণ্ড, জনসংখ্যা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
রাষ্ট্রের তথা সমাজের উৎপত্তি সম্পর্কে একটি কথােপকথনের মাধ্যমে ব্যক্ত হয়েছে যে জঙ্গলের রাজত্ব থেকে পরিত্রাণের জন্য দ্রব্যাদির বিনিময়ে মনু নামক রাজার আধিপত্য স্বীকৃতি পায়। সার্বভৌমত্বের অধিকারী রাজার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কেও অনেক কথা বলা হয়েছে। রাজাকে প্রদেয় ভূমিরাজস্বের হারও নির্ধারিত করা হয়। মনু প্রবর্তিত আইন ও বিধিনিষেধ অযৌক্তিক প্রতিপন্ন হলে যুক্তিগ্রাহ্য আইন অনুসরণ করা বিধেয়। জনসাধারণের সুখ ও শান্তি রাজার কল্যাণ বিধান করে। দণ্ড শব্দটি অর্থশাস্ত্রে শাসনশক্তির যষ্টিসদৃশ প্রতীক এবং শাস্তি—উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।
কৌটিল্য রাজনীতিকে মাকিয়াভেল্লির মতাে ধর্ম ও নৈতিকতার প্রভাব থেকে মুক্ত রাখেন। শুভ লক্ষ্যে পৌছতে অশুভ মাধ্যম অনুসরণে কোনও আপত্তি নেই। তবে দেশে মাৎস্যন্যায় দেখা দিলে রাজদণ্ডের কঠোর প্রয়ােগের কথা বলা হয়েছে। রাজার প্রাত্যহিক এবং দিবসব্যাপী ইতিকর্তব্য, যথা প্রজাপালন চিন্তা, আয়ব্যয়ের হিসাবরক্ষণ, স্নানাহার, রাজধানী পরিদর্শন, পড়াশােনা, সভাসদদের সঙ্গে মিলিত হওয়া, বিনােদন, সৈনাবাহিনী পরিদর্শন, গুপ্তচরদের সঙ্গে সংযােগ ইত্যাদি।
অর্থশাস্ত্রের আলােচনায় দ্বিতীয় বিষয় হলো রাজ্যের প্রশাসন। আমলাবর্গ, যাদের নামকরণ করা হয়েছে অধ্যক্ষ, তাদের দায়দায়িত্ব এবং সেইসঙ্গে ভূমিব্যবস্থা, রাজস্ব, রাজকোষ, পণ্যাদি উৎপাদন, বাণিজ্য, কৃষি, সামরিক বাহিনীর বর্গবিন্যাস, নগরের স্বায়ত্তশাসন ইত্যাদির অনুপুঙ্খ আলােচনা দেখা যায় দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম অধিকরণে। বিবাহ, উত্তরাধিকার, ঋণ, সঞ্চয়, দাস মালিকানা ; অপরাধীকে কারারুদ্ধ করা ও শাস্তিদান; শাস্তি অথবা অঙ্গচ্ছেদের পরিবর্তে জরিমানা আদায়; আইন ও রীতিনীতি ভঙ্গের দায়ে দণ্ডবিধান ইত্যাদি বিষয় এই পর্যায়ে সবিস্তারে বলা হয়েছে।
তৃতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন অধিকরণের বিষয় হলো যুদ্ধ ও কূটনীতি। সপ্তম অধিকরণে কৌটিল্য ছয় ধরনের বিষয়সংক্রান্ত কর্মপন্থার কথা বলেছেন, যথা শান্তি, যুদ্ধনিরপেক্ষতা, অভিযানপ্রস্তুতি, জোটবদ্ধতা ও নিরাপত্তার চুক্তি, সন্ধি ও সংগ্রাম। নবম অধিকরণে আক্রমণকারীর মতিগতি ও শক্তির বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দশম অধিকরণে যুদ্ধ, রণসজ্জা, শিবির স্থাপন, সৈন্যবাহিনীর প্রকৃতি অনুযায়ী রণকৌশল, নিরাপত্তা বিধান। দ্বাদশ অধিকরণে শক্তিশালী শত্রুপক্ষ, ত্রয়ােদশ অধিকরণে দুর্গদখলসুত্রে শক্রশিবিরে বিভেদ, গােপন কৌশলে পররাজ্যের নৃপতিদের প্রলােভন দেখানাে, গুপ্তচর পাঠানাে, অধিকৃত দেশে শান্তিস্থাপন; চতুর্দশ অধিকরণে শত্রুপক্ষের সঙ্গে গােপন আচরণ, ছলে বলে কৌশলে পর্যদস্ত করা, নিজ সৈন্যবাহিনীর আহতদের নিরাময় ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে।
অর্থশাস্ত্রের বিধিবিধানের ফলে দেশে সমকালে একটি সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী রাজ্য গড়ে উঠেছিল—একথা বললে অত্যুক্তি হয় না।
দ্রষ্টব্য. কামন্দকীয় নীতিসার; রাজধর্ম ; মনুস্মৃতি।
চিত্রের ইতিহাস: কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের ১৯১৫ সালে ব্যাঙ্গালোর থেকে প্রকাশিত প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ
তথ্যসূত্র:
১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ২২-২৩।