কমরেড মাও সেতুং দারুণ দিক নির্দেশনামূলক এই প্রবন্ধটি লিখে শেষ করেন মে ১৯৩০ সালে। এই প্রবন্ধের শুরুতেই তুলে ধরা হয়েছে সেই অবশ্য পালনীয় নীতি — তদন্ত ছাড়া কথা বলার অধিকার নেই। বই পূজাকে দ্বান্দ্বিকভাবে দেখা, বই পূজায় না মাতা অর্থাৎ পুরনো মত দ্বারা চালিত হওয়ার নীতিতে দীক্ষিত না হওয়া, কাজের প্রক্রিয়া, কাদের মধ্যে তদন্ত করতে হবে, কিভাবে তদন্ত করতে হবে, কিভাবে বস্তুর ও সমাজের আসল রূপ উদঘাটন করতে হবে — বাস্তব বিপ্লবী সংগ্রামের ক্ষেত্রে মহা গুরুত্বপূর্ণ এরকম অনেক বিষয় এতে আলোচিত হয়েছে। মনোযোগ দিলে পাঠক এ থেকে চলার পাথেয় হিসেবে অনেক কিছুই পাবেন। মাও সেতুঙের রচনাবলীর নির্বাচিত পাঠ, বিদেশী ভাষা প্রকাশনালয়, পিকিং, প্রথম সংস্করণ: ১৯৭৯ থেকে এটি নেয়া হয়েছে।
ক. তথ্যানুসন্ধান না করলে কথা বলার অধিকার নেই
যদি তুমি কোনো সমস্যার তথ্যানুসন্ধান না কর, তাহলে তার সম্পর্কে কথা বলার অধিকার থেকে তুমি বঞ্চিত হবে। এটা কী খুব কঠোর হচ্ছে না? মোটেই না। যখন তুমি একটা সমস্যার গভীরে গিয়ে খোঁজ কর নি, তার বর্তমান অবস্থা এবং তার বিগত ইতিহাস অনুসন্ধান কর নি এবং তার অন্তর্নিহিত গুণাগুণের কোনো জ্ঞান আহরণ কর নি, তখন সেই সমস্যা সম্বন্ধে তুমি যা বলবে, নিঃসন্দেহে সে সবই বাজে। এটা সবাই জানে যে আজেবাজে কথা সমস্যার সমাধান করে না, কাজেই তোমাকে কথা বলার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা অন্যায় হবে কেন? বেশ কিছু সংখ্যক কমরেড সবসময় চোখ বন্ধ ক’রে বাজে কথা বলে, একজন কমিউনিস্টের পক্ষে এটা লজ্জাকর। একজন কমিউনিস্ট কী করে তার চোখ বন্ধ ক’রে বাজে কথা বলতে পারে?
এ চলবে না!
এ চলবে না!
তোমাকে তথ্যানুসন্ধান করতে হবে!
তুমি আজেবাজে কথা বলতে পারবে না!
খ. সমস্যার তথ্যানুসন্ধান মানে সমস্যার সমাধান
তুমি কি কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারছো না? তাহলে, তুমি সেই সমস্যার বর্তমান অবস্থা ও তার ইতিহাস অনুসন্ধান করতে লেগে যাও। পুংখানুপুংখভাবে সমস্যাটির তথ্যানুসন্ধান করলে তার সমাধান করার উপায় তুমি পাবে। সমস্ত সিদ্ধান্ত অবশ্যম্ভাবীভাবে আসে তথ্যানুসন্ধানের পরে — আগে নয়। শুধু নির্বোধ ব্যক্তিই একা অথবা সদলবলে তথ্যানুসন্ধান না করেই মূর্খের মতো মাথা ঘামিয়ে ‘উপায় ভাবতে থাকে’, কিংবা ‘ধারণা গড়তে থাকে’। এ কথার উপর জোর দিতে হবে যে, এভাবে সম্ভবত কোনো কার্যকরী সমাধানে পৌঁছুতে পারা যায় না এবং কোনো ভাল ধারণা গড়ে তোলা যায় না। অন্য কথায়, সে ভুল সমাধানে ও ভুল ধারণায় পৌঁছুতে বাধ্য।
পরিদর্শনের কাজে নিযুক্ত এমন কমরেড তথা গেরিলা নেতা এবং দফতরের নবনিযুক্ত ক্যাডারের সংখ্যা কম নয় যারা কোনো জায়গায় গিয়েই রাজনৈতিক উক্তি করে বসে ও আত্মগরিমায় গটগট করে চলাফেরা করে, কোনো বিষয়ের কেবল উপরিভাগটা বা সামান্য কিছু জেনেই এটার সমালোচনা করে আর ওটার নিন্দা করে। এরকম নিছক আত্মমুখী বাজে কথা সত্যই ঘৃণ্য। এধরনের লোক অবশ্যই কাজে তালগোল পাকিয়ে ফেলতে বাধ্য, জনতার আস্থা হারায় এবং কোনো সমস্যার সমাধানে একেবারেই অক্ষম প্রমাণিত হয়।
নেতৃস্থানীয় অনেক লোকই যখন কোনো কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়, তখন তারা সমস্যার সমাধান করতে অক্ষম হয়ে কেবল দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। তারা ধৈর্য হারিয়ে ফেলে এবং অন্য জায়গায় বদলি হওয়ার জন্য আবেদন জানায় এই কারণ দেখিয়ে যে তাদের ‘এ ধরনের কাজ করবার মতো দক্ষতা নেই’ এবং তারা ‘এ ধরনের কাজ করতে পারে না’। এসব হলো কাপুরুষের কথা। নিজের পা দুটোর উপর ভর করে হাঁটতে আরম্ভ কর এবং তোমার দায়িত্বে যে এলাকা আছে তার প্রতিটি অংশে গিয়ে কনফুসিয়াসের মতো ‘প্রতিটি ব্যাপার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা’ কর[১] এবং তাহলে তুমি সমস্যার সমাধান করতে সমর্থ হবে, তা তোমার দক্ষতা যত কমই হোক না কেন। কারণ তোমার মাথাটা ঘরের বাইরে যাওয়ার আাগে যতই শূন্য থাক না কেন, ফিরে আসলে আর তা শূন্য থাকবে না, বরং সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় সব রকমের মালমসলা দিয়ে তা পূর্ণ হয়ে যাবে, এবং এভাবেই সমস্যার সমাধান হয়। সব সময় কি ঘরের বাইরে যেতেই হবে? সেটা অপরিহার্য নয়। তুমি পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচিত লোকদের ডেকে একটি তথ্যানুসন্ধান সভা করতে পার, সভা করতে পার যাতে তুমি যাকে কঠিন সমস্যা বলে মনে কর তার মূলে যেতে পার এবং বর্তমানে তার কি অবস্থা তা জানতে পার। আর এরপর তোমার কঠিন সমস্যার সমাধানও সহজ হয়ে যাবে।
তথ্যানুসন্ধান হচ্ছে ‘সুদীর্ঘ দশমাসব্যাপী গর্ভধারণের’ মতোই, আর সমস্যার সমাধান ‘কোনো সুন্দর প্রভাতে শিশুর জন্মলাভের’ মতো। বস্তুত: কোনো সমস্যার তথ্যানুসন্ধান করাই হচ্ছে তার সমাধান করা।
গ. বই পূজার বিরোধিতা করা
বইতে যা লেখা আছে তাই ঠিক — সাংস্কৃতিক দিক থেকে পশ্চাৎপদ চীনা কৃষকেরা এখন পর্যন্ত এই মনোভাব পোষণ করে। অদ্ভুত কথা এই যে আমাদের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে এমনও লোক আছে যারা আলোচনার সময় সর্বদাই বলে থাকে, ‘বইয়ের কোন জায়গায় এটা লেখা আছে, আমাকে দেখাও’। যখন আমরা বলি যে ঊর্দ্ধতন নেতৃস্থানীয় সংস্থা থেকে আসা নির্দেশ সঠিক, তখন আমরা তাকে এই কারণে সঠিক বলিনা যে সেটা ‘ঊর্দ্ধতন নেতৃস্থানীয় সংস্থা’ থেকে এসেছে, সঠিক বলি এই জন্য যে, সেই ‘নিদের্শের বিষয়বস্তু’ সংগ্রামের বাস্তব এবং মনোগত অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা মিটায়। ঊর্দ্ধতন নেতৃস্থানীয় সংস্থা থেকে এসেছে বলেই কোনো একটা নির্দেশকে বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা ও পরীক্ষা না করে অন্ধভাবে কার্যকরী করতে যাওয়া, এমন কাঠামোসর্বস্ব মনোভাব খুবই ভুল। এই কাঠামোবাদ যে সর্বনাশ করেছে সেটাই হলো পার্টির লাইন এবং রণকৌশল জনতার ভিতর শিকড় গেড়ে বসতে না পারার কারণ। ঊর্দ্ধতন নেতৃত্বের নির্দেশের বিরুদ্ধে আপাতদৃষ্টিতে কোনো আপত্তি না তুলে সম্পূর্ণ অন্ধভাবে তা কার্যকরী করতে যাওয়াটা সত্যিকারের কার্যকরী করা নয়, পরন্তু সেটি হচ্ছে তার বিরোধিতা করার বা তাকে বানচাল করার সবচেয়ে নিপুণ পদ্ধতি।
শুধুমাত্র বই থেকে সমাজবিজ্ঞানের গবেষণা করার পদ্ধতিও এই রকম চরম বিপজ্জনক। এ পদ্ধতি একজনকে এমন কি প্রতিবিপ্লবের দিকেও নিয়ে যেতে পারে। এর জলন্ত প্রমাণ এই যে চীনের বেশ কিছু সংখ্যক কমিউনিস্ট যারা সমাজবিজ্ঞানের গবেষণায় শুধুমাত্র বইয়ের মধ্যে একান্তভাবে ডুবে ছিলো তাদের অনেকেই প্রতিবিপ্লবী হয়ে গেছে। আমরা যখন বলি মার্কসবাদ সঠিক, তখন আমরা এজন্য তা বলি না যে মার্কস একজন ‘ঈশ্বর প্রেরিত মহাপুরুষ’ ছিলেন, বরং সঠিক বলি এই জন্য যে তাঁর মতবাদ আমাদের অনুশীলনে এবং আমাদের সংগ্রামে সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। সংগ্রামে মার্কসবাদের আমাদের প্রয়োজন আছে। তাঁর মতবাদ গ্রহণে ‘ঈশ্বর প্রেরিত মহাপুরুষ’ বলে কোনো কাঠামোসর্বস্ব বা মরমীবাদী ধারণা আমাদের মনে আসে না। মার্কসবাদী বই পড়া অনেকেই বিপ্লবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, অথচ নিরক্ষর শ্রমিকেরা প্রায়শ:ই মার্কসবাদকে খুব ভালভাবে আয়ত্ত করে থাকে। মার্কসবাদী বই আমরা অবশ্যই অধ্যয়ন করব, কিন্তু সে অধ্যয়নকে আমাদের দেশের বাস্তব অবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হবে। বইয়ের প্রয়োজন আমাদের আছে, কিন্তু বই পূজা বন্ধ করতে হবে — যে বই পূজা বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কবিহীন।
কিভাবে আমরা বই পূজা থেকে মুক্ত হতে পারি? একমাত্র পথ হলো — বাস্তব অবস্থার তথ্যানুসন্ধান করা।
ঘ. বাস্তব পরিস্থিতির তথ্যানুসন্ধান ব্যতিরেকে শ্রেণি শক্তির ভাববাদী গুণবিচার ও কার্যপ্রক্রিয়ায় ভাববাদী পথনির্দেশ ঘটতে বাধ্য যার পরিণতি ঘটে হয় সুবিধাবাদে আর না হয় আকস্মিক বিদ্রোহবাদে
এই সিন্ধান্তে তোমার সন্দেহ আছে কি? বাস্তব ঘটনা এই সিন্ধান্ত গ্রহণে তোমাকে বাধ্য করবে। তথ্যানুসন্ধান না করে রাজনৈতিক পরিস্থিতির গুণবিচার এবং সংগ্রামে নির্দেশ দিতে চেষ্টা কর, এবং তখন দেখবে এই রকম গুণবিচার বা নির্দেশ দেওয়া ভিত্তিহীন ও ভাববাদী হয় কিনা, এবং তা সুবিধাবাদী ও আকস্মিক বিদ্রোহবাদী ভ্রান্তিতে নিয়ে যায় কিনা। অবশ্যই তা হবে। কাজ আরম্ভ করার আগে সতর্ক পরিকল্পনা গ্রহণ করার অভাব এর কারণ নয়, বরং পরিকল্পনা তৈরি করার আগে সতর্কতার সঙ্গে বিশেষ সামাজিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার অভাবই এর ব্যর্থতার কারণ; এ রকমটি প্রায়ই আমাদের লাল ফৌজের গেরিলা সংস্থাগুলোতে হচ্ছে। লি খুইয়ের[২] মতো অফিসাররা দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার সময় কোনো বাদবিচার করছে না। ফল হচ্ছে এই যে শাস্তিভোগকারীরা মনে করছে যে তাদের সঙ্গে ন্যায্য ব্যবহার করা হচ্ছে না, কাজেই বিবাদ বিসংবাদ লেগে যায়, নেতারা তাদের সম্মান হারায়। লাল ফৌজে কি প্রায়ই এ রকমাটি হচ্ছে না?
আমাদের ভাববাদকে উচ্ছেদ করতে হবে এবং সবরকম সুবিধাবাদী ও আকস্মিক বিদ্রোহবাদী ভ্রান্তির বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে, কেবল এই ভাবেই আমরা জনসাধারণকে জয় করার এবং শত্রুকে পরাস্ত করার কাজে সফল হতে পারি। ভাববাদকে উচ্ছেদ করার এক মাত্র পথ হলো সর্বপ্রচেষ্টায় বাস্তব পরিস্থিতির তথ্যানুসন্ধান করা।
ঙ. সামাজিক এবং অর্থনৈতিক তথ্যানুসন্ধানের উদ্দেশ্য হলো শ্রেণি শক্তির সঠিক মূল্য নিরূপণ করা এবং এরপর সংগ্রামের জন্য সঠিক কৌশল সূত্রবদ্ধ করা
সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার তথ্যানুসন্ধান আমরা কেন করব? এ প্রশ্নের উত্তর হলো ওটা। কাজেই আমাদের উদ্দেশ্য হবে সমস্ত সমাজ-শ্রেণিগুলোর তথ্যানুসন্ধান করা, কোনো একটা বিচ্ছিন্ন সামাজিক ঘটনার নয়। সম্প্রতি, লাল ফৌজের চতুর্থ আর্মির সকল কমরেড সাধারণভাবে তথ্যানুসন্ধানের কাজে মনোযোগ দিয়েছে[৩], কিন্তু তাদের অনেকে যে পদ্ধতি প্রয়োগ করে তা ভুল । কাজেই তাদের তথ্যানুসন্ধানের ফলটা হচ্ছে মুদীর দোকানের হিসাবের মত তুচ্ছ অথবা শহরে এসে গল্প শুনলে কোনো অজ পাড়াগাঁয়ের লোকের কাছে যেমন আজগুবী মনে হয় তেমনি; অথবা পাহাড়ের চূড়া থেকে জনবহুল শহরকে দেখার মত। এ রকম তথ্যানুসন্ধানের দাম খুব কম এবং তাতে আমাদের মূল উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে না। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা জানা। তথ্যানুসন্ধানের ফলশ্রুতি এই রকম হওয়া উচিত যাতে প্রত্যেক শ্রেণির বর্তমান অবস্থার এবং তার বিকাশের ঊত্থান-পতনের একটা ছবি পাওয়া যায়। উদাহরণ স্বরূপ, যখন আমরা কৃষক শ্রেণির গঠন সম্বন্ধে তথ্যানুসন্ধান করব, তখন আমরা অবশ্য শুধু স্বত্বাধিকারী কৃষক, আধা স্বত্বাধিকারী কৃষক এবং প্রজা-কৃষকের — যারা প্রজাস্বত্বের সর্ম্পক অনুযায়ী নিজেদেরকে পৃথক করে — তাদের সংখ্যাই জানব না বরং বিশেষ করে ধনী কৃষক, মাঝারি কৃষক এবং গরীব কৃষকের — যারা শ্রেণি ও স্তর অনুযায়ী নিজেদের পৃথক করে — তাদের সংখ্যাও জানব। যখন আমরা ব্যবসায়ীদের গঠন সম্বন্ধে তথ্যানুসন্ধান করব, তখন শুধু আমরা বিভিন্ন ব্যবসা যথা শস্য, কাপড় ও ভেষজ লতাপাতা… ইত্যাদির ব্যবসায় নিযুক্ত লোকদের সংখ্যাই জানব না, বরং আমাদের বিশেষ করে ছোট ব্যবসায়ী, মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী এবং বড় ব্যবসায়ীর সংখ্যাও জানতে হবে। প্রত্যেক ব্যবসার অবস্থার তথ্যানুসন্ধান করলেই শুধু হবে না, বরং আমাদের বিশেষ করে তাদের শ্রেণি-সম্বন্ধও জানতে হবে। শুধু বিভিন্ন ব্যবসার মধ্যকার পারস্পরিক সম্বন্ধের তথ্যানুসন্ধান করলেই হবে না, বরং বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যকার সম্বন্ধও বিশেষ করে দেখতে হবে। আমাদের অনুসন্ধান কার্যের মূল পদ্ধতি হবে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির বিশ্লেষণ করা, আর চরম উদ্দেশ্য হবে তাদের পারস্পরিক সম্বন্ধকে বুঝা, শ্রেণিশক্তির একটা সঠিক মূল্য নিরূপণ করা, এবং তাপর বিপ্লবী সংগ্রামে কোন্ কোন্ শ্রেণি মূল-শক্তি যোগাবে, কোন্ কোন্ শ্রেণিকে মিত্র বলে আমাদের কাছে টানতে হবে, আর কোন্ কোন্ শ্রেণিকে উচ্ছেদ করতে হবে, সেটা নির্ধারণ করে সংগ্রামের জন্য সঠিক কৌশল সূত্রবদ্ধ করা। এটাই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।
কোন্ কোন্ শ্রেণির তথ্যানুসন্ধান করতে হবে? তারা হলো নিম্নরূপ:
শিল্পে নিযুক্ত সর্বহারা
হস্তশিল্প কর্মী
ক্ষেতমজুর
গরীব কৃষক
শহুরে গরীব
ভবঘুরে সর্বহারা
হস্তশিল্পী
ছোট ব্যবসায়ী
মাঝারি কৃষক
ধনী কৃষক
জমিদার
ব্যবসায়ী বুর্জোয়া
শিল্পপতি বুর্জোয়া
তথ্যানুসন্ধানের সময় এই সব শ্রেণির বা স্তরের অবস্থার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এখন আমরা যে সব এলাকায় কাজ করছি সেখানে শিল্পে নিযুক্ত সর্বহারা এবং শিল্পপতি বুর্জোয়া নেই, কিন্তু অন্য সবগুলো আমরা সব সময়ই দেখতে পাই। আমাদের সংগ্রামের কৌশল হলো এই সব শ্রেণি বা স্তরের সঙ্গে সম্বন্ধের কৌশল।
অতীতে আমাদের তথ্যানুসন্ধানের আর একটি বড় ক্রটি এই ছিলো যে আমরা শহরকে অবহেলা করে গ্রামকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতাম। এতে আমাদের অনেক কমরেডেরই শহুরে গরীবদের ও ব্যবসায়ী বুর্জোয়াদের প্রতি আমাদের রণকৌশলের দিকটা অস্পষ্ট থেকে যেত। সংগ্রামের ক্রমবিকাশ পাহাড় থেকে সমতলে নেমে আসতে আমাদের সক্ষম করেছিল[৪]। দৈহিক দিক দিয়ে আমরা নিচে নেমে এসেছি, কিন্তু মানসিক দিক দিয়ে আমরা এখনও ঊঁচু পাহাড়ে রয়েছি। গ্রাম এবং শহর দুটাকেই আমাদের বুঝতে হবে, নতুবা বিপ্লবী সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে আমরা অক্ষম হব।
চ. চীনের বৈপ্লবিক সংগ্রামে বিজয় নির্ভর করবে চীনা কমরেডদের চীনের অবস্থার উপলব্ধির উপর
গণতান্ত্রিক স্তরের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রে পৌঁছাই হলো আমাদের সংগ্রামের লক্ষ্য। এই কাজে, আমাদের প্রথম পদক্ষেপ হল জমিদার শ্রেণি, সাম্রাজ্যবাদ ও কুওমিনতাঙ শাসক গোষ্ঠীকে উৎখাত করার জন্য শ্রমিক শ্রেণির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে স্বপক্ষে টেনে এবং কৃষকসাধারণ ও শহুরে গরীবদের জাগিয়ে তুলে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পাদন করা, যা এই সংগ্রামের ক্রমবিকাশের পরে আসবে। এই মহান বৈপ্লবিক কর্তব্য সাধন করা সোজা বা সহজ কাজ নয়। এটা সর্ম্পূভাবে নির্ভর করছে সংগ্রামে সর্বহারা পার্টির সঠিক ও দৃঢ় কৌশলের উপর। যদি সর্বহারা পার্টির সংগ্রামের কৌশল ভুল হয়, সংকল্পহীন এবং দোদুল্যমান হয়, বিপ্লব অবশ্যান্তাবীরূপে সাময়িক পরাজয় বরণ করবে। এটা মনে অবশ্যই রাখতে হবে যে বুর্জোয়া পার্টিগুলোও সব সময় তাদের সংগ্রামের কৌশল সম্বন্ধে আলোচনা করে। কি করে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে সংস্কারমূলক প্রভাব বিস্তার করা যায় এবং তাদের বিভ্রান্ত করা যায়, কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব থেকে তাদের দূরে সরিয়ে নেওয়া যায়, ধনী কৃষকদেরকে দলে টেনে গরীব কৃষকদের অভ্যুত্থান কি করে খতম করে দেওয়া যায়, গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়ে বৈপ্লবিক সংগ্রামকে কি করে দমন করা যায়, এই সব নিয়ে বুর্জোয়ারা বেশ বিচার বিবেচনা করে। এরকম পরিস্থিতিতে শ্রেণি সংগ্রাম যখন তীব্র ও প্রকট আকার ধারণ করে তখন সর্বহারা শ্রেণিকে তার বিজয়ের জন্য সম্পূর্ণভাবে নিজের পার্টির — কমিউনিস্ট পার্টির — সংগ্রামের সঠিক ও দৃঢ় কৌশলের উপর নির্ভর করতে হয়। কমিউনিস্ট পার্টির সংগ্রামের সঠ্যিক ও অনমনীয় কৌশল অফিস ঘরে বসে থাকা কয়েকজন লোকের দ্বারা কোনো অবস্থাতেই রচিত হতে পারে না, গণ-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এটা বেরিয়ে আসে; অর্থাৎ এটা আসে বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই। কাজেই সব সময় আমাদের সামাজিক অবস্থাটা উপলব্ধি করতে হবে এবং বাস্তব তথ্যানুসন্ধান চালাতে হবে। যে সব কমরেড গোঁড়া, রক্ষণশীল, কাঠামোসর্বস্ব এবং অকারণ আশাবাদী, তারা মনে করে যে, বর্তমান সংগ্রামের কৌশল একেবারে নির্ভুল এবং পার্টির ষষ্ঠ জাতীয় কংগ্রেসের ‘দলিলপত্রের বইটি’[৫] চির বিজয়ের রক্ষা নিশ্চিতি দেয়, এবং শুধুমাত্র চলতি পদ্ধতিগুলি অনুসরণ করেই সব সময়ে জয়লাভ করতে পারা যাবে। এই ধারণাগুলো নিতান্তই ভুল এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়েই কমিউনিস্টদের যে অনুকূল নতুন পরিবেশ সৃষ্টি করা উচিত এই মতের সঙ্গে একেবারেই সঙ্গতিহীন; তারা পুরোপুরি একটা রক্ষণশীল লাইন কার্যকরী করে। এই রক্ষণশীল লাইন সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ করতে না পারলে তা বিপ্লবের খুব ক্ষতি করবে এবং ঐ সব কমরেডদেরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। স্পষ্টতঃ লাল ফৌজে আমাদের কিছু কমরেড আছে যারা সব কিছুকেই যেমন আছে তেমনি রাখাতেই সন্তষ্ট হয়, কোনো একটা জিনিষকে পরিপূর্ণভাবে বুঝবার চেষ্টা করে না এবং অকারণ আশাবাদী হয়ে বসে থাকে; এবং ‘এটা সর্বহারা’ এই বলে ভ্রান্ত ধারণা ছড়াতে থাকে। রোজ তারা পেট ভরে খায়, আর অফিস ঘরে বসে সারাদিন ঝিমাতে থাকে এবং তথ্যানুসন্ধানের জন্য এক পাও নড়ে না বা জনতার মাঝে যেতে চায় না। যখনই তারা তাদের মুখ খোলে, তখনই তাদের অসার উক্তি জনসাধারণকে অতিষ্ঠ করে তোলে। এই সব কমরেডদের জাগাবার জন্য আমাদের স্বর সপ্তমে তুলতে হবে আর চীৎকার করে তাদের বলতে হবে:
অবিলম্বে তোমাদের রক্ষণশীল ধারণাকে পরিবর্তন কর।
তোমাদের ঐ ধারণাগুলোকে প্রগতিশীল এবং সংগ্রামী কমিউনিস্ট ভাবধারা দিয়ে অপসারিত কর!
সংগ্রামে নেমে পড়!
জনতার মাঝে যাও এবং ঘটনার অনুসন্ধান কর!
ছ. তথ্যানুসন্ধানের কলাকৌশল
১। ঘটনা-তদন্তকারী সভা ডাক এবং আলোচনার মাধ্যমে তথ্যানুসন্ধানের কাজে হাত দাও।
এই হলো সত্যে পৌঁছানোর একমাত্র পথ, সিদ্ধান্ত টানার একমাত্র পথ। আলোচনার মাধ্যমে তথ্যানুসন্ধানের জন্য যদি ঘটনা-তদন্তকারী সভা না ডেকে কোন একজনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর কর তাহলে সহজেই ভুল হবে। এই সমস্ত সভায় আলোচনার জন্য যদি মূল প্রশ্ন উত্থাপিত না করে কেবল উদ্দেশ্যহীনভাবে প্রশ্ন কর, তাহলে সম্ভবতঃ তুমি একটা মোটামুটি সঠিক সিদ্ধান্তেও আসতে পারবে না।
২। ঘটনা-তদন্তকারী সভায় কোন ধরনের লোকের থাকা উচিত?
তারা হবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে পুরাপুরি পরিচিত লোক। বয়সের দিক দিয়ে দেখতে গেলে, বয়স্করাই উত্তম, কারণ তাঁরা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। কি চলছে তারা শুধু তাই জানে না, তারা ঘটনার কারণ ও ফলাফলও জানে। সংগ্রামে অভিজ্ঞ যুবকরাও এসব সভায় থাকবে, কারণ তাদের আছে প্রগতিশীল ধারণা আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। পেশার দিক দিয়ে শ্রমিক, কৃষক, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, মাঝে মাঝে সৈনিক, এবং কখনো এমন কি ভবঘুরেও থাকবে। স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, যে বিষয়ের সঙ্গে যার কোনো যোগাযোগ নেই সেই বিষয়ের আলোচনার সময়ে সে না থাকলেও পারে। যেমন, যদি তথ্যানুসন্ধানের বিষয় হয় বাণিজ্য, তাহলে সেখানে শ্রমিক, কৃষক বা ছাত্রের থাকার প্রয়োজন নেই।
৩। ঘটনা তদন্তকারী সভা বড় হবে, না ছোট হবে — কোনটা ভাল?
তথ্যানুসন্ধানকারীর সভা পরিচালনা করার দক্ষতার উপরই তা নির্ভর করেন। যদি তিনি সভা পরিচালনায় দক্ষ হন, তাহলে বারো কিংবা বিশ কিংবা আরও বেশি লোক তিনি ডাকতে পারেন। বড় সভার একটা সুবিধা আছে; উত্তর থেকেই মোটামুটি সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় (অর্থাৎ, সমগ্র কৃষক জনসংখ্যায় গরীব কৃষকের শতকরা হার পাওয়া), এবং মোটামুটি সঠিক সিদ্ধান্তও পাওয়া যায় (অর্থাৎ, ভূমি বণ্টন সমপাতিক হবে, না কি পরিমাণগত ভেদ থাকবে)। অবশ্য এই বড় সভার অসুবিধাও আছে, দক্ষ না হলে এসব সভা পরিচালনায় শৃংখলা রক্ষা করা তোমার পক্ষে কঠিন হবে। কাজেই সভায় যোগদানকারী লোকের সংখ্যা কি হবে তা নির্ভর করছে অনুসন্ধানকারীদের দক্ষতার উপর। কমপক্ষে কিন্তু তিন জন হতে হয় কারণ তা না হলে খবরাখবর প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়ার পক্ষে সীমিত হবে।
৪। তথ্যানুসন্ধানের জন্য একটা বিস্তৃত রূপরেখা তৈরি কর।
আগে থেকেই একটা বিস্তৃত রূপরেখা তৈরি করতে হবে; এবং তথ্যানুসন্ধানকারী প্রশ্ন করবে রূপরেখা অনুযায়ী, আর সভায় যোগদানকারীরা তার উত্তর দেবে। যে জিনিষটা পরিষ্কার হচ্ছে না কিংবা যার বিষয়ে সন্দেহ আছে, তা আলোচনার জন্য দিতে হবে। বিস্তৃত রূপরেখায় মূল বিষয়, অনুশীর্ষ এবং বিস্তৃত দফা সব অন্তর্ভুক্ত থাকবে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, ধরা যাক ‘ব্যবসা’ হলো মূল বিষয়; ‘কাপড়’, ‘খাদ্যশস্য’, ‘নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্য’ এবং ‘ওষুধপত্র’ হলো অনুশীর্ষ আবার কাপড়ের মধ্যে ‘মিলে-তৈরি’, ‘ঘরে-বোনা’, ‘সিল্ক’ ও ‘সার্টিন’— এগুলো হলো বিস্তৃত দফা।
৫। ব্যক্তিগতভাবে অংশগ্রহণ।
থানা সরকারের চেয়ারম্যান থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের চেয়ারম্যান পর্যন্ত, সেনাবাহিনীর অংশবিশেষে নায়ক থেকে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক পর্যন্ত, পার্টি শাখার সম্পাদক থেকে সাধারণ সম্পাদক পর্যন্ত — নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব রয়েছে এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকেই ব্যক্তিগতভাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার তথ্যানুসন্ধান করতে হবে; শুধুমাত্র রিপোর্ট পাঠ করার উপর নির্ভর করলে চলবে না। কারণ রিপোর্ট পাঠ করা আর তথ্যানুসন্ধান করা হচ্ছে দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিষ।
৬। গভীরভাবে অনুসন্ধান কর।
তথ্যানুসন্ধানের কাজে নবনিযুক্ত ব্যক্তিকে দু একটা অনুসন্ধান কাজ পুরোপুরিভাবে সম্পন্ন করতে হবে, যাতে সে যে কোনো একটা বিশেষ জায়গা সম্বন্ধে (ধর, একটা গ্রাম বা একটা শহর), অথবা একটা বিশেষ সমস্যা সম্বন্ধে (ধর, খাদ্যশস্য অথবা মুদ্রা) পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করতে পারে। একটা বিশেষ জায়গা বা সমস্যা সম্বন্ধে গভীর অনুসন্ধান ভবিষ্যতে অন্য জায়গা বা সমস্যার তথ্যানুসন্ধানের কাজকে সহজতর করবে।
৭। নিজে নোট রাখ।
তথ্যানুসন্ধানকারী শুধু ঘটনা তদন্তকারী সভায় সভাপতিত্বই করবে না এবং উপস্থিত ব্যক্তিদের সঠিক পথ নির্দেশই দেবে না, বরং সে নিজে নোট এবং ফলাফলের রেকর্ড রাখবে। তার হয়ে অন্যকে একাজ করতে বলাটা ভাল নয়।
টিকা
১. ‘কনফুসিয়াসের উদ্ধৃতি সংকলনের’ ৩য় গ্রন্থ, ‘পা ই’ থেকে নেয়া, এতে লেখা হয় ‘যখন কনফুসিয়াল কৌলিক মন্দিরে প্রবেশ করেন, তখন তিনি প্রতিটি ব্যাপার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন।’
২. লি খুই ছিলেন বিখ্যাত চৈনিক উপন্যাস ‘শুই হু চুয়ান’ (‘জলাবিলের বীরনায়কগণ’) এর অন্যতম নায়ক। এ উপন্যাসে উত্তর সোং বংশের (৯৬০-১১২৭) শেষের দিকের একটি কৃষক যুদ্ধ বর্ণনা করা হয়েছে। লি খুই ছিলেন সরল ও স্পষ্টবক্তা, এবং কৃষকদের বিপ্লবী আদর্শের প্রতি অত্যন্ত অনুগত, কিন্তু তিনি রুক্ষ ও অকৌশলী।
৩. কমরেড মাও সেতুং সর্বদাই তথ্যানুসন্ধানের উপর গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন এবং সামাজিক তথ্যানুসন্ধানকে নেতৃত্বের কাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য ও নীতি নির্ধারণ করার ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। কমরেড মাও সেতুঙের উদ্যোগে লাল ফৌজের চতুর্থ আর্মিতে তথ্যানুসন্ধানের কাজ ক্রমে ক্রমে বিকশিত হয়ে উঠেছিলো। তিনি নির্ধারিত করে দিয়েছিলেন যে সামাজিক তথ্যানুসন্ধানের কাজ অবশ্যই নিয়মিত কাজের অংশ হওয়া উচিত। লাল ফৌজের রাজনৈতিক বিভাগ তথ্যানুসন্ধানের জন্য বিস্তারিত ফরম তৈরি করে, এতে গণসংগ্রামের পরিস্থিতি, প্রতিক্রিয়াশীলদের অবস্থা, অর্থনৈতিক জীবন এবং পল্লী অঞ্চলে প্রতিটি শ্রেণির মালিকানাধীন ভূমির পরিমাণ, ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত হয়। লাল ফৌজ যেখানেই থাক না কেন, সর্বপ্রথমে সেখানকার শ্রেণি সম্পর্ক সম্বন্ধে অবহিত হয়েছে, তারপর জনসাধারণের প্রয়োজনের সাথে খাপ খায় এমন শ্লোগান রচনা করেছে।
৪. এখানে ‘পাহাড়’ বলতে বুঝায় চিংকাং পাহাড়ী এলাকা যা চিয়াংসী ও হুনানের সীমান্তে অবস্থিত; ‘সমতল’ বলতে দক্ষিণ চিয়াংসী ও পশ্চিম ফুচিয়ানের সমতলকে বুঝায়। ১৯২৯ সালের জানুয়ারি মাসে কমরেড মাও সেতুঙের নেতৃত্বে পরিচালিত লাল ফৌজের চতুর্থ আর্মির প্রধান শক্তি চিংকাং পাহাড় থেকে দক্ষিণ চিয়াংসী ও পশ্চিম ফুচিয়ানে অভিযান চালায় এবং ওখানে দুটি বিরাট বিপ্লবী ঘাঁটি এলাকা স্থাপন করে।
৫. ‘দলিলপত্রের বইটি’ বলতে বুঝায় ১৯২৮ সালের জুলাই মাসে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ষষ্ঠ জাতীয় কংগ্রেসে গৃহীত প্রস্তাবগুলি; এতে রাজনৈতিক প্রস্তাব এবং কৃষক প্রশ্ন, ভূমি প্রশ্ন ও রাজনৈতিক ক্ষমতার সংগঠন ইত্যাদি প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত ছিলো। ১৯২৯ সালের প্রথম দিকে লাল ফৌজের চতুর্থ আর্মির ফ্রন্ট কমিটি লাল ফৌজের পার্টি-সংগঠন এবং স্থানীয় পার্টি সংগঠনের মধ্যে বিতরণ করার জন্য এই সব প্রস্তাবকে পুস্তকাকারে প্রকাশিত করে।
মাও সেতুং বা মাও সে তুং বা মাও জেদং (ইংরেজি: Mao Tse-Tung; ২৬ ডিসেম্বর ১৮৯৩ – ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৬ খ্রি.) মার্কসবাদী বিপ্লবী তাত্ত্বিক, সাম্যবাদী রাজনৈতিক নেতা, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং চীন ভূখন্ডের প্রায় শতাব্দীকালের সামাজিক রাজনীতিক মুক্তি ও বিপ্লবের নায়ক। জাপানি দখলদার শক্তি এবং বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদার কুওমিনটাং নেতা চিয়াং কাইশেকের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা এবং সামাজিক বিপ্লবের জন্য চীনের অগণিত এবং অনুন্নত কৃষকদের সংঘবদ্ধ করার কৌশলী হিসেবে মাও সেতুং এক সময় সমগ্র পৃথিবীতে সংগ্রামী মানুষের অনুপ্রেরণাদায়ক উপকথায় পরিণত হয়েছিলেন। তিনি অনেক জটিল কথাকে জনগণের সামনে অত্যন্ত সহজভাবে উপস্থাপন করতেন। জনগণের সেবায় মানবেতিহাসের সমস্ত জ্ঞানকে তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন।