আলো ফোটানোর মুক্তিকামী কবিতাগ্রন্থ দোলন প্রভার “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে”

ভিনসেন্ট ‘ভ্যান গগ’য়ের টিউলিপ ফিল্ড-ছবি দিয়ে করা প্রচ্ছদ সহজেই দোলন প্রভার কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” বইয়ের শীর্ষককে যৌক্তিক ভাবে তুলে ধরে। যেখানে দেখা যায়, দু’পাশে দুটি খামার বাড়ি আর মাঝে একটাই চাষের জমি। ভেবে নেয়া যেতে পারে ওই জমি একক মালিকানাধীন নয়, তা যৌথ মালিকানাধীন। তাই স্বপ্নের পাখিরা এখানে যূথবদ্ধ হয়ে উড়ে বেড়ায়।

ভূমিকায় কবি লিখেছেন, “যখন প্রয়োজন বিদ্রোহের তখন কবিতা খুব সামান্যই ভূমিকা রাখতে পারে—” সম্পূর্ণ সহমত না হয়েও বলতে পারি, বিদ্রোহ একটি সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের হাতিয়ার। ওই হাতিয়ার প্রয়োগের আগে জন সংগঠিত করা ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে জন-মননকে চালনা করার জন্য যেমন মানুষের মাঝে থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যেতে হয় তেমনি সেই কাজকে ত্বরান্বিত করতে প্রয়োজন হয় সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানগুলোকে একত্রিত করারও। আর এই অনন্য সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোই হয়ে ওঠে পরিবর্তনের অবশ্যম্ভাবী অণুঘটক। কবিতাও ওই উপাদানের এক অন্যতম উপাদান। সোভিয়েত বিপ্লব বা ইতিহাস সাক্ষ্য অন্য বিপ্লব সংগঠিত হবার প্রাক্কালে কবিতাসহ অন্য সাহিত্য সংস্কৃতির ধারা সমাজ বদলের যে ঈঙ্গিত দিয়েছিল তা বিপ্লবের পথে বিরাট ভূমিকা দান করেছিল। তাই কবিতার ভূমিকা কখনোই ‘সামান্য’ হতে পারে না।

আলোচ্য কাব্যগ্রন্থে কবি হতাশা ঝেড়ে সোনালী দিনের দিক-নির্দেশ দেয়। তাই আজও নাগমতির বুকে আশার চর জেগে আছে বলে আমরা বেঁচে থাকার তাগিদ পাই। তাই তো নবাগত শিশুর মতো প্রতিটা দিন নতুন হয়ে ওঠে জীবনের কথা নিয়ে।

যতই কংক্রিটের ঢেউ নিয়ে আসুক ধনী আগন্তুক শহরের বুকে,তবুও বুকের মধ্যে থাকা সেই ‘চমৎকার গাছটি হাতছানি দেবে, ডাকবে মুক্তির স্বপ্ন দেখার জন্য। ‘ভোরের ডাকে’ সব জীর্ণতা ঝেড়ে এই গ্রহ একদিন সোনালী মুখর হবে। ‘অপরাজিতা’র স্পর্শে যা কিছু পুরনো তা ঝরে গিয়ে আগামীর পথ হয়ে উঠবে সুরময়। তাই অপেক্ষার হ্যামিলন সুরের স্রোত নিয়ে হাজির হয় সব সংকীর্ণ পথ চিরে।

যতই আঁধার ল্যাম্পপোস্টের নিচে তারুণ্যকে ফেলে রেখে যাক, তবুও তরুণেরা অবিরাম স্বপ্ন দেখে চলবে। কবি হিংসা ,যুদ্ধ, রক্তপাত কে শুধু কবিতার স্নিগ্ধতা দিয়ে ঢেকে রাখতে চায় না। সে বেছে নিয়েছে— স্থুল প্রেমহীণ পথ, ব্যক্তি ইচ্ছেকে ত্যাগ করে সে চলেছে নতুন দিনের খোঁজে।

আবার, দিন শেষের নিরবতাকে ঠেলে নিথর অথচ দৃঢ় মুঠো বাঁধা হাতের আত্মত্যাগ কে কবিতার শপথে আখর কাটে, এখানেই জন্ম নেয় নির্মাণে মগ্ন এক নির্ভীক যোদ্ধার।

কবি বিশ্বাস করে, পতিত গলি একদিন ফিরে পাবে তার কর্ম ব্যস্ততা, ঘর পাবে প্রেমিক যুগল, বাঁশির সুরে নগরী আবারও ফিরে পাবে তার চেনা ছন্দ।

আরো পড়ুন:  পুঁজিবাদের বিকাশের বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থের নাম ‘সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’

কবি হারিয়ে যেতে চায় তাঁর ভালবাসার মানুষ কে নিয়ে সেখানে, যেখানে সুরের ব্যাপারি বা শিকারিরা ফাঁদ পেতে বসে নেই। যেখানে স্বপ্ন পাখিরা বাধাহীন ডানা মেলতে পারে।

গতানুগতিক ভাবনার বাইরে যে ভিন্ন কিছু ভিন্ন ভাবনা ভিন্ন পথ আছে তাকেও খুঁজে চলে কবি। কবিরই আরেক অন্তর সত্ত্বা ‘পুরনো ঝামেলা’ কে পুড়িয়ে কবিতায় আগুয়ান হয়।

কবি ‘অহম’ কে ভেঙে নব সভ্যতা গড়ার ডাক দিচ্ছে যেখানে দিগন্তের সাথে পৃথিবীর প্রাণ মিলবে। তার জন্য সে কাস্তে রূপী সংকল্পে ‘সান’ (শান!) দিচ্ছে। কবি বোঝেন, যে কোনো সংগ্রামে বা যুদ্ধে হার-জিত থাকে। তাই তো পরাজয়কে শেষ পরিনতি ভেবে আজ যারা দুয়ারে খিল দিয়েছেন, আবারও তাঁদের ডাকতে হবে, পথে নামাতে হবে,আশা জাগাতে হবে।

পরের কবিতায় তাই সে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে নোনা শ্রমিকের বীর গাথা জীবনকে। যারা আজও সাগরের নোনা ফেনার সাথে লড়াই করছে।

বারবার তাঁর কবিতা ডাক দেয়, যখন স্বপ্ন গুলো ডুবে যাচ্ছে, যখন দুর্ভিক্ষ কড়া নাড়ছে দরজার গোড়ায়,তখন ‘এখনও ঘুমাও কেন শ্রমপাড়া’ বলে ডেকে তোলে তাঁর কবিতা কবির শ্রমজীবী মানুষের প্রতি অগাধ আস্থা তাই আজ তাদেরই নেতৃত্ব দিতে ডাকে তাঁর কবিতা।

পেয়ালার চুমুকে যে মুক্তির ঈঙ্গিত কবির কাছে ধরা পড়ে, তার থেকে সে পায় মনোযোগের নিবিষ্ট গভীরতা। মাত্র চার ছত্রের কবিতায় ‘সম্পর্ক’কে এক অনন্য শক্তিরূপে দেখতে পায়,যা এটম বোমের চেয়েও শক্তিশালী।

কবির আপোষহীন লড়াইয়ের অন্যতম প্রেরণার মানুষটিকে আমরা দেখতে পাই,যখন এম, এ মতিনের আত্মত্যাগের কথা তাঁর কবিতায় উঠে আসে। যার কাছ থেকে উল্টো পথে হাঁটার সাহস পান কবি।

‘অনুভূতি’কে শুধু রং বেরং এর মনোগ্রাহী চিত্রতে ফুটিয়ে তুললেই হবে না। কবির ইচ্ছা, সে ক্যানভাসে আঁকা হোক প্রান্তিক জনের সুখ দুঃখের সংগ্রামের ইতিহাস। তুলিতে সঞ্চারিত হোক পথে নামার আহ্বান। যে শিল্পী অকালে হারিয়ে গেছে,তাকে স্মরণ করে কবি খুঁজে চলেছে এক অনিবার্য রং-তুলি ‘যার’ স্পর্শে নিভন্ত প্রদীপ জ্বলে ওঠে।

বিবেকহীন চোখ যে নিরব বৃষ্টি পড়া দ্যাখে মাটির বুকে, কবির বিশ্বাস সেই মাটিতেই নব জন্মের বীজ বপন হয়। সেই বিশ্বাস পাঠকের হৃদয়ও ছুঁয়ে থাকে। ২০১৩ অব্দি ‘তুমি মৃত জেনেও’, তাকেই একাকীত্বের শিকল ভাঙার ডাক দেয়। ‘গাথুনি’তে গোপন প্রেমের সুবাস ছড়ায়।

আবার, ‘বিভাজন’এ যুগ যুগান্তরের দাসত্ব থেকে মুক্তি চেয়ে স্বপ্ন দেখে এক যৌথ খামারের।

২০১৪-র প্রথমেই কবি মোমবাতির স্নিগ্ধ আলোকে বদলে দেয় লড়াকু মশালে। যুগল প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হয় শ্রমিকের স্বপ্নের সাথে নিজেদের স্বপ্নকে মেলাবার জন্য প্রতিজ্ঞা করে কবি। বেঁচে থাকার বহুমাত্রিক সংজ্ঞায় ভালবাসা শক্তি আর প্রেমের প্রতিশ্রুতিতে অপেক্ষমান।

আরো পড়ুন:  শ্রমিকের জীবন চিত্র নিয়ে অঙ্কিত কবিতাগ্রন্থ দোলন প্রভার “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে”

তাঁর কবিতায় পরিচিত হই তামাটে মুখের, যে হাজারো তামাটে চোখের স্বপ্নের নায়ক। তাঁর কবিতা প্রশ্ন তোলে সোচ্চারে, কৃষকের, শ্রমিকের আর হকারের ন্যায্য পাওনা নিয়ে। কবিতা জানতে চায়,  শ্রমিকের আর কবিতার শত্রুদের প্রতীকের রঙ কেনো এক।

আলো আর ছায়ায় জন্ম নেয় যেসব কবিতা তারা যেতে চায় আগামীকে সুন্দর করার পথে। জুজুর ভয়ে যে প্রেমিকেরা এতদিন মাথা নত করে ছিল, ‘স্বপ্নবাজ বীর’ এর ছোঁয়ায় আজ তারই প্রতিবাদে জেগে ওঠছে রক্তের উঞ্চতা নিয়ে।

আলোর কাছে যেতে চাওয়া পতিত শরীর সব আবসাদ ঝেড়ে আজ হেঁটে যাচ্ছে শেওলাডাঙ্গার পথে। ‘ফুলবাড়ির ফুলগুলো’র শ্লোগান সব ব্যর্থতা দূরে ঠেলে দিয়ে শোনায় আলো আনার ধ্বনি কবিতায় ‘আশা’র অভয় বাণী আসে, রুক্ষতা সরিয়ে বৃষ্টিস্নাত স্বপ্ন বপন হবে একদিন। আবার, খুন হয়ে যাওয়া ধর্ষিত মেয়েটির বেঁচে থাকার ইচ্ছের গান শোনা যায় কবির সরদী লেখনিতে।

কখনও বা নির্জন মন-ঘরে টেবিল,কাগজ, কলমের পাশে যে সজীব চড়ুই ছানা বাস করে, তার  শব্দ-ছন্দ বর্ণ একত্রিত করে কবি উপহার দিতে চায় পরমাত্মীয়কে। মন সরে গেলে চেতনায় যে আবর্জনা জমতে পারে সেরকম সাবধান বাণী উচ্চারিত হয় ‘রেখা’ কবিতায়। ‘অরণ্যের মিছিল’ কবিতায় ফুটে ওঠে প্রেম ব্যক্তি জীবনের স্থুল চাওয়া ছেড়ে ছড়িয়ে পড়ুক দশদিকে। আবার, এই যে সুর এত আয়োজন, তা দেখে কি অনুভূতি হয়, সেই বোধের কাছে প্রশ্ন রাখেন কবি।

‘ব্যর্থতা’ কবিতায় কোন সে ‘কথা’ তাঁর কানে বেজেছিল যে আকাশের রঙ মুছে গেল! বিকেলের রোদ মলিন হয়ে উঠল! প্রশ্ন আসে, বসন্তের রূপ যদি পাল্টে যায় তবুও প্রেমের পাপড়ির কেনো ঝরে যাবে? সেকি অন্য প্রেমকে জায়গা করে দিতেই ঝরে গেল! তথাকথিত সভ্যতার দেয়ালে লেপ্টে থাকা ক্ষত দেখতে পাই বেদনার অক্ষরে।–বিকেলের কূলে বসে একাকী স্মৃতি চারণের কালে সে হারানো সম্পনকে আরও একবার আমন্ত্রণ জানায় হৃদমাঝারে রাখবে বলে।

মধ্যরাত যখন সারা মহল্লাকে ঘুমের দেশে নিয়ে যাচ্ছে, অনিমেষ দৃষ্টিতে জেগে থাকা হৃদয় নিয়ে কবি শোনায় রাত ১২টা কাহিনী। কোনো এক অশণি সংকেত পাঠ করে চলে। প্রেমহীনতার যন্ত্রনায় আকুল এক হৃদয় ছুটতে থাকে নিস্তব্ধ পথ ধরে। প্রেরণা জাগানো প্রেম আজ মৃত, আর তারই করুণ ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে চেনা পথ, চেনা গলি, চেনা মহল্লায় হেটে। জীবনের হতাশাকে স্বপ্নে রূপান্তর করতে কবি বারবার ডাক দেয় সেই স্বপ্নওয়ালাকে যে তাঁর ‘স্বপ্ন কাঠির ছোঁয়ায় নিয়ে আসবে রাঙা ভোর’।

একিদন ভোমরের সখ্যতার জন্য যে গাছ যত্নে ফুটিয়েছিলো ফুল, আজ  চাওয়া পাওয়ার হিসেবে সদা ব্যস্ত লোকালয়ে একা হয়ে যাওয়া সেই চালতা গাছ কাঁদছে। তবুও দেখা যায় শহরের ফাঁক ফোকর দিয়ে এখনও দু’একটা ঘুড়ি আকাশে ভাসে। সেগুলো শুধু ঘুড়ি নয় হারানো স্বপ্ন। — এটাই চালতা গাছের শান্তনা।

আরো পড়ুন:  প্রুধোঁ প্রসঙ্গে

কবি স্বপ্নকে বাস্তবতায় ধরতে চেয়ে বলছেন, স্বপ্নেরা শুধু খোকা খুকুর পায়ে পায়ে জড়িয়ে থাকে না, স্বপ্নরা বাস করে শ্রমিক কৃষক চালকের শ্রমেও, আবার তারই আবাস হয় শিল্পীর ছবিতেও।

কবি তাঁর কবিতায় যেমন প্রান্তবাসী সাঁওতালদের কথা ব্যক্ত করেছেন, তেমনি বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ত্রোকেও স্মরণ করেছেন। আর এখানেই কবি তাঁর দেশ কাল সীমানা পার করে হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক।

‘কবিতায় কবি এখন নিজেই অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকায় আছেন। এলোমেলো শব্দ গুলোকে ঠাঁই দেন তাঁর উষ্ণ বুকে,যাতে তারা একদিন আগামীর কবিতা হয়ে উঠতে পারে।

২০১৭-এর রঙিন চশমা পড়ে পুঁজিপতিরা যে বিবর্ণ সভ্যতাকে রঙ বাহারি করে দেখাতে চাইছে, কবি তার প্রকৃত বাস্তব রূপ তুলে ধরে ‘এপাশে শুণ্য হাড়ি’র রূপকে।

বারবার বলছেন, “ — তক্ষণও পোড়া ভূমি সক্ষম থাকে, একটি সবুজ পাতার জন্ম দিতে” কবি বয়ে নিয়ে আসে কোনো এক দুর্দান্ত সম্ভাবনার। প্রেমের যা কিছু শরীরী দাবি, তাকেই কবি এক অন্য অভিঘাতে দেখাতে চায়, বলতে চায় এই সব চাওয়াগুলো একত্রিত করে গড়ে তোলা যায় সাম্যের অনন্য যৌথ খামার।

যা হবার ছিল ঠিক তাই যদি না ঘটে তাহলে লালিত স্বপ্নরা ঝরে যেতে থাকে। কথা ছিল’ কবিতায় তারই ছবি ফুটে ওঠো- তিরিশ বছর পর চেনা ডাঙ্গিপাড়া অচেনা লাগে তাঁর। যন্ত্র সভ্যতার আগ্রাসনে তা যতই রূপ বদল করুক, আজও সেই ধান ক্ষেত নেচে ওঠে মাতাল হাওয়ায়।

সব শেষে কবি ঘোষনা করে, তাঁর কবিতাদের সে জন্ম দেয় অন্ধকার সূতিকাগৃহে, যাতে তারা “ আলো হয়ে বেরিয়ে আসতে পারে-”।

Leave a Comment

error: Content is protected !!