“স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” কবিতাগ্রন্থের আলোচনা

পূরবী সম্মানিত
কবি ও ছোটগল্পকার

স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে’ কবি দোলন প্রভার একটি ব্যতিক্রম ধর্মী কাব্যগ্রন্থ। মানুষ যখন মৌলিক সমস্যাগুলোকে পাশ কাটিয়ে শুধু ঘাস, ফুল, যৌনতা আর অন্ধ স্বপ্নের তোয়াজে ব্যস্ত যখন কথিত লেখকরা, পচা নর্দমায় অবরুদ্ধ যখন সাহিত্য সময়, “স্বপ্বের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” কাব্যগ্রন্থটি নিয়ে  দোলন প্রভা স্রোতের বিপরীতেই দাঁড়ালেন বৈকি।

যৌথ খামার, যৌথ স্বপ্ন, যৌথ পুঁজি সমাজতন্ত্র-কমিউনিজেই সম্ভব। যেখানে শ্রমিক, কৃষক, নারী, পুরুষ সমস্ত মেহনতী মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি। কবি তেমন সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেন বলেই বইটির এমন নামকরণ করেছেন। কবিতার বিষয় বস্তু কি? তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় এই নামকরণে।

বইটিতে মোট ৫৬টি কবিতা রয়েছে। কবিতাগুলি প্রকৃতি, প্রেম, ফুল, পাখি, নদী, মেঘ, পাহাড়, দূরের আকাশ, রেললাইন, সমসাময়িক রাজনীতি, অর্থনীতি, নারী বিষয়ক। সাধারণ ভাবে কবিতা যেসব বিষয় নিয়ে লিখা হয় এই কাব্যগ্রন্থের বিষয়বস্তুও তেমনি। কিন্তু এই কাব্যগ্রন্থ  বিশেষত্ব এখানেই যে কবিতাগুলি স্বপ্ন দেখায় নতুন দিনে সমাজতন্ত্র, কমিউনিজমের আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠার।

কবিতাগুলি আকাক্ষা করে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো সফল নেতৃত্বের। কবিতাগুলি শ্রমিকের, কৃষকের, মজুরের, পৃথিবীর তাবদ শোষিতের লড়াইয়ের সংগ্রাম কথা বলে। এ হলো কবিতাগুলির সামগ্রিক বৈশিষ্ঠ্য; আলাদা আলাদা করে যদি দেখি তাহলে দেখবো­ নাগমতির সুর, আগমণির পত্র, ভোরের ডাক, আপরাজিতা, আলোর কাছাকাছি ইত্যাদি কবিতায় কবির স্বপ্নগুলো জীর্ণতা ঝেড়ে প্রজাপতি হয়ে উড়ে যায় গ্রহের তেপান্তারে। ডাক দিয়ে যায় নবজাগরণের নদীতে জেগে ঔঠা নতুন চরের মতো নতুন দিনের স্বপ্ন দেখায়। নতুন সম্ভাবনায় স্বপ্ন দেখায়।

চারণ ভূমি, দিগন্ত- এই কবিতায় হ্যামিলনের বংশিবাদকের মতো নতুন সুর লাল নীল অর্থাৎ প্রেম ও দ্রোহের গান গাইবে। এ যুগ ছেড়ে নতুন শতাব্দি গড়তে নিয়ে যাবে। ‘সভ্যতা’ কবিতায় স্থবির সভ্যতা শ্রম ঘাম আর বঞ্চনার স্তুপের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে নতুন সভ্যতা গড়ার অঙ্গীকারে। তার জন্য কবির কাব্যিক শব্দগুলো কাস্তেতে শান দেয়।

‘তুমি মৃত জেনেও’ একটি চমৎকার কবিতা- ক্ষয়ে যাওয়া নগরী, পুরাতন জীণর্তা, পুরাতন অর্থনীতি ছেড়ে বহুদূর হেটে পায়ের ছাপ রাখার আহবান। তারপর নতুন পৃথিবীর জন্য বিপ্লব। ‘প্রতীক্ষা’, ‘নিরালা দুপুর’ কবিতাগুলোতে  একটি স্বপ্নের প্রতীক্ষায় একটি সুন্দর দিনের জন্য অপেক্ষা। ‘শ্রমপাড়া জেগে ওঠো’, ‘তৃপ্ত আমার খোঁজে’ নবজন্মের কবিতা। এই কবিতার বিষয়বস্তু- পুবের আকাশে লাল সূর্যটা বিপ্লবের ইঙ্গিত;  সময়গুলো শুধু প্রত্যাশা করে যোগ্য নেতৃত্ব।

আরো পড়ুন:  অধ্যয়ন

‘তোমার স্মৃতিতে জেগে ওঠে শক্তি’ কমরেড মতিনকে নিয়ে লিখা। যাঁর জন্মই আগুনের ভেতর, লড়াই বিপ্লব করাই ছিলো যাঁর জীবন লক্ষ্য। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত যিনি বিশ্বাস করতেন বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী। কমরেড মতিন একটি চেতনার নাম শক্তির নাম। তাঁর মৃত্যু একটি ট্র্যাজেডি।

‘বিভাজন’ কবিতা সমাজ বিকাশের ধারাবাহিকতায় শ্রেণী শোষণ, শ্রমশোষণ, অতপর যৌথ খামারর স্বপ্ন। ‘অনুভূতি’, ‘হারানো শিল্পী’, ‘গাঁধুনী’ কবিতায় বাঁচার স্বপ্ন দেখায়। ‘অপেক্ষা’, ‘যুগল প্রতীজ্ঞা’- প্রত্যেয়ের ঐক্যের শক্তি দেওয়া নেওয়া। শ্রমিকের স্বপ্নের সাথে নিজের স্বপ্নকে মেলাবার যুগল প্রতীজ্ঞা।

‘এখন তিনি হাজারো তামাটে চোখের স্বপ্ন হয়ে থাকেন’ কবিতার চরণটি ‘তামাটে মুখ’ কবিতার। যেখানে উল্লেখ আছে শ্রমিকের হাত-পা, ঘাম ঝরা শরীর সভ্যতা নির্মাণের হাতিয়ার। ‘তবু এগিয়ে চলা’— একটি প্রেমের কবিতা। নায়ক তাদের প্রেমকে প্রস্ফুটনের জন্য প্রথাহীন সমাজের কথা চিন্তা করেন-

‘এখন আমি নতুন দিনের খোঁজে তাদের দলে
যারা নতুনের গান গেয়ে নতুন স্বপ্ন আসবে বলে
চলছে নিজেদের আঁকা দিগন্তে ,
যাদের পদাঘাতে চূর্ণ হয়ে পিছনে পড়ে থাকবে
পুরনো নীতির আর্বজনা।’

রানা প্লাজা ধ্বসে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদ স্বরূপ কবিতা ‘নীরবতা’। ‘অপেক্ষা’ স্মৃতিচারণমূলক কবিতা; ভালো লাগার ক্ষণ যখন মলিন হয়ে যায় তখন মানুষ খুঁজে অন্য কিছু, কবির ভাষায়- ‘এখন বিকেলের নরম রোদ জল ভাল লাগেনা’ তাই আমারা অপেক্ষমান/ অসীম ভালবাসা শক্তি ও প্রেমের প্রতিশ্রতিতে’।

‘তৃপ্ত আমার খোঁজে’ কবিতায় কবি বলেছেন — জানি এখনো দীর্ঘ পথের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে জাগিয়ে রাখতে হবে, পরাজিতের দ্বারে কড়া নাড়িয়ে হবে পথে। তবেই যুগের সেনারা দূর্গম পথ চলার তৃপ্ত আমার খোঁজে, উঠবে পূবের আকাশে লাল সূর্য হয়ে।

‘ব্রহ্মশৈলী’, ‘মৃত প্রেম’, ‘বিকেলের কূলে’ কবিতাগুলো পড়লে মনে হবে অভিমানী প্রেম কাঁদছে নতুবা ব্যর্থ প্রেমের বহিঃপ্রকাশ! আশাকরি এই কবিতাগুলোতে পাঠক আলোড়িত হবেন। ‘ফুলবাড়ির ফুলগুলি’এর  বিষয়বস্তু ২০০৬ সালে ঘটে যাওয়া ফুলবাড়ির আন্দোলন ও পরবর্তি সময়। কয়লার খনি প্রকৃতি ও মানুষের জীবনে যে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে তারই প্রকাশ পায় কবিতার চরণে। এখানে ফুলবাড়ির ফুল বলতে যেখানের আন্দোলন কর্মীদের বুঝানো হয়েছে। এছাড়াও ফুলবাড়ির ব্যর্থতা, দালালের উৎপাত বিষয়গুলিও উঠে এসেছে।

আরো পড়ুন:  পুঁজিবাদের বিকাশের বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থের নাম ‘সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’

ফিদেল ক্যাস্ত্রোর মৃত্যুর পড়ে তাকে নিয়ে লেখা ‘তুমি এক নক্ষত্র’-তে কবি কিউবার উজ্জ্বল নেতৃত্বকে তার কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘আশা’, ‘কথা ছিল’ কবিতাগুলি শোষিত বঞ্চিত কৃষকের বেঁচে থাকার লড়ায়ের কথা তুলে ধরেছেন। ‘একটি মৃত্যু’তে অতি সুক্ষ্মভাবে ধর্ষিতার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষায় থাকা একটি ভোরের কাহিনী উঠে এসেছে। বেঁচে থাকার লড়াই, সমাজ-পরিবেশের অসহযোগিতা দ্বন্দ্ব খেলতে থাকে কবিতাটিতে।

‘স্বপ্নওয়ালা’ কবিতায় স্বপ্ন দেখায়; রাঙ্গা ভোর নতুন আলোর নতুন পৃথিবী। ‘ঘুড়ি’ কবিতায় স্বপ্নবাজ ছেলেরা স্বপ্ন দেখেনা। তাদের স্বপ্ন ছিনিয়ে নেয় যন্ত্রণার বীণ। হয়তো নেশা বা অন্য কোন নিষিদ্ধ জগৎ। তবু আকাশে উড়ে দু’ একটি স্বপ্নের ঘুড়ি। এই ঘুড়িই প্রতীকী আশা।

‘উর্বর’ কবিতাটি উর্বর ভূমি, উর্বর মগজের কথা বলা হয়েছে। সমাজ বিকাশের ধারাবাহিকতায় ছোঁয়া পাওয়া যায়। যুগের বণিকেরা ইতিহাসকে ঝোলায় বন্ধী করে, সময়ের সঞ্চয় নিয়ে গতিশীল ট্রেনের মতো ছুটে যায় এক যুগ থেকে আরেক যুগে। ‘কথা ছিল’ এই কবিতায় ভবিষতের স্বপ্ন ক্ষয়ে যাওয়ার হতাশা আছে।

‘কথা ছিল এবার ফসল যদি গোলায় আসে
আরেকটি হেমন্ত আসবে জীবন বুকে নিয়ে।
ক্থা ছিল এবার নতুন খড়ের ছাউনি দিলে
আমরা আবার বাঁচব নতুন ঘরে।’

ডাঙ্গিপাড়্য় ‘তিরিশ বছর পর দেখা হলো তোমার সাথে’ এই কথার দিয়ে কোনো স্মৃতি মনে করেন কবি। ডাঙ্গিপাড়ার পথে ঠিক আগের মতোই আছো ‘যেমন দেখেছিলাম ধানক্ষেতের মাঝে ছন্দে তোলা ঢেউ।—- এখনো আছো তুমি আমার চিরচেনা ডাঙ্গিপাড়ার পথ। যদিও জগতের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু অতীত স্মৃতি সে নতুনের মাঝেও অতীতের আবেগ, অনুভূতি খুঁজতে থাকে।

‘কবিতার জন্ম’তে দেখা যায় শ্রমিকের মধ্যেই কবি কবিতাকে দেখেন এবং কবিতা যেনো আলো ছড়াতে পারে সেই জন্য অন্ধকারকেই বেছে নেন আঁতুড়ঘর হিসাবে। তাই কবি লিখেছেন—

আমার কবিতা আমি অন্ধকারে জন্ম দেই
যাতে সে আলো হয়ে বেরিয়ে আসতে পারে।

‘রেখা’ কবিতায় আমাদের প্রতিবন্ধকতাগুলো খুঁজে দেখিয়েছেন কবি। ‘কবিতা জানাতে চায়’ কবিতায় কবি বলেছেন- একটি কবিতা জানাতে চায় কৃষকের ন্যায্য পাওনার ভাষা, সভ্যতা গড়ে যে শ্রমিক তার কতটুকু মজুরি? কবিতা যখন বিপ্লবের কথা বলে তখন কবিতা আর শ্রমিকের শত্রু এক হয়ে যায়। পুঁজি ভাণ্ডার উৎখাত করতে চায়। পুঁজিবাদের ধ্বংস অনিবার্য এ ক্ষেত্রে কবিতা অন্ত্র।

আরো পড়ুন:  কার্ল মার্কস রচিত পুঁজি গ্রন্থ প্রসঙ্গে একটি বিস্তারিত আলোচনা

এই কাব্যগ্রন্থের যেমন ইতিবাচক মূল্যায়ন তেমনি কিছু অসঙ্গতি চোখে পড়েছে যেমন ভূমিকায় কবি লিখেছেন, যখন শ্রমিক কৃষক অনবরত মৃত্যু মুখে থাকেন; তখন কবিতা একজনকেও বাঁচাতে পারেনা। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি অন্ত্র হিসাবে ভেবেই এগুলো লিখেছি। কিন্তু বাস্তবেই কবি তার কবিতাগুলোকে অন্ত্র হিসাবেই দাঁড় করিয়েছেন। কবিতাগুলোতে শোষণ নিপীড়নের বর্ণনা আছে, স্বপ্ন আছে, তাই কবিতা মানুষকে বাঁচাতে পারে বৈকি।

জনগণের পাশে থেকে যারা ছেলে ভুলানো গান শুনিয়ে শ্রম শক্তির মূল্য চুরি করে; সেই সব শত্রু চিহ্নিত করা হয়েছে এখানে। জনগণের শত্রু কতিপয় রাজনীতিকদের কারণে দেশের জনগণ নীপিড়িত; সেই নিপীড়িতের পক্ষে স্বপ্নবাজ সৈনিকেরা কবিতায় ন্যায্য দাবি তুলেছেন, বাস্তবে কবিতায় এ দিকগুলো বলা চলে খুবই ক্ষীণ ভাবে এসেছে। যা আরো বলিষ্ঠ হতে পারতো। আরো জীবন্ত হতে পারতো। হতে পারতো মুখ চোখ নিয়ে আরো দুরন্ত জীবন্ত অবয়বের। অন্যদিকে কয়েকটি কবিতায় শব্দের বাহুল্য লক্ষ্য করেছি। যেমন-

তুমি লিখেছো অনেক কাহিনী যা কখনো আকার পায় নি,
যে এসেছিলো একবার তোমার কাছে, তাকেও তুমি ঠাঁই দিয়েছ,
ভালোবেসে ধূলি জড়িয়েছ সাধারণ সব নিশিথ রাতে। (ডাঙ্গিপাড়া )

দিগন্ত কবিতায় ‘তাই আজ সান দিচ্ছি নিজেদের কাস্তেতে।’ লাইটি কবিতায় অতিরিক্ত বাক্য ব্যয় মনে হয়েছে। সমালোচনাটুকু বাদ দিলে আশার কথা এই যে কাব্যের প্রতিটা কবিতাই একটি বিশেষ মূল্যবোধকে প্রতিনিধিত্ব করছে। উর্ধ্বে তুলে ধরেছে। কবিতাগুলিতে কবি মানুষের জীবনের প্রেম, অ-প্রেমের প্রত্যাশাগুলোকে অত্যন্ত সাবলিলভাবে শিল্প, শৈলী ছাঁচে মূত-বিমুর্ততায় পাঠকের সামনে হাজির করেছেন নিপুনভাবে। যা পাঠককে আড়োলিত করবে; নতুন দুনিয়া গড়ার অঙ্গীকারে। আমি ও আমরা আটকে আছি, এই কবিতাগুচ্ছ এবং প্রত্যাশিত আগামী সংকলন; সেই অবরুদ্ধ সময় থেকে নতুন সম্ভাবনার সপক্ষে বিপ্লবী তত্ত্বে ও সংগ্রামে সামিল থাকবে এই প্রত্যাশা করি।

Leave a Comment

error: Content is protected !!