গোথা কর্মসূচির সমালোচনা – জার্মান শ্রমিক পার্টির কর্মসূচির ওপর পার্শ্বটিকা

১. ‘শ্রমই সকল সম্পদ ও সকল সংস্কৃতির উৎস এবং যেহেতু কার্যকর শ্রম একমাত্র সমাজের ও সমাজের মাধ্যমেই সম্ভব, সেহেতু সমাজের সকল সদস্য সমান অধিকার বলে অটুট পরিমাণে শ্রমফলের মালিক।’

অনুচ্ছেদের প্রথম অংশ : ‘শ্রমই সকল সম্পদ ও সকল সংস্কৃতির উৎস।’
শ্রম সকল সম্পদের উৎস নয়। শ্রমের মত প্রকৃতিও সমান পরিমাণেই ব্যবহার মূল্যের উৎস (এবং বৈষয়িক নিশ্চয়ই এই ব্যবহার-মূল্য দিয়েই গড়া!) আর এই শ্রম একটি প্রাকৃতিক শক্তির, মানুষের শ্রমশক্তির অভিব্যক্তি মাত্র। উদ্ধৃত উক্তিটি অবশ্য সমস্ত শিশুপাঠ্য পুস্তকে স্থান পেয়েছে এবং কথাটি যেহেতু সত্য সেহেতু তার সঙ্গে এইটুকু ধরে নেওয়া হয় যে, সংশ্লিষ্ট বস্তু এবং হাতিয়ারগুলির সাহায্যেই শ্রম সম্পন্ন হয়। কিন্তু যে শর্তটি কোন কথাকে অর্থসম্পন্ন করে তোলে, এই ধরনের বুর্জোয়া বাক্য দিয়ে সেটাই নীরবে এড়িয়ে যাওয়া কোন সমাজতন্ত্রী কর্মসূচি মঞ্জুর করতে পারে না। শ্রমের সমস্ত উপায় ও বিষয়ের আদি উৎস প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের শুরু যে পরিমাণে মালিকের মতো আচরণ করে, তাকে নিজের অধিকারভুক্ত জিনিসের মতো ব্যবহার করে, সেই পরিমাণে তার শ্রম ব্যবহার মূল্যের এবং সেইজন্য সম্পদেরও উৎস হয়ে ওঠে। শ্রম একটি অতি-প্রাকৃতিক সৃষ্টি শক্তি আরোপ করার বিশেষ কারণ বুর্জোয়াদের আছে, কেননা শ্রম প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল ঠিক সেই সত্য থেকেই সিদ্ধান্ত আসে যে, যে-লোকের নিজের শ্রম শক্তি ছাড়া আর কোন সম্পত্তি নেই তাকে সমাজ ও সংস্কৃতির সর্ব অবস্থাতেই তাদের ক্রীতদাস হতেই হবে, যারা শ্রমের বৈষয়িক পরিস্থিতিগুলির মালিক হয়ে বসেছে। তাদের অনুমতিক্রমে কেবল সে কাজ করতে এবং সেই হেতু বেঁচে থাকতে পারে।

আলোচ্য বাক্যটি যেভাবে দাঁড়িয়ে আছে, হয়তো খোঁড়াচ্ছে বললেই ভাল হয়, তাকে আপাতত সেইভাবে রেখে দেওয়া যাক। এর থেকে কী সিদ্ধান্ত আশা করা যায়? স্পষ্টতই এই :
‘শ্রমই যখন সকল সম্পদের উৎস, তখন সমাজে কেউ শ্রমফল হিসাবে ছাড়া অন্য কোনভাবে সম্পদ দখল করতে পারে না। সুতরাং সে যদি তার নিজে কাজ না করে, তবে সে অন্যের শ্রমের দ্বারা বেঁচে আছে এবং সে তার সংস্কৃতিও অর্জন করছে অন্যের শ্রমের বিনিময়ে।’

এ কথা না বলে, ‘এবং যেহেতু’ এই ভাষাগত সংযোগটির সাহায্যে দ্বিতীয় একটা প্রতিপাদ্য জুড়ে দেওয়া হল, যাতে প্রথমটি থেকে নয় পরেরটি থেকেই সিদ্ধান্ত টানা যায়।

অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় অংশ : ‘কার্যকর শ্রম একমাত্র সমাজের ভেতরে ও সমাজের মাধ্যমেই সম্ভব।’

প্রথম প্রতিপাদ্যে বলা হয়েছিল, শ্রমই সকল সম্পদ ও সকল সংস্কৃতির উৎস, সুতরাং শ্রম ছাড়া কোন সমাজের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। এবার আমরা উল্টো শুনছি যে সমাজ ছাড়া কোন ‘কার্যকর’ শ্রম সম্ভব নয়।

ঠিক এই একইভাবে বলা যেত যে, একমাত্র সমাজের ভেতরেই অকার্যকর শ্রম, এমনকি সমাজের পক্ষে হানিকর শ্রম পর্যন্ত শিল্পের শাখা হয়ে উঠতে পরে, একমাত্র সমাজের মধ্যেই অলস হয়ে বাঁচা সম্ভব ইত্যাদি ইত্যাদি- এক কথায় রুশোর সবখানিই টুকে দেওয়া যেত।

তাছাড়া ‘কার্যকর’ শ্রম জিনিসটাই বা কী? নিশ্চয়ই যে শ্রম থেকে বাঞ্ছিত কার্যকর ফল উৎপন্ন হয় সেই শ্রম। বন্য মানুষ (মানুষ তার বানরত্ব শেষ হওয়ার পর ছিল বন্য মানুষ) যখন পাথর দিয়ে কোন জানোয়ার মারে, ফল সংগ্রহ করে, ইত্যাদি তখন সেও তো ‘কার্যকর’ শ্রম করেছে।

তৃতীয়ত, এই সিদ্ধান্ত : ‘এবং যেহেতু কার্যকর শ্রম একমাত্র সমাজের ভেতরে এবং সমাজের মাধ্যমেই সম্ভব, সেহেতু সমাজের সকল সদস্যই সমান অধিকার বলে অটুট পরিমাণে শ্রমফলের মালিক।’

চমৎকার সিদ্ধান্ত! কার্যকর শ্রম একমাত্র সমাজের ভেতরে এবং সমাজের মাধ্যমেই যদি সম্ভব হয়, তাহলে সমাজ শ্রমফলের অধিকারী এবং তা থেকে ব্যক্তি শ্রমিকদের ভাগে বর্তাচ্ছে শুধু সেইটুকু, যা শ্রমের শর্ত অর্থাৎ সমাজ বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে না।

বস্তুত বিশেষ এক একটা কালের প্রচলিত সমাজব্যবস্থার ধ্বজাধারীরা বরাবরই এই প্রতিপাদ্যটিকে কাজে লাগিয়েছে। সরকার এবং তার সঙ্গে যুক্ত সবকিছুর দাবি আসে সর্বাগ্রে, কেননা এটা নাকি সমাজ শৃঙ্খলা বজায় রাখার সামাজিক সংস্থা। তারপর দাবি আসে বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত মালিকানার, কেননা বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত মালিকানাই হল সমাজের ভিত্তি ইত্যাদি। দেখা যাবে এই ধরনের অসার কথাকে ইচ্ছামতো ঘোরানো পেঁচানো যায়।

নিম্নলিখিতভাবে লিখনে তবেই অনুচ্ছেদটির প্রথম ও দ্বিতীয় অংশের মধ্যে কোন বোধগম্য যোগসূত্র থাকে :
‘একমাত্র সামাজিক শ্রমরূপেই’ অথবা যা একই কথা ‘সমাজের ভেতরে ও মাধ্যমে’, ‘শ্রম সম্পদ ও সংস্কৃতির উৎসে পরিণত হয়।’

এই প্রতিপাদ্যটি তর্কাতীতভাবে সঠিক, কেননা বিচ্ছিন্ন শ্রম (তার বৈষয়িক পরিস্থিতি আছে বলে ধরে নিয়ে) ব্যবহারমূল্য সৃষ্টি করতে পারলেও সম্পদ সৃষ্টি করতে পারে না।

কিন্তু অন্য এই প্রতিপাদ্যটিও তেমনি তর্কাতীত:
‘ঠিক যে পরিমাণে শ্রমের সামাজিক বিকাশ হতে থাকে এবং তার ফলে সে শ্রম সম্পদ ও সংস্কৃতির উৎসে পরিণত হয়, ঠিক সেই পরিমাণে শ্রমিকের মধ্যে দারিদ্র্য ও নিঃস্বতা এবং অ-শ্রমিকদের মধ্যে সম্পদ ও সংস্কৃতি বাড়তে থাকে।’

এযাবৎ সমস্ত ইতিহাসেরই এই নিয়ম। সুতরাং এক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল ‘শ্রম’ ও ‘সমাজ’ সম্পর্কে কেবল কতকগুলি সাধারণ কথামাত্র লিপিবদ্ধ না করে প্রত্যক্ষভাবে দেখিয়ে দেওয়া কীভাবে বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজে অবশেষে সেই বৈষয়িক ইত্যাদি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যা এই সামাজিক অভিশাপ দূর করতে শ্রমিকদের সক্ষম এবং বাধ্য করে।

আসলে অটুট পরিমাণ শ্রমফল লাসালীয় এই বুলিটিকে পার্টি পতাকার শীর্ষদেশে অঙ্কিত করার উদ্দেশ্যেই ভাষা ও ভাবে একান্ত ভুল এই গোটা অনুচ্ছেদটির অস্তিত্ব। শ্রমফল, সমান অধিকার প্রভৃতি সম্পর্কে পরে আমাকে আবার আলোচনা করতে হবে, কেননা পরবর্তী অংশে খানিকটা অন্য ছাঁদে এই একই কথা আবার বলা হয়েছে।

২. ‘আজকের সমাজে শ্রমের উপায়ে পুঁজিপতি শ্রেণির একচেটিয়া অধিকার। এরই থেকে উদ্ভূত শ্রমিক শ্রেণির পরমুখাপেক্ষিতাই তার সর্বপ্রকার দুর্দশার ও দাসত্বের কারণ।’

আন্তর্জাতিক নিয়মাবলি থেকে ধার করা বাক্যটির একটি মার্জিত সংস্করণ ভুল।
আজকের সমাজে শ্রমের উপায়ে জমির মালিক (জমিতে একচেটিয়া অধিকার এমনকি পুঁজির একচেটিয়ার ভিত্তি) এবং পুঁজিপতিদের একচেটিয়া। আন্তর্জাতিক নিয়মাবলির প্রাসঙ্গিক অনুচ্ছেদে একচেটিয়া অধিকারীদের এ শ্রেণি বা ও শ্রেণির উল্লেখ নেই। সেখানে বলা হয়েছে শ্রমের উপায়, অর্থাৎ জীবনের উৎসগুলির একচেটিয়া। জীবনের উৎসগুলি এই কথা যোগ দেওয়ায় যথেষ্ট পরিষ্কার হয়েছে যে শ্রমের উপায়ের মধ্যে জমিও অন্তর্ভুক্ত।

সংশোধনটি ঢোকানো হয়েছে কারণ লাসাল জমির মালিকদের বাদ দিয়ে কেবল পুঁজিপতি শ্রেণিকেই আক্রমণ করতেন, কেন করতেন তাও আজ সবাই জানেন। ইংল্যান্ডে পুঁজিপতিরা সাধারণত, যে জমির ওপর তাদের কারখানা দাঁড়িয়ে আছে সে জমিরও মালিক নয়।

৩. ‘শ্রমকে মুক্ত করতে হলে শ্রমের উপায়গুলিকে সমাজের সাধারণ সম্পত্তিতে উন্নীত করা এবং সামাজিক শ্রমের সমবায়িক নিয়ন্ত্রণ ও তার সঙ্গে শ্রমফলের ন্যায্য বণ্টন চাই।’

স্পষ্টতই, ‘শ্রমের উপায়গুলিকে সাধারণ সম্পত্তিতে উন্নীত করার’ জায়গায় ‘সাধারণ সম্পত্তিতে রূপান্তরিত করা’ পড়া উচিত। কিন্তু সেটা কেবল প্রসঙ্গক্রমে।

‘শ্রমফল’ এই কথাটির অর্থ কী? শ্রমের উৎপন্ন না তার মূল্য? যদি পরেরটি হয়, তাহলে কি তার সমগ্র মূল্যে, না ব্যবহৃত উৎপাদন-উপায়ের মূল্যের সঙ্গে শ্রম যে নতুন মূল্য যোগ করল কেবল এইটুকুই?

‘শ্রমফল’-এই ধারণাটাই অত্যন্ত শিথিল। সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক সংজ্ঞার জায়গায় লাসাল এই ধারণাটিকে বসিয়েছেন।

ন্যায্য বণ্টনই বা কী জিনিস?
বুর্জোয়ারা কি জোর গলায় বলে থাকে না যে, বর্তমান বণ্টন ব্যবস্থা ন্যায্য? আর সত্যই, বর্তমান উৎপাদন পদ্ধতির ভিত্তিতে তা কি একমাত্র ন্যায্য বণ্টন নয়? আইনগত সংজ্ঞার দ্বারাই কি অর্থনৈতিক সম্পর্ক নির্ধারিত হয় নাকি বিপরীত অর্থনৈতিক সম্পর্ক থেকেই আইনগত সম্পর্কের জন্ম? নানা সমাজতন্ত্রী গোষ্ঠীপন্থীদের মধ্যেও কি ন্যায্য বণ্টন সম্পর্কে নানা বিচিত্র ধারণা নেই?

ন্যায্য বণ্টন কথাটি এই সূত্রে কোন অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে তা বুঝতে হলে প্রথম অনুচ্ছেদ এবং এই অনুচ্ছেদটি একসঙ্গে ধরতে হবে। শেষেরটিতে ধরে নেওয়া এমন এক সমাজ যেখানে শ্রমের উপায়গুলি সাধারণের সম্পত্তি এবং সামগ্রিক শ্রম সমবায়িকভাবে নিয়ন্ত্রিত, আর প্রথম অনুচ্ছেদটি থেকে আমরা জানতে পারছি যে, ‘সমাজের সকল সদস্য সমান অধিকার বলে অটুট পরিমাণে শ্রমফলের মালিক।’

সমাজের সকল সদস্য? যারা কোন কাজ করে না তারাও? অটুট পরিমাণে শ্রমফলের তাহলে আর কী বাকি থাকে? নাকি, সমাজের যে সদস্যরা কাজ করে কেবল তারা? তাহলে, সমাজের সকল সদস্যের ‘সমান অধিকার’ কোথায় রইল?

অবশ্য, স্পষ্টতই ‘সমাজের সকল সদস্য’ এবং ‘সমান অধিকার’ এই উক্তিগুলি নিতান্তই কথার কথা। সারবস্তুটুকু এই যে, কমিউনিস্ট সমাজে প্রত্যেক শ্রমিকের অটুট পরিমাণে লাসালীয় ‘শ্রমফল’ পাওয়া চাই।

প্রথমে শ্রমোৎপন্ন এই অর্থে শ্রমফল কথাটি ধরা যাক, তাহলে সমবায়িক শ্রমফল হল সামগ্রিক সামাজিক উৎপন্ন।
তার থেকে এখন বাদ দিতে হবে :
প্রথমত, উৎপাদন উপায়ের যেটুকু ব্যবহারে ক্ষয় পেল তার পূর্তির জন্য একটা অংশ।
দ্বিতীয়ত, উৎপাদন সম্প্রসারণের জন্য আরও একটা অংশ।
তৃতীয়ত, দুর্ঘটনা, প্রাকৃতির দুর্যোগজনিত ব্যাঘাত ইত্যাদির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হিসাবে মজুত বা বীমা তহবিল।

‘অটুট পরিমাণ শ্রম ফল’ থেকে এগুলি বাদ দেওয়া অর্থনৈতিক দিক থেকে আবশ্যিক, এবং লভ্য উপায় ও বল অনুযায়ী এবং কিছুটা সম্ভাব্যতার হিসাব কষে এগুলির পরিমাণ নির্ধারিত হবে; কিন্তু ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠি দিয়ে কোনক্রমেই এর হিসাব করা যায় না।

বাকি থাকে সামগ্রিক উন্নয়নের অপরাংশ, ভোগের উপকরণরূপ যা ব্যবহার্য। এই অংশটিকে বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে দেয়ার আগে এর থেকে ফের বাদ দিতে হবে :
প্রথমত, উৎপাদনের অন্তর্ভুক্ত নয় এমন সব সাধারণ প্রশাসনিক খরচ।
বর্তমান সমাজের তুলনায় এই ভাগটি গোড়া থেকেই বেশ খানিকটা সঙ্কুচিত হবে এবং নতুন সমাজের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আরও কমতে থাকবে।
দ্বিতীয়ত, বিদ্যালয়, স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা ইত্যাদি প্রয়োজন সর্বজনীনভাবে মেটাবার জন্য নির্দিষ্ট অংশ।

বর্তমান সমাজের তুলনায় এই অংশ গোড়া থেকেই বেশ খানিকটা বেড়ে যাবে এবং নতুন সমাজের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আরও বাড়তে থাকবে।
তৃতীয়ত, অকর্মণ্য প্রভৃতিদের জন্য, এককথায় আজকালকার তথাকথিত সরকারি দরিদ্র-ত্রাণের মধ্যে যা পড়ে তার জন্য তহবিল।

লাসালের প্রভাবে কর্মসূচি অত্যন্ত সঙ্কীর্ণভাবে যে বণ্টনটুকুকেই মাত্র বোঝাচ্ছে, অর্থাৎ সমবায়ী সমাজের ব্যক্তি উৎপাদকদের মধ্যে উপকরণের যে অংশ বিতরণ করা হয়, সেই অংশে এতক্ষণে আমরা এসে পৌঁছালাম।

ইতিমধ্যে, ‘অটুট পরিমাণে শ্রমফল’ অলক্ষ্যে ‘হ্রাসপ্রাপ্ত’ ফলে পরিণত হয়ে গেছে। অবশ্য, স্বতন্ত্র ব্যক্তিরূপে উৎপাদক যে অংশ থেকে বঞ্চিত হয়, সমাজের একজন সদস্য হিসাবে সে প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে তারই থেকে উপকার পায়।

‘অটুট পরিমাণে শ্রমফল’ কথাটি যেভাবে অদৃশ্য হয়েছে এবার ‘শ্রমফল’ কথাটিও তেমনি একেবারে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।

উৎপাদন উপায়গুলির ওপর সাধারণ মালিকানার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সমবায়ী সমাজের মধ্যে উৎপাদকেরা তাদের উৎপন্নের বিনিময় করে না, ঠিক তেমনি, উৎপন্নে নিয়োজিত শ্রমও এখানে সেই উৎপন্নের মূল্যরূপে, তার এক বৈষয়িক গুণরূপে দেখা দেয় না, কেননা পুঁজিবাদী সমাজের বিপরীতে এখানে ব্যক্তিগত শ্রম আর পরোক্ষ নয়, থাকছে প্রত্যক্ষভাবে সমগ্র শ্রমের অঙ্গাঙ্গী অংশরূপে। তাই ‘শ্রমফল’ এই যে কথাটা দ্ব্যর্থক বলে আজকের দিনেই অগ্রাহ্য, তা একেবারেই অর্থহীন হয়ে পড়েছে।

আরো পড়ুন:  চৈত্রের দুপুরে দুই শ্রমিক ও আমার প্রেমিক

নিজস্ব বুনিয়াদের ওপর বিকাশ লাভ করেছে এমন এক কমিউনিস্ট সমাজ নয়, বরং তার বিপরীত, পুঁজিবাদী সমাজ থেকে উদ্ভূত হচ্ছে, ঠিক এমন কমিউনিস্ট সমাজই আমাদের আলোচ্য এবং তেমন সমাজ কি অর্থনৈতিক, কি নৈতিক, কি বুদ্ধিবৃত্তিগত, সমস্ত দিক থেকে যে পুরাতন সমাজ থেকে সে ভূমিষ্ট হয়েছে সেই মাতৃজঠরের জন্মচিহ্ন তখনও বহন করছে। তাই এখানে একজন উৎপাদক সমাজকে যতটা দিচ্ছে ব্যক্তিগতভাবে, সমাজের কাছ থেকে বাদছাদের পর, ঠিক ততটাই ফেরত পাচ্ছে। সমাজকে সে যা দিয়েছে তা হল তার ব্যক্তিগত শ্রম অবদান। উদাহরণস্বরূপ আলাদা আলাদা কাজের ঘণ্টাগুলি একত্র করে গঠিত হয় সামাজিক শ্রমদিন গঠিত হয়; নির্দিষ্ট একজন উৎপাদকের ব্যক্তিগত শ্রমকাল হচ্ছে সেই সামাজিক শ্রমদিনে তার অবদানটুকু, তাতে তার অংশটুকু। সমাজের কাছ থেকে সে এই মর্মে একটি প্রমাণপত্র পাবে যে (সাধারণ তহবিলের দরুন তার শ্রম বাদ দেওয়ার পর) সে এই পরিমাণ শ্রম দিয়েছে এবং সেই প্রমাণপত্র পেশ করে সে সমাজের ভোগোপকরণ ভাণ্ডার থেকে সমান শ্রম-মূল্যের ভোগবস্তু নিয়ে যেতে পারে। কোন একটা বিশেষরূপে সে সমাজকে যে পরিমাণ শ্রম দিয়েছে, অন্যরূপে সে ততটাই ফিরে পাচ্ছে।

স্পষ্টতই, এটা যেহেতু সমমূল্যের বিনিময়, সেই হেতু পণ্য বিনিময়ের এই নীতি এক্ষেত্রেও বলবৎ। আধার ও আধেয় পাল্টে গেছে, কারণ এই পরিবর্তিত অবস্থায় কেউ নিজের শ্রম ছাড়া আর কিছু দিতে পারে না, এবং অপরপক্ষে, ব্যক্তিগত ভোগোপকরণ ছাড়া আর কিছুই ব্যক্তির অধিকারে আসতে পারে না। কিন্তু, বিভিন্ন উৎপাদকদের মধ্যে এই ভোগোপকরণ বণ্টনের ব্যাপারে তুল্যমূল্য পণ্য-বিনিময়ের নীতিই বলবৎ থাকছে; কোনো বিশেষ রূপের নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রমের বিনিময় হচ্ছে অন্যরূপের একই পরিমাণ শ্রমের সঙ্গে।

এইজন্যই এক্ষেত্রে সমানাধিকার এখনও নীতির দিক থেকে বুর্জোয়া অধিকার মাত্র, যদিও নীতি ও প্রয়োগের মধ্যেকার বিরোধ আর নেই, অথচ পণ্য বিনিময়ের বেলায় তুল্যমূল্যের বিনিময় যা হয় সেটা কেবল গড়পরতাতেই, প্রতিটি বিশেষ ক্ষেত্রে নয়।

এটুকু অগ্রগতি সত্ত্বেও এ সমানাধিকার এখনও বুর্জোয়া কাঠামোয় সীমাবদ্ধ হচ্ছে। উৎপাদকেরা যে শ্রম দিয়েছে, তাদের অধিকারও সেই অনুপাতে। এখানে সমতা শুধু এইটুকু যে মাপা হচ্ছে সমান মানদণ্ড অর্থাৎ শ্রম দিয়ে।
কিন্তু, একজনের চেয়ে আরেক জনের বেশি শারীরিক ও মানসিক শক্তি থাকে, তাই সে একই সময়ে বেশি শ্রম দিতে পারে, অথবা বেশি সময় কাজ করতে পারে। আবার শ্রমকে মানদণ্ড হিসাবে গ্রহণ করতে হলে, তার স্থিতিকাল ও তীব্রতা দিয়েই তার সংজ্ঞা নির্ণয় করতে হবে, নইলে সে আর মানদণ্ড থাকে না। এই সমান অধিকার তাই অসমান শ্রমের জন্য অসমান অধিকার মাত্র। এখানে শ্রেণি বৈষম্য স্বীকার করা হল না, কারণ প্রত্যেকেই আর সবাইয়ের মতো শ্রমিক ছাড়া আর কিছুই নয়; কিন্তু বিভিন্ন ব্যক্তির বিশেষগুণের এবং তারই দরুন উৎপাদন ক্ষমতার অসমতাকে স্বাভাবিক বিশেষ অধিকার হিসাবে মৌন-স্বীকৃতি দেওয়া হল। সুতরাং আর সব অধিকারেরই মতো এই অধিকারটিও অন্তর্বস্তুর দিক থেকে অসমানতার অধিকার মাত্র। অধিকারের প্রকৃতিই এই যে, কেবল একটি সমান মানদণ্ড প্রয়োগের মাধ্যমেই তা সম্ভব; কিন্তু বিভিন্ন অসমান ব্যক্তিদের (আর অসমান না হলে তো বিভিন্ন ব্যক্তিই থাকতো না) একটি সমান মানদণ্ডে তুলনা সম্ভব কেবল এই অর্থে যে, সমান দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের দেখা হচ্ছে, একটি নির্দিষ্ট দিকই কেবল ধরা হচ্ছে- যেমন বর্তমান ক্ষেত্রে, তাদের দেখা হচ্ছে কেবল শ্রমিক হিসাবে, আর কিছুই দেখা হল না, বাকি সবকিছুই উপেক্ষা করা হল। তাছাড়া কোন শ্রমিক বিবাহিত, কেউ নয়, একজনের চেয়ে আরেক জনের সন্তান সংখ্যা বেশি ইত্যাদি ইত্যাদি। সুতরাং একই শ্রম সম্পন্ন করে এবং ফলে সামাজিক ভোগ্য ভাণ্ডারের সমান অংশ নিয়েও, কার্যত একজন আরেক জনের চেয়ে বেশি পাবে, একজন অপরের চেয়ে বেশি বিত্তবান হবে ইত্যাদি। এইসব ত্রুটি দূর করতে হলে অধিকারকে সমান নয়, অসমানই হতে হবে।

কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজ থেকে সুদীর্ঘ প্রসবযন্ত্রণার পর সদ্যোজাত কমিউনিস্ট সমাজের যে প্রথম স্তর সেখানে এইসব ত্রুটি অনিবার্য। অধিকার কখনও সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং তার দ্বারা শর্তবদ্ধ সাংস্কৃতিক বিকাশের চেয়ে বড় নয়।

কমিউনিস্ট সমাজের উচ্চতর স্তরে, শ্রমবিভাগের কাছে ব্যক্তির দাসোচিত বশ্যতার এবং তারই সঙ্গে দৈহিক ও মানসিক শ্রমের পারস্পরিক বৈপরীত্যের যখন অবসান ঘটেছে; শ্রম তখন আর জীবনধারণের উপায় মাত্র নয়, জীবনেরই প্রাথমিক প্রয়োজন হয়ে উঠেছে; তখন ব্যক্তির সর্বাঙ্গীন বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন শক্তিও বেড়ে গেছে, এবং সামাজিক সম্পদের সমস্ত উৎস অঝোরে বইছে- কেবল তখনই অধিকারের সঙ্কীর্ণ দিগন্তরেখাকে সম্পূর্ণ অতিক্রম করা সম্ভব হবে, সমাজ তার কেতনে মুদ্রিত থাকতে পারবে- প্রত্যেকে দেবে তার সাধ্য অনুসারে প্রত্যেকে পারে তার প্রয়োজন মত!

বিশেষ একটা পর্বে যেসব ধারণা কিছ্টুা অর্থপূর্ণ ছিল, কিন্তু আজ পরিণত হয়েছে অচল কথার জঞ্জালে, সেইসব ধারণা একদিকে আপ্তবাক্যের মতো আবার আমাদের পার্টির ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা, আবার অন্যদিকে যে বাস্তবধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি বহু চেষ্টার ফলে পার্টির মধ্যে সঞ্চার করা গিয়েছিল এবং আজ যা সেখানে মূল বিস্তার করেছে, অধিকার ও অন্যান্য তুচ্ছ ধারণা সম্পর্কে গণতন্ত্রী ও ফরাসি সমাজতন্ত্রী মহলে অতি প্রচলিত ভাবাদর্শগত প্রলাপের সাহায্যে তাকে বিপথগামী করা যে কত অপরাধ তা দেখাতে চেয়েছিলাম বলেই একদিকে ‘অটুট পরিমাণ শ্রমফল’ এবং অপরদিকে ‘সমান অধিকার’ এবং ‘ন্যায্য বণ্টন’ নিয়ে আমি এতটা বেশি বিস্তৃতভাবে আলোচনা করলাম।

এ পর্যন্ত যে বিশ্লেষণ দেওয়া হয়েছে তার কথা একেবারে ছেড়ে দিলেও, তথাকথিত বণ্টন নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি করা এবং তারই ওপর প্রধান জোর দেওয়া সাধারণভাবেও ভুল হয়েছে।

ভোগোপকরণের যেরূপ বণ্টন হোক না কেন, সেটা উৎপাদন পরিস্থিতির বণ্টনের ফল ছাড়া আর কিছুই নয়। শেষোক্ত বণ্টন কিন্তু উৎপাদন পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে। উদাহরণস্বরূপ, উৎপাদনের বৈষয়িক পরিস্থিতি পুঁজি ও জমির মালিকানারূপে অ-শ্রমিকদের অধিকারভুক্ত, আর জনগণ কেবলমাত্র উৎপাদনের ব্যক্তিগত পরিস্থিতির, শ্রমশক্তির মালিক এই হলো পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতির ভিত। উৎপাদনের উপাদানগুলি যদি এইভাবে বণ্টিত থাকে, তাহলে ভোগোপকরণের বর্তমান বণ্টন তা থেকে আপনা হতেই সৃষ্টি হয়। আবার উৎপাদনের বৈষয়িক পরিস্থিতি যদি শ্রমিকদেরই নিজস্ব সমবায়ী সম্পত্তি হয়, তাহলে তার থেকেও ঠিক একইভাবে ভোগের উপকরণগুলির ভিন্নতর এক বণ্টন দেখা দেবে। উৎপাদন পদ্ধতি থেকে স্বাধীনভাবে বণ্টনের বিচার ও আলোচনা এবং সেইহেতু, প্রধানত বণ্টনের ওপরেই নির্ভরশীল বলে সমাজতন্ত্রকে দেখাতে যাওয়াটা ইতর সমাজতন্ত্রীরা (এবং আবার তাদের কাছ থেকে গণতন্ত্রীদের একাংশ) বুর্জোয়া অর্থতত্ত্ববিদদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু অনেকদিন আগেই যখন প্রকৃত সম্পর্কটা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল, তখন আবার পিছু হঠা কেন?

৪. ‘শ্রম মুক্তি হওয়া চাই শ্রমিক শ্রেণির কাজ, তার তুলনায় অন্য সব শ্রেণি একাকার প্রতিক্রিয়াশীল জনসমষ্টি মাত্র।’

প্রথম চরণটি নেওয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক নিয়মাবলির প্রারম্ভিক কথাগুলি থেকে, কিন্তু মার্জিত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছিল: শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি হওয়া চাই শ্রমিকদের নিজেদেরই কাজ, আর এখানে তার বিপরীতে ‘শ্রমিক শ্রেণিকে’ মুক্তি সাধন করতে হবে- কীসের? ‘শ্রমের’। এর অর্থ যিনি পারেন বুঝে নিন।

ক্ষতিপূরণ রূপে দ্বিতীয় চরণটি হল একটি প্রথম শ্রেণির লাসালীয় উদ্ধৃতি: ‘তার (শ্রমিক শ্রেণির) তুলনায় অন্য সব শ্রেণি একাকার প্রতিক্রিয়াশীল জনসমষ্টি মাত্র।’

কমিউনিস্ট ইশতেহারে বলা হয়েছে, আজকের দিনে বুর্জোয়াদের মুখোমুখি যে সব শ্রেণি দাঁড়িয়ে আছে তার মধ্যে শুধু প্রলেতারিয়েত হল প্রকৃত বিপ্লবী শ্রেণি। অপর শ্রেণিগুলি আধুনিক যন্ত্রশিল্পের সামনে ক্ষয় হতে হতে লোপ পায়; প্রলেতারিয়েত হল সেই যন্ত্রশিল্পের বিশিষ্ট ও অপরিহার্য সৃষ্টি।

অচল হয়ে পড়া উৎপাদন পদ্ধতিতে সৃষ্ট সমস্ত সামাজিক অবস্থাগুলিকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায় যে সামন্তপ্রভুগণ ও নিম্ন মধ্যবিত্ত তাদের তুলনায়, বৃহৎ শিল্পের বাহক হিসাবে বুর্জোয়াদের এখানে বিপ্লবী শ্রেণি হিসাবে ধরা হয়েছে। তাই বুর্জোয়াদের সঙ্গে একত্রে তারা একাকার প্রতিক্রিয়াশীল জনসমষ্টি নয়।

অপরপক্ষে, শ্রমিক শ্রেণির বুর্জোয়াদের আপেক্ষিকে বিপ্লবী, কেননা সে নিজে বৃহৎ শিল্পের ভিত্তিতে বেড়ে ওঠে উৎপাদনের যে পুঁজিবাদী চরিত্রকে বুর্জোয়ারা চিরস্থায়ী করতে চায়, সেইটাকেই ঘুরিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। কিন্তু ইশতেহারে এ কথাও বলা হয়েছে যে, ‘তাদের প্রলেতারিয়েত রূপে আসন্ন রূপান্তরের কারণে ‘নিম্ন মধ্যবিত্ত’ বিপ্লবী হয়ে উঠেছে।

তাই, এদিক থেকে বিচার করলেও, শ্রমিক শ্রেণির কাছে এরা বুর্জোয়াদের এবং সেই সঙ্গে আবার সামন্তপ্রভুদের সঙ্গেও একজোটে ‘একাকার প্রতিক্রিয়াশীল জনসমষ্টি মাত্র’ এ কথা বলা অর্থহীন।

গত নির্বাচনের সময় কারিগর, ছোট শিল্প মালিক ইত্যাদি এবং কৃষকদের কাছে কি এটাই ঘোষণা করা হয়েছিল যে, ‘আমাদের আপেক্ষিকে তোমরা আর বুর্জোয়া ও সামন্তপ্রভুরা একাকার প্রতিক্রিয়াশীল জনসমষ্টি মাত্র’?

লাসালের বিশ্বস্ত অনুগামীরা তাঁর লেখা সুসমাচারগুলি যেমনভাবে জানেন, তাঁর নিজেরও তেমনি কমিউনিস্ট ইশতেহারটিও মুখস্ত ছিল। সুতরাং তিনি যে তাকে এমন স্থূলভাবে বিকৃত করেছেন তার একমাত্র উদ্দেশ্য হল বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী ও সামন্ততান্ত্রিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে তাঁর মৈত্রীটার সাফাই দেওয়া।
শুধু তাই নয়, উপরের অনুচ্ছেদটিতে তাঁর দৈববাণী-সম উক্তিটিকে একান্ত গায়ের জোরে আন্তর্জাতিকের নিয়মাবলি থেকে বিকৃতভাবে উদ্ধৃত অংশটির সঙ্গে সঙ্গতি না রেখে টেনে আনা হয়েছে। সুতরাং এটা একটা ধৃষ্টতা মাত্র। এবং বস্তুত শ্রী বিসমার্কের কাছে তা মোটেই অপ্রীতিকর নয়, বার্লিনে মারাত যার কারবার করেন তেমনি একটা সস্তা ঔদ্ধত্য।

৫. ‘সমস্ত সভ্য দেশের শ্রমিকদের পক্ষে যা এক, সেরূপ প্রচেষ্টার আবশ্যিক ফল হবে বিভিন্ন দেশের জনগণের আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ব, এ সম্পর্কে সচেতন থেকে শ্রমিক শ্রেণি সর্বাগ্রে আজকের দিনের জাতীয় রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে নিজের মুক্তি সাধনের চেষ্টা করে।’

‘কমিউনিস্ট ইশতেহারে’ এবং তারও আগের সমস্ত সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে লাসাল শ্রমিকদের আন্দোলনকে সঙ্কীর্ণতম জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বুঝেছিলেন। এখানে তাঁকেই অনুসরণ করা হচ্ছে এবং তাও আন্তর্জাতিকের কর্মকাণ্ডের পর!

আদৌ লড়াই করতে হলে শ্রমিক শ্রেণিকে যে স্বদেশে শ্রেণি হিসাবে নিজেকে সংগঠিত করতে হবে, আর তার নিজের দেশই যে তার সংগ্রামের আশু ক্ষেত্র, এ কথা স্বপ্রকাশ। এই অর্থে তার শ্রেণি সংগ্রাম জাতীয়, অবশ্য সারবস্তুর দিক থেকে নয়, ‘কমিউনিস্ট ইশতেহারের’ ভাষায় ‘রূপের দিক দিয়ে। কিন্তু আজকের দিনের জাতীয় রাষ্ট্রের কাঠামো, ধরা যাক জার্মান সাম্রাজ্য, নিজেই তাদের অর্থনীতির দিক থেকে বিশ্ববাজারের কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত, রাজনীতির দিক থেকে বিভিন্ন রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত ব্যবস্থার কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত। প্রত্যেকটি ব্যবসায়ী জানে যে, জার্মান বাণিজ্য একই সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্যও, আর হের বিসমার্কের মহত্ত্ব নিঃসন্দেহে ঠিক এইখানেই যে, তিনি এক ধরনের আন্তর্জাতিক নীতি অনুসরণ করে চলেন।

আর জার্মান পার্টি নিজের আন্তর্জাতিকতাবাদকে কোথায় নিয়ে এসে দাঁড় করাচ্ছে? এই চেতনাটুকুতে যে, তার সমস্ত প্রচেষ্টার ফল হবে জনগণের আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ব। বুর্জোয়া শান্তি ও স্বাধীনতা লীগ থেকে ধার করা একটা কথা, আর তাকেই বিভিন্ন শাসক শ্রেণি ও তাদের সরকারগুলির বিরুদ্ধে মিলিত সংগ্রামে শ্রমিক শ্রেণিগুলির আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্বের সঙ্গে সমার্থক বলে চালাবার মতলব। সেই জন্যেই জার্মান শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক কাজ সম্পর্কে এখানে একটি কথাও নেই! আর তার নিজের দেশের যে বুর্জোয়ারা তার বিরুদ্ধে অন্য সমস্ত দেশের বুর্জোয়াদের সঙ্গে ইতিমধ্যেই ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে এবং হের বিসমার্কের আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র নীতির বিপক্ষে তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে এইভাবেই!

আরো পড়ুন:  প্রলেতারিয়েত অষ্টাদশ শতক পরবর্তীকালের শ্রমশক্তি বিক্রিকারী শ্রমিক শ্রেণি

বস্তুত কর্মসূচিটির আন্তর্জাতিকতা অবাধ বাণিজ্য দলের আন্তর্জাতিকতার তুলনায় পর্যন্ত অনেক নিচু স্তরের। এরাও দাবি করে যে, তাদের প্রচেষ্টার ফল হবে জনগণের আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ব। কিন্তু সেই সঙ্গে তারা সে বাণিজ্যকে আন্তর্জাতিক করার জন্য কিছু করে, সব দেশের লোকই নিজ নিজ দেশে বাণিজ্য করে চলেছে, এই চেতনাটুকু নিয়েই আত্মসন্তুষ্ট হয়ে থাকে না।

শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সমিতির অস্তিত্বের ওপর শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক কার্যকলাপ কোনক্রমেই নির্ভরশীল নয়। এটা ছিল কেবল সেই কার্যকলাপের জন্য একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা গড়বার প্রথম প্রচেষ্টা। সে প্রচেষ্টা আন্দোলনে যে বেগ সঞ্চার করতে পেরেছিল তার মধ্যেই ছিল তার অক্ষয় সাফল্য, কিন্তু প্যারি কমিউনের পতনের পর এই প্রথম ঐতিহাসিক রূপটির মধ্যেই তার সিদ্ধি আর সম্ভব রইল না।

বিসমার্কের Norddeutsche তার প্রভুর সন্তোষ বিধান করে যখন ঘোষণা করল যে, জার্মান শ্রমিক পার্টি নতুন কর্মসূচিতে আন্তর্জাতিকতা বর্জন করেছে, তখন সে সম্পূর্ণই সঠিক কথা বলেছিল।

২.
‘এইসব মৌলিক নীতি থেকে শুরু করে, জার্মান শ্রমিক পার্টির সবরকম আইনসম্মত উপায়ে মুক্ত রাষ্ট্র এবং সমাজতন্ত্রী সমাজের জন্য লৌহকঠোর মজুরি-বিধি সমেত মজুরি প্রথা এবং সর্বপ্রকার শোষণের অবসানের জন্য, সমস্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক অসাম্য লোপের জন্য চেষ্টা করে।’
মুক্ত রাষ্ট্রের প্রসঙ্গে আমি পরে ফিরে আসব।

তাহলে, এখন থেকে, জার্মান শ্রমিক পার্টিকে লাসালের লৌহকঠোর বিধিতে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। কথাটা যাতে দৃষ্টি এড়িয়ে না যায়, তাই লৌহকঠোর মজুরি বিধি সমেত মজুরি প্রথার অবসান (কথাটা হওয়া উচিত মজুরি-শ্রমের প্রথা) এই কথা বলে এক অর্থহীন প্রলাপকে স্থান দেওয়া হয়েছে। মজুরি-শ্রমের অবসান যদি ঘটাতে পারি তাহলে স্বভাবতই তার বিধিরও অবসান হয়, তা সে বিধি লোহার হোক বা স্পঞ্জের হোক। কিন্তু মজুরি শ্রমের বিরুদ্ধে লাসালের সংগ্রামের প্রায় সবটাই এই তথাকথিত বিধিটিকে কেন্দ্র করে। তাই লাসালের গোষ্ঠী যে জিতেছে এ কথা প্রমাণ করার জন্য, মজুরি প্রথার অবসান করতে হবে লৌহকঠোর মজুরি বিধি সমেত, তাকে বাদ দিয়ে নয়।

একথা সবাই জানেন যে, কেবল গ্যেটের ‘মহান শাশ্বত লৌহকঠোর বিধি’ থেকে ধার নেওয়া লৌহকঠোর কথাটি ছাড়া লৌহকঠোর মজুরি বিধির কিছুই লাসালের নিজস্ব নয়। লৌহকঠোর কথাটির ছাপ দেখেই সাচ্চা ভক্তরা পরস্পরকে চিনে নেয়! কিন্তু আমি যদি এই বিধিটিকে লাসালের ছাপ সমেত, সুতরাং তার অর্থেই গ্রহণ করি, তাহলে সেই সঙ্গে আমাকে এই বিধিটি সম্পর্কে তাঁর প্রমাণ-পদ্ধতিও গ্রহণ করতে হবে। আর সেটি কী? লাসালের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই, লাঙ্গে দেখিয়েছেন যে, এটি হচ্ছে (লাঙ্গের নিজের দ্বারা প্রচারিত) ম্যলথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব। কিন্তু এই তত্ত্ব যদি সঠিক হয়, তাহলেও আবার মজুরি শ্রমের শতবার অবসান ঘটিয়েও আমি এই লৌহকঠোর বিধিটির অবসান করতে পারি না, কেননা বিধিটি সেক্ষেত্রে কেবল মজুরি শ্রমকেই নয়, প্রত্যেকটি সামাজিক ব্যবস্থাকেই শাসিত করবে। সরাসরি এরই ওপর ভিত্তি করে গত পঞ্চাশ বছরের বেশি অর্থতত্ত্ববিদরা প্রমাণ করে আসছেন যে, সমাজতন্ত্র দারিদ্র্যের অবসান ঘটাতে পারে না, প্রকৃতির মধ্যেই দারিদ্র্যের ভিত্তি রয়েছে, সমাজতন্ত্র কেবল তাকে সাধারণ করে তুলতে পারে, তাকে সমানভাবেই গোটা সমাজ জুড়ে ছড়িয়ে দিতে হবে।

কিন্তু এগুলি আসল কথা নয়। লাসাল যেরকম ভুলভাবে এই বিধিটি সূত্রবদ্ধ করেছেন সেকথা একেবারে ছেড়ে দিলেও, সত্যই অসহ্য পশ্চাদপসরণ হয়েছে এইখানে।

লাসালের মৃত্যুর পর থেকে আমাদের পার্টিতে এই বিজ্ঞানসম্মত উপলব্ধি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যে, আপাতদৃষ্টিতে যা মনে হয় মজুরি ঠিক তাই, অর্থাৎ, শ্রমের মূল্য- বা দর- নয়, বরং শ্রমশক্তির মূল্য বা দরের ছদ্মাবৃত রূপমাত্র। এর ফলে মজুরি সম্পর্কে এযাবৎ প্রচলিত সমগ্র বুর্জোয়া ধ্যান ধারণা এবং সেই ধারণার বিরুদ্ধে প্রযুক্ত সমস্ত সমালোচনাও চিরদিনের মত বিসর্জিত হয় এবং একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, মজুরি শ্রমিক খানিকটা সময় বিনা পয়সায় পুঁজিপতিদের জন্য (এবং অতএব উদ্ধৃত মূল্য ভোগে সেই পুঁজিপতির সহযোগীদের জন্যও) কাজ করে দিচ্ছে কেবল এই কারণেই তাকে তার নিজের ভরণপোষণের জন্য কাজ করতে অর্থাৎ বেঁচে থাকতে দেওয়া হয়; এবং গোটা পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার মূলকথা হলো কাজের দিন দীর্ঘতর করে বা উৎপাদনশীলতার বিকাশ করে, অর্থাৎ শ্রমশক্তির তীব্রতা বাড়িয়ে, এবং অন্যান্য উপায়ে এই বিনা পয়সার শ্রমকে বাড়ানো; এবং তারই জন্য, এই মজুরি শ্রম প্রথা হচ্ছে এক দাস প্রথা, এবং এমন এক দাস প্রথা, যার কঠোরতা শ্রমের সামাজিক উৎপাদন শক্তির বিকাশের অনুপাতে বাড়ে, তাতে সে শ্রমিকের পাওনা বাড়ুক বা কমুক। এই চেতনার প্রসার আমাদের পার্টিতে ক্রমান্বয়ে বাড়ার পর এখন লাসালের আপ্তবাক্যে ফিরে যাওয়া হচ্ছে, যদিও এটা জানা থাকার কথা যে, মজুরি জিনিসটা কী তাই লাসাল বুঝতেন না, বুর্জোয়া অর্থতত্ত্ববিদদের অনুসরণে বিষয়টির বাহ্যরূপকেই তার অন্তর্বস্তু বলে তিনি ধরে নিয়েছিলেন।

ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে যেন, শেষ পর্যন্ত দাস প্রথার রহস্য ভেদ করেছে এবং বিদ্রোহে ফেটে পড়েছে এমন একদল ক্রীতদাসের মধ্যে একজন যে ক্রীতদাস কখনও সেকেলে ধ্যান ধারণার বশ, সে বিদ্রোহের কর্মসূচিতে লিখে দিচ্ছে: দাস প্রথার অবসান চাই কেননা দাস প্রথায় ক্রীতদাসদের খোরাকি কোনক্রমেই একটা নির্দিষ্ট অতি নিম্ন সর্বোচ্চ সীমার বেশি হতে পারে না।

আমাদের পার্টিতে সর্বসাধারণের মধ্যে পরিব্যাপ্ত হয়েছে এমন এক চেতনার বিরুদ্ধে আমাদের পার্টির প্রতিনিধিরা যে এমন বিকট আক্রমণ করতে পারলেন এই ঘটনাটুকু থেকেই কি প্রমাণ হয় না যে, কী অপরাধী চপলতা এবং বিবেকহীনতার সঙ্গে এঁরা আপসমূলক কর্মসূচিটি রচনার কাজে হাত দিয়েছিলেন।

‘সমস্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক অসাম্য লোপ’ অনুচ্ছেদটির উপসংহারে এই অনির্দিষ্ট বাক্যাংশের বদলে বলা উচিত ছিল যে, শ্রেণি পার্থক্য অবসানের সঙ্গে সঙ্গে তার থেকে উদ্ভূত সমস্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক অসাম্য আপনা থেকেই মিলিয়ে যাবে।

৩.
‘সামাজিক সমস্যা সমাধানের পথ কাটার জন্য জার্মান শ্রমিক পার্টি রাষ্ট্রের সহায়তায় মেহনতি জনতার গণতান্ত্রিক উৎপাদক সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠার দাবি করে। শিল্প এবং কৃষিতে এই সব উৎপাদক সমবায় সমিতি সৃষ্টি করতে হবে এমন মাত্রায় যাতে তার মধ্যে থেকে সমগ্র শ্রমের সমাজতান্ত্রিক সংগঠন উদ্ভূত হয়।’

লাসালীয় লৌহকঠোর মজুরি-বিধির পর এবার পয়গম্বরী দাওয়াই। তার পথটি বেশ ভালভাবেই কাটা হয়েছে। বর্তমান শ্রেণি সংগ্রামের জায়গায় দেখা দিয়েছে খবরের কাগজের কলমনবীশদের এক বচন, ‘সামাজিক সমস্যা’, যার সমাধানের জন্য পথ কাটতে হবে। সমাজ রূপান্তরের বিপ্লবী প্রক্রিয়ার পরিবর্তে উৎপাদক সমবায় সমিতিগুলিকে প্রদত্ত রাষ্ট্রীয় সাহায্য থেকেই সমগ্র শ্রমের সমাজতান্ত্রিক সংগঠন উদ্ভূত হবে, আর সেই সমিতিগুলিকে সৃষ্টি করছে শ্রমিকেরা নয়, রাষ্ট্র। রাষ্ট্রীয় ঋণের সাহায্যে একটি নতুন রেলপথেরই মতো সুষ্ঠুভাবে একটা নতুন সমাজও গড়ে তোলা যায়- এ কল্পনা লাসালেরই যোগ্য।
অবশিষ্ট লজ্জাবোধটুকু থেকে রাষ্ট্রীয় সাহায্যকে মেহনতি জনতার গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে।

প্রথমত, জার্মানিতে মেহনতি জনতার অধিকাংশ প্রলেতারিয়েত নয়, কৃষক।
দ্বিতীয়ত, জার্মান ভাষায় গণতান্ত্রিক মানে জনশাসনানুগত। কিন্তু মেহনতি জনতার জনশাসনানুগত নিয়ন্ত্রণ, এর মানে কী দাঁড়ায়? আর বিশেষ করে এই মেহনতি জনতার ক্ষেত্রে, যারা রাষ্ট্রের কাছে এইসব দাবি পেশ করার মধ্যে দিয়ে এই পরিপূর্ণ সচেতনতাই ব্যক্ত করছে যে, তারা শাসন করে না আর শাসন করার মত পরিপক্ক হয়নি।

লুই ফিলিপের রাজত্বকালে, ফরাসি সমাজতন্ত্রীদের বিরোধিতা করে যে দাওয়াইটা ব্যুশে দিয়েছিলেন এবং Atelier পত্রিকার প্রতিক্রিয়াশীল শ্রমিকেরা যা গ্রহণ করেছিলেন, এখানে তার সমালোচনায় নামা বাহুল্য হবে। কর্মসূচিতে এই বিশেষ টোটকাটির স্থান দেওয়াটাই প্রধান অপরাধ নয়, সাধারণভাবে শ্রেণি আন্দোলনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে গোষ্ঠীবাদী আন্দোলনের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের দিকে পিছু হটাই প্রধান অপরাধ।

শ্রমিকেরা যে সমাজব্যাপী এবং সর্বপ্রথম তাদের নিজের দেশে স্বজাতিব্যাপী সমবায়ী উৎপাদনের অবস্থা সৃষ্টি করতে চায়, তার একমাত্র অর্থ এই যে, তারা উৎপাদনের বর্তমান অবস্থার পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করছে; রাষ্ট্রীয় সাহায্য সমবায়-সমিতি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। আর বর্তমান সমবায় সমিতিগুলি সম্পর্কে বলা যায় যে, সরকার বা বুর্জোয়াদের আশ্রয়ে নয়, যে পরিমাণে তারা শ্রমিকদের স্বাধীন সৃষ্টি কেবল সেইটুকুই তাদের মূল্য।

৪.
এবার গণতন্ত্র সম্পর্কিত অংশে আসা যাক।
ক। ‘রাষ্ট্রের মুক্ত ভিত্তি।’
সর্বপ্রথম দুই পরিচ্ছেদ অনুযায়ী, জার্মান শ্রমিক পার্টি মুক্ত রাষ্ট্রের জন্য চেষ্টিত। মুক্ত রাষ্ট্র সে জিনিসটা কী?

যে শ্রমিকেরা বিনীত প্রজার সঙ্কীর্ণ মনোবৃত্তি থেকে মুক্ত হয়েছে, রাষ্ট্রকে মুক্ত করা কোনক্রমেই তার লক্ষ্য নয়। জার্মান সাম্রাজ্যে রাষ্ট্র প্রায় রাশিয়ার রাষ্ট্রের মত মুক্ত। যে রাষ্ট্র সমাজের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এক সংস্থা, তাকে সমাজের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রাধীনে নিয়ে আসাই হলো মুক্তি। বর্তমানেও এই রাষ্ট্ররূপ রাষ্ট্রের স্বাধীনতাকে যতটা বেশি বা কম মাত্রায় সীমাবদ্ধ করে সে তত বেশি বা কম মাত্রায় মুক্ত।

অন্তত বর্তমান কর্মসূচি গ্রহণ করলে জার্মান শ্রমিক পার্টি এই কথাই প্রমাণ করবে যে তার সমাজতন্ত্রী ধারণা খুব ভাসাভাসা। কারণ বর্তমান সমাজকে (এবং ভবিষ্যতের যে কোন সমাজ সম্পর্কেও একথা প্রযোজ্য) বর্তমান রাষ্ট্রের (অর্থাৎ ভবিষ্যৎ সমাজের ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের) ভিত্তিরূপে না ধরে, তারা বরং রাষ্ট্রকে তার নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিগত, নৈতিক ও মুক্তিধর্মী বনিয়াদসম্পন্ন এক স্বাধীন সত্তারূপে বিবেচনা করছে।

তাছাড়া কর্মসূচিতে আজকের দিনের রাষ্ট্র, আজকের দিনের সমাজ এ কথার যে উচ্ছৃঙ্খল অপব্যবহার করা হয়েছে, এবং যে রাষ্ট্রের কাছে দাবি পেশ করা হচ্ছে তার সম্পর্কে আরও যেসব উচ্ছৃঙ্খল বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে সেটাই বা কী?

আজকের দিনের সমাজ হচ্ছে পুঁজিবাদী সমাজ, মধ্যযুগীয় ব্যবস্থার সংমিশ্রণ থেকে কম বেশি মুক্ত, প্রত্যেক দেশের বিশেষ ঐতিহাসিক বিকাশ দ্বারা কম বেশি পরিবর্তিত, কম বেশি বিকশিত; সমস্ত সভ্য দেশে তা বর্তমান। অপরপক্ষে, দেশের সীমানার সঙ্গে সঙ্গে আজকের দিনের রাষ্ট্র বদলে যায়। প্রুশো-জার্মান সাম্রাজ্যে যা, সুইজারল্যান্ডে রাষ্ট্র তা থেকে পৃথক, ইংল্যান্ডে রাষ্ট্র আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আলাদা। সুতরাং আজকের দিনের রাষ্ট্র একটি কল্পকথা মাত্র।

তা হলেও রূপের বহু বৈচিত্র্য সত্ত্বেও বিভিন্ন সভ্য দেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে এই বিষয়ে অভিন্নতা আছে যে প্রত্যেকটির বনিয়াদ হল পুঁজিবাদের দিক থেকে কম বেশি অগ্রসর আধুনিক বুর্জোয়া সমাজ। তাই এদের মধ্যে কয়েকটি মূলগত সাধারণ বৈশিষ্ট্য বর্তমান। এই অর্থে, আজকের দিনের রাষ্ট্রের কথা বলা যায় সেই ভবিষ্যতের সঙ্গে তুলনা করে, যখন তার বর্তমান মূল, বুর্জোয়া সমাজ আর বেঁচে থাকবে না।

এরপর প্রশ্ন আসে : কমিউনিস্ট সমাজে রাষ্ট্রের কি রূপান্তর ঘটবে? অন্যভাবে বলতে গেলে রাষ্ট্রের বর্তমান কর্তব্যের অনুরূপ কী কী সামাজিক কর্তব্য এখনও থেকে যাবে? কেবল বিজ্ঞানসম্মত পথে এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া যায়। রাষ্ট্র কথাটির সঙ্গে জনগণ কথাটির হাজার রকমের বিন্যাস ঘটালেও সমস্যার সমাধানে এক বিন্দুমাত্র এগোবে না।

আরো পড়ুন:  সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি হচ্ছে অস্তিত্বশীল সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার অর্থনীতিবিদ্যাগত তত্ত্ব

পুঁজিবাদী সমাজ আর কমিউনিস্ট সমাজ, এই দুইয়ের মধ্যে রয়েছে একটি থেকে অপরটিতে বিপ্লবী রূপান্তরের এক পর্ব। তারই সঙ্গে সহগামী থাকে একটি রাজনৈতিক উৎক্রমণ পর্ব, যখন রাষ্ট্র প্রলেতারিয়েতের বিপ্লবী একনায়কত্ব ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।

কিন্তু কর্মসূচিতে এ বিষয়ে কিম্বা কমিউনিস্ট সমাজের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র সম্পর্কে কোনো আলোচনা করা হয়নি।

তার রাজনৈতিক দাবিগুলির মধ্যে সেইসব পুরাতন সর্বজনবিদিত গণতান্ত্রিক জপমালার বাইরে আর কিছুই নেই: সর্বজনীন ভোটাধিকার, প্রত্যক্ষ আইনপ্রণয়ন ব্যবস্থা, জনগণের অধিকার, জনবাহিনী ইত্যাদি। এগুলি বুর্জোয়া জনতা পার্টি অথবা শান্তি ও স্বাধীনতার লীগের প্রতিধ্বনি মাত্র। আজগুবি আকারে অতিরঞ্জিত করে না দেখলে এইসব দাবিই ইতিমধ্যে অর্জিত হয়েছে। শুধু যে রাষ্ট্রে এসব আছে, সে রাষ্ট্র জার্মান সাম্রাজ্যের সীমানার মধ্যে অবস্থিত নয়, সে রাষ্ট্র রয়েছে সুইজারল্যান্ডে, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশে। এই ধরনের যে ভবিষ্যতের রাষ্ট্র সেটা আজকের দিনেরই রাষ্ট্র, যদিও তার অস্তিত্ব জার্মান সাম্রাজ্যের কাঠামোর বাইরে।

কিন্তু একটা কথা ভুলে যাওয়া হয়েছে। জার্মান শ্রমিক পার্টি যখন আজকের দিনের জাতীয় রাষ্ট্রের মধ্যে অর্থাৎ তার নিজের রাষ্ট্র, প্রুশো-জার্মান সাম্রাজ্যের মধ্যে কাজ করছে বলে সুস্পষ্ট ঘোষণা করছে- বস্তুতপক্ষে তা না হলে তার দাবিগুলির অনেকাংশে কোন মানেই থাকতো না, কেননা যা নেই কেবল তাইই দাবি করা যায়- সেক্ষেত্রে আসল কথাটা তার ভুল হওয়া উচিত হয়নি, অর্থাৎ এইসব চমৎকার টুকিটাকি রঙচঙে জিনিসগুলো দাঁড়িয়ে আছে জনগণের তথাকথিত সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির ওপর এবং তাই কেবলমাত্র একটা গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রেই তা প্রযোজ্য।

লুই ফিলিপ বা লুই নেপোলিয়নের শাসনকালে ফরাসি শ্রমিকদের কর্মসূচি যেভাবে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের দাবি করেছিল সেভাবে দাবি তুলবার সাহস যখন লোকের নেই- এবং তাই বিচক্ষণতা, কেননা বর্তমান অবস্থায় সাবধান হওয়া দরকার তখন যে রাষ্ট্র কেবল পার্লামেন্টীয় রূপ দিয়ে পালিশ করা, সামন্ততান্ত্রিক ভেজালের খাদ মিশ্রিত, বুর্জোয়া শ্রেণির প্রভাবে ইতিমধ্যেই প্রভাবিত, আমলাতান্ত্রিকভাবে বানানো আর পুলিশ রক্ষিত সামরিক স্বেচ্ছাতন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়, তার কাছে যার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রেই কোন অর্থ থাকতে পারে এমন সব দাবি উপস্থিত করা এবং তারপর সেই রাষ্ট্রকে উপরন্তু এই বলে আশ্বাস দেওয়া যে ‘আইনসম্মত উপায়ে’ তাকে এইসব জিনিস মানতে বাধ্য করা যাবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে, এই ছলনা করাও কোন দরকার ছিল না। সে ছলনা সৎও নয়, শোভনও নয়।

এমনকি যে ইতর গণতন্ত্র গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের মধ্যেই সত্যযুগের সন্ধান পায় এবং একথা ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করে না যে, বুর্জোয়া সমাজের ঠিক এই সর্বশেষ রাষ্ট্ররূপের মধ্যেই শ্রেণি সংগ্রামকে লড়ে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করার কথা, এমনকি সেই গণতন্ত্রও পুলিশের দ্বারা অনুমোদিত ও যুক্তির দ্বারা অননুমোদিত সীমানার মধ্যে রয়ে যাওয়া এই ধরনের গণতন্ত্রপনার চেয়ে পাহাড়প্রমাণ উঁচু।

জার্মান শ্রমিক পার্টি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তিরূপে দাবি করে : ক্রমবর্ধমান হারে একটিমাত্র আয়কর ইত্যাদি কথা প্রমাণ করছে যে, বাস্তবিকপক্ষে রাষ্ট্র কথাটি দিয়ে সরকারি শাসনযন্ত্র বা শ্রমবিভাগের ফলে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এক পৃথক সংস্থারূপ রাষ্ট্রকেই বোঝা হয়েছে। কর আর কিছু নয় সরকারি শাসনযন্ত্রেরই অর্থনৈতিক ভিত্তি। যে ভবিষ্যতের রাষ্ট্র সুইজারল্যান্ডে বর্তমান সেখানে এই দাবি বেশ ভালভাবেই পূরণ হয়েছে। আয়কর ধরে নেয় যে সামাজিক শ্রেণির আয়ের বিভিন্ন উৎস আছে আর তাই এ সমাজ পুঁজিবাদী সমাজ। তাই, লিভারপুলের অর্থ ব্যবস্থা সংস্কারকেরা, গ্লাডস্টোনের ভাই-এর নেতৃত্বে বুর্জোয়ারাও যে আলোচ্য কর্মসূচির মতো একই দাবি উপস্থিত করছে তাতে এতটুকুও আশ্চর্যের কিছু নেই।

খ। রাষ্ট্রের মানসিক ও নৈতিক কাজ হিসাবে জার্মান শ্রমিক পার্টি দাবি করে :
১. রাষ্ট্রের দ্বারা সর্বজনীন ও সমান প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা। সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক স্কুল গমন। বিনা বেতনে শিক্ষাদান।

সমান প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা? কোন ধারণা থেকে এই কথাগুলি লেখা হয়েছে? বর্তমান সমাজে (এবং একমাত্র বর্তমান সমাজ নিয়েই আলোচনা চলছে) সকল শ্রেণির জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা সমান হতে পারে, এই কথাই কি বিশ্বাস করা হচ্ছে? নাকি এই দাবি করা হচ্ছে যে, কেবলমাত্র সেই সমান শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠ, যা শুধু মজুরি শ্রমিক নয়, কৃষকদেরও আর্থিক অবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, উপরের শ্রেণিগুলিকেও সেইখানে নেমে আসতে বাধ্য করতে হবে?

‘সর্বজনীন বাধ্যতামূলক স্কুল গমন। বিনা বেতনে শিক্ষাদান।’ প্রথমটি জার্মানিতে পর্যন্ত আছে। দ্বিতীয়টি প্রাথমিক স্কুলের বেলায় আছে সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রের কোন কোন অঙ্গরাজ্যে যদি উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও বিনা বেতনে পড়ার ব্যবস্থা থেকে থাকে, তবে কার্যত তার অর্থ হচ্ছে, সাধারণ কর আদায় থেকে উচ্চ শ্রেণিগুলির শিক্ষার খরচা বহন করা। প্রসঙ্গত ক, (৫) ধারায় বিনা খরচায় বিচার ব্যবস্থার যে দাবি করা হয়েছে তার সম্পর্কেও একই কথা খাটে। ফৌজদারি বিচার সব দেশেই বিনা খরচায় চলে। দেওয়ানি বিচারের বিষয় প্রায় একান্তই সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ এবং তাই তাতে জড়িত থাকে প্রায় একান্তই মালিক শ্রেণিরা। তাহলে কি জাতীয় তহবিলের খরচায় তারা মামলা চালিয়ে যাবে?

বিদ্যালয় সম্পর্কিত অনুচ্ছেদে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে মিলিয়ে অন্তত টেকনিক্যাল (তত্ত্বগত এবং ব্যবহারিক) স্কুল দাবি করা উচিত ছিল।
‘রাষ্ট্রের দ্বারা প্রাথমিক শিক্ষা’ সম্পূর্ণভাবে আপত্তিজনক। প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত ব্যয়, শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় গুণাবলি, শিক্ষার বিভিন্ন শাখা নির্ধারণ প্রভৃতি সাধারণ আইনে নির্দিষ্ট করে দেওয়া, আর যুক্তরাষ্ট্রে যেভাবে করা হয় সেইভাবে, এই বিধিবদ্ধ নির্দেশ পালিত হচ্ছে কি না তা রাষ্ট্রীয় পরিদর্শকদের দিয়ে দেখা, অথবা রাষ্ট্রকে জনগণের শিক্ষাদাতারূপে প্রতিষ্ঠা করা- এ দুয়ের মধ্যে অনেক তফাত! বরং সরকার ও গির্জা উভয়কেই বিদ্যালয়ের ওপর কোন প্রভাব বিস্তার করা থেকে সমান দূরে রাখা দরকার। বিশেষ করে প্রুশো-জার্মান সাম্রাজ্যে (এবং এখানে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের কথা বলা হচ্ছে এই বলে কোন বাজে ফিকিরের আশ্রয় নেয়া চলবে না, এ বিষয়ে ব্যাপারটা কী তা আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি) রাষ্ট্রেরই বরং জনসাধারণের কাছ থেকে খুব কঠোর শিক্ষা পাওয়া প্রয়োজন।

কিন্তু এত গণতান্ত্রিক বাগাড়ম্বর সত্ত্বেও, রাষ্ট্রের ওপর লাসালীয় গোষ্ঠীর দাসসুলভ বিশ্বাসের দ্বারা অথবা সমানই খারাপ কথা, অলৌকিক ঘটনায় গণতান্ত্রিক বিশ্বাসের দ্বারা সমগ্র কর্মসূচিটি আগাগোড়া কলঙ্কিত, কিংবা বলা যেতে পারে যে, এটি হচ্ছে সমাজতন্ত্র থেকে সমান দূরবর্তী এই দুই ধরনের অলৌকিক বিশ্বাসের মধ্যে এক আপস।

বিজ্ঞানের স্বাধীনতা উক্তিটি প্রুশীয় সংবিধানের এক অনুচ্ছেদে রয়েছে। তবে এখানেও সে কথা কেন?

বিবেকের স্বাধীনতা- Kulturkampf -এর এই যুগে উদারপন্থীদের পুরান ধ্বনির কথা স্মরণ করিয়ে দেবার ইচ্ছা যদি হয়েই থাকে তাহলে সে কথাটা একমাত্র এইভাবেই বলা যেত : ‘পুলিশের নাক ঢোকানো ছাড়াই, প্রত্যেকের নিজ নিজ ধর্মীয় ও শারীরিক প্রয়োজন পূরণ করতে পারা চাই।’ কিন্তু শ্রমিক শ্রেণির পার্টির এই প্রসঙ্গে অন্তত এই প্রত্যয়টুকু প্রকাশ করা উচিত ছিল যে, বুর্জোয়া বিবেকের স্বাধীনতা প্রকৃতপক্ষে সবধরনের বিবেকের ধর্মীয় স্বাধীনতা সহ্য করা ছাড়া আর কিছু নয়, অথচ শ্রমিক পার্টির নিজস্ব চেষ্টা হল বরং বিবেককে ধর্মের কুহক থেকে মুক্ত করা। অবশ্য বুর্জোয়া স্তর অতিক্রম না করাই যেন স্থির হয়েছে।

আমার বক্তব্য শেষ হয়ে এসেছে, কেননা কর্মসূচিতে এরপর যে পরিশিষ্ট রয়েছে সেটি তার বৈশিষ্ট্যসূচক অঙ্গ নয়। সুতরাং এ প্রসঙ্গে আমি খুব সংক্ষেপেই সারতে পারি।

২. ‘স্বাভাবিক কর্মদিন’।
অন্য কোন দেশে শ্রমিক পার্টি এরকম একটি অনির্দিষ্ট দাবি করে ক্ষান্ত হয়নি, বাস্তব পরিবেশ অনুযায়ী যা স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে, সবক্ষেত্রেই সে অনুসারে কর্মদিনের দৈর্ঘ্য তারা বেঁধে দিয়েছে।

৩. ‘নারী শ্রমের সঙ্কোচ ও শিশু শ্রমের নিষিদ্ধকরণ’।
নারী শ্রমের সঙ্কোচের ব্যাপারটা কর্মদিন নির্ধারণের অন্তর্ভুক্ত হওয়া চাই, কেননা সেটা কর্ম দিনের দৈর্ঘ্য, বিরতি ছুটি ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত। অন্যথায় এর একমাত্র অর্থ এই হতে পারে যে, শিল্পের যে সব শাখা স্ত্রীলোকদের শরীরের পক্ষে বিশেষ অস্বাস্থ্যকর অথবা নৈতিক দিক থেকে স্ত্রীজাতির পক্ষে বিশেষ আপত্তিজনক সেইসব শাখায় স্ত্রীলোকদের কাজ করতে না দেওয়া। তাই যদি উদ্দেশ্য হয়, তবে সে কথা খুলে বলা উচিত ছিল।

‘শিশু শ্রমের নিষিদ্ধকরণ’। এখানে বয়সের সীমা বলে দেওয়া একান্ত অপরিহার্য। শিশু শ্রমের সাধারণ নিষিদ্ধকরণ বৃহৎ শিল্পের অস্তিত্বের পক্ষে অসঙ্গতিপূর্ণ, তাই এ কেবল একটি অন্তঃসারশূন্য সদিচ্ছামাত্র।

এই ব্যবস্থার রূপায়ন সম্ভবও হতো, তাহলেও তা হতো প্রতিক্রিয়াশীল, কেননা বিভিন্ন বয়ঃক্রম অনুযায়ী কাজের সময় কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং শিশুদের সুরক্ষার জন্য অন্যান্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলে, অল্পবয়স থেকেই শিক্ষার সঙ্গে উৎপাদনশীল শ্রম মেলানো আজকের সমাজকে পরিবর্তন করার দিক থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী এক উপায়।

৪. ‘ফ্যাক্টরি, হস্তশিল্প কারখানা ও ঘরোয়া শিল্পের ওপর রাষ্ট্রীয় তদারক।’
প্রুশো-জার্মান রাষ্ট্রের কথা মনে রেখে এটুকু নিশ্চয়ই দাবি করা উচিত ছিল যে, আদালত ছাড়া আর কেউ কলকারখানা পরিদর্শকদের অপসারণ করতে পারবে না; যে কোন শ্রমিক কর্তব্যে অবহেলার জন্য পরিদর্শকদের আদালতে অভিযুক্ত করতে পারবে; তাদের ডাক্তারি পেশার অন্তর্ভুক্ত লোক হওয়া চাই।

৫. ‘কয়েদি শ্রমের নিয়ন্ত্রণ।’
শ্রমিকদের সাধারণ কর্মসূচির মধ্যে এ একটা অতি তুচ্ছ দাবি। সে যা হোক, স্পষ্ট করে বলা উচিত ছিল যে, প্রতিযোগিতার আশঙ্কায় সাধারণ ফৌজদারি অপরাধীদের প্রতি জানোয়ারের মতো ব্যবহার চলতে দেওয়ার কোন উদ্দেশ্য নেই শ্রমিকদের এবং বিশেষ করে, তাদের উন্নতির একমাত্র উপায়, উৎপাদনশীল শ্রম থেকে তাদের বঞ্চিত করে রাখার কোন ইচ্ছে নেই। সমাজতন্ত্রীদের কাছে থেকে অন্তত এইটুকু নিশ্চয়ই আশা করা যেত।

৬. ‘একটি কার্যকরী দায়িত্ব আইন।’
কার্যকরী দায়িত্ব আইন বলতে কী বোঝান হচ্ছে সেকথা নির্দিষ্ট করে দেওয়া উচিত ছিল।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে, স্বাভাবিক কর্মদিনের কথায় কারখানা আইনের স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত নিয়ম-কানুন বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রভৃতি সংক্রান্ত অংশের প্রতি নজর দেওয়া হয়নি। এইসব নিয়ম-কানুন লংঘিত হলেই তবেই দায়িত্ব আইন প্রযোজ্য হয়।

সংক্ষেপে শিথিল সম্পাদনা এই পরিশিষ্টটিরও বৈশিষ্ট্য।

Leave a Comment

error: Content is protected !!