ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস রচিত জ্ঞানগর্ভ পুস্তিকা কমিউনিজমের নীতিমালা

প্রশ্ন-৮: ভূমিদাস থেকে প্রলেতারিয়ানের পার্থক্যটা কোন দিক থেকে ?

উত্তর: উৎপাদনের কোন সাধিত্র, একটা জমি-বন্দ থাকে ভূমিদাসের দখলে, তার ব্যবহারের জন্যে — সেটার বদলে সে উৎপাদের একটা অংশ দিয়ে দেয় কিংবা খাটে। প্রলেতারিয়ান উৎপাদনের যে-সাধিত্র দিয়ে কাজ করে সেটা অপরের, সে কাজ করে সেই লোকের জন্যে, আর তার বাবত সে পায় উৎপাদের একাংশ। ভূমিদাস দেয়, প্রলেতারিয়ানকে দেওয়া হয়। ভূমিদাসের জীবনোপায়ের নিশ্চয়তা থাকে, প্রলেতারিয়ানের তা থাকে না। ভূমিদাস থাকে প্রতিযোগিতার বাইরে, প্রলেতারিয়ানের অবস্থান সেটার মাঝে। ভূমিদাস মুক্ত হয় এইভাবে: হয় সে পালিয়ে শহরে গিয়ে সেখানে হয় হস্তশিল্পী, নইলে জমিদারকে শ্রম আর জাতদ্রব্যের বদলে টাকা দিয়ে হয় স্বাধীন পাট্টাদার, নইলে সামন্ত মালিককে তাড়িয়ে দিয়ে সে নিজেই হয়ে ওঠে মালিক, এককথায়, কোনো না কোনো উপায়ে সে এসে যায় মালিক শ্রেণি আর প্রতিযোগিতার কাতারে। প্রতিযোগিতা, ব্যক্তিগত মালিকানা এবং সমস্ত শ্রেণিগত পার্থক্য লোপ করে মুক্ত হয় প্রলেতারিয়ান।

প্রশ্ন-৯: হস্তশিল্পী থেকে প্রলেতারিয়ানের পার্থক্য কোন দিক থেকে?[১]

প্রশ্ন-১০: ম্যানুফ্যাক্টরি শ্রমিক থেকে প্রলেতারিয়ানের পার্থক্য কোন দিক থেকে?

উত্তর: ষোল থেকে আঠার শতকে প্রায় সর্বত্রই ম্যান্যুফ্যাক্টরি শ্রমিকের মালিকানায় থাকত। তার উৎপাদনের হাতিয়ার, হাত-তাঁত, পারিবারিক চরকাগুলো, আর ছোট্ট জমি-বন্দ, যাতে সে অবসর-সময়ে চাষবাস করত। প্রলেতারিয়ানের নেই এর কিছুই। জমিদার কিংবা মালিকের সঙ্গে কমবেশি গোষ্ঠীতান্ত্রিক সম্পর্কের মাঝে ম্যানুফ্যাক্টরি শ্রমিক প্রায় সম্পূর্ণতই থাকে গ্রামাঞ্চলে; প্রলেতারিয়ানরা প্রায় সবাই থাকে বড় বড় শহরে, মনিবের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিছক আর্থিক সম্পর্ক। ম্যানুফাক্টরি শ্রমিককে তার গোষ্ঠীগত পরিবেশ থেকে ছিনিয়ে নেয় বৃহদায়তনের শিল্প, তখনও তার যা সম্পত্তি ছিল সেটা খোয়া গিয়ে সে হয়ে পড়ে প্রলেতারিয়ান ।

প্রশ্ন-১১: শিল্প-বিপ্লব, এবং বুর্জোয়া আর প্রলেতারিয়ানদের মধ্যে সমাজের বিভাগের সরাসরি ফলাফল হয়েছিল কী?

উত্তর: প্রথমত, যন্ত্রে কাজের ফলে শিল্পজাতদ্রব্যের দাম সমানে কমে যাচ্ছিল ব’লে কায়িক শ্রমের ভিত্তিতে চালান ম্যানুফ্যাকচার কিংবা শিল্পের পুরনো প্রণালীটা পৃথিবীর সমস্ত দেশে একেবারেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সমস্ত আধা-বর্বর দেশ তদবধি ইতিহাসক্রমিক বিকাশ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলো, তখন অবধি ঐসব দেশের শিল্পের ভিত্তি ছিল ম্যানুফ্যাকচার, — ঐ প্রক্রিয়ার প্রভাবে সেইসব দেশের বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটেছিল। ইংরেজদের অপেক্ষাকৃত সস্তা পণ্যদ্রব্য তারা কিনত, এবং নিজেদের ম্যানন্যুফ্যাক্টরি শ্রমিকদের তারা ধ্বংস হয়ে যেতে দিয়েছিল। হাজার হাজার বছর ধরে বদ্ধতায় বিড়ম্বিত দেশগুলিতে আদ্যোপান্ত আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল। এইভাবে, যেমন ভারতে, এমনকি চীনও এখন এগিয়ে চলেছে বিপ্লবের দিকে। আজ ইংলন্ডে উদ্ভাবিত একটা যন্ত্র বছরখানেকের মধ্যে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের দৈনন্দিন অন্ন কেড়ে নেয়। চীনে, এমনটা ঘটে ঐভাবেই। বৃহদায়তনের শিল্প এইভাবে পৃথিবীর সমস্ত জাতির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করিয়েছে, ছোট ছোট সমস্ত স্থানীয় বাজারকে একত্রিত করে গড়ে তুলেছে বিশ্ব-বাজার, সভ্যতা আর প্রগতির পথ সংগম করেছে সর্বত্র, আর সবকিছু পৌঁছেছে এমন একটা মাত্রায় যেখানে সভ্য দেশগুলিতে যাকিছু ঘটে সেগুলের প্রতিক্রিয়া ঘটে পৃথিবীর অন্যান্য সমস্ত দেশে। এইভাবে, ইংলন্ডে কিংবা ফ্রান্সে শ্রমিকেরা এখন নিজেদের মুক্ত করে নিলে সেটা বিপ্লব ঘটাবেই অন্যান্য সমস্ত দেশে, সেই বিপ্লবের ফলে ঐসব দেশেও শ্রমিকদের মুক্তি আসবে আগেপিছে!

আরো পড়ুন:  উৎপাদিকা শক্তি হচ্ছে উৎপাদনের যন্ত্র, যন্ত্র ব্যবহারের দক্ষতাসম্পন্ন মানুষ এবং শ্রমের আগ্রহ
“পুঁজি হলো চূড়ান্ত ক্ষমতা, আর তার থেকে, পুঁজিপতিরা হয়ে দাঁড়াল সমাজের সর্বত্র প্রধান শ্রেণি।” — এঙ্গেলস

দ্বিতীয়ত, যেখানেই ম্যান্যুফ্যাকচারের জায়গায় এসেছে বৃহদায়তনের শিল্প, সেখানে শিল্প-বিপ্লব বুর্জোয়াদের, তাদের ধনদৌলত আর ক্ষমতাকে সর্বোচ্চ মাত্রায় উন্নীত করে তাদের করে তুলেছে সংশ্লিষ্ট দেশের সর্বপ্রথম শ্রেণী। তার ফল হয়েছে এই: যেখানেই সেটা ঘটেছে সেখানে বুর্জোয়ারা রাজনীতিক ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে উচ্ছেদ করেছে তদবধি বিদ্যমান শাসক শ্রেণীগুলোকে — অভিজাতকুলকে, গিল্ডের মনিবদের এবং এই দুইয়ের প্রতিভূ নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রকে। দায়াদী সম্পত্তি হস্তান্তরণ-বিক্রয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা বা ভূমি-সম্পত্তি বিক্রয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা এবং উচ্চখেতাবধারীদের বিশেষ অধিকার লোপ করে বুর্জোয়ারা অভিজাতবর্গের, উচ্চ-খেতাবধারীদের ক্ষমতা চূর্ণ করেছিল। সমস্ত গিল্ড এবং বৃত্তিগত বিশেষ অধিকার লোপ করে বুর্জোয়ারা, চূর্ণ করেছিলো গিল্ড-বার্গারদের ক্ষমতা। ঐ দুইয়ের জায়গায় তারা এনেছিলো অবাধ প্রতিযোগিতা, অর্থাৎ সমাজের এমন ব্যবস্থা যাতে প্রত্যেকে শিল্পের যেকোন শাখায় রত হবার অধিকারী, যাতে আবশ্যক পুঁজির অভাব ছাড়া কিছু তাতে কারও পক্ষে বাধা হতে পারে না। কাজেই, অবাধ প্রতিযোগিতা প্রবর্তনের অর্থ হলো এই প্রকাশ্য ঘোষণাটা যে, অতঃপর সমাজের সদস্যদের পুঁজি যে-পরিমাণে অসম কেবল সেই পরিমাণেই তারা অসম, আর পুঁজি হলো চূড়ান্ত ক্ষমতা, আর তার থেকে, পুঁজিপতিরা, বুর্জোয়ারা হয়ে দাঁড়াল সমাজের সর্বত্র প্রধান শ্রেণি। কিন্তু বৃহদায়তনের শিল্পের শুরুতে অবাধ প্রতিযোগিতা আবশ্যক, কেননা সমাজের একমাত্র এই অবস্থায়ই বৃহদায়তনের শিল্প বাড়তে পারে। অভিজাতবর্গ আর গিল্ড-বার্গারদের সামাজিক ক্ষমতা চূর্ণ করার সঙ্গে সঙ্গে বুর্জোয়ারা চূর্ণ করলো তাদের রাজনীতিক ক্ষমতাও। সমাজে সর্বপ্রধান শ্রেণি হয়ে উঠে বুর্জোয়ারা নিজেদের সর্ব প্রধান শ্রেণি বলে ঘোষণা করল রাজনীতিক্ষেত্রেও। সেটা তারা করল প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে — এই ব্যবস্থাটার ভিত্তি হলো আইনের কাছে বুর্জোয়া সমতা, এবং অবাধ প্ৰতিযোগিতাকে আইনগত স্বীকৃতিদান, সেটা ইউরোপীয় দেশগুলিতে চালু হয়েছিল নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্ররূপে। এইসব নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে যাদের কিছু পরিমাণ পুঁজি থাকে কেবল তারাই, অর্থাৎ কিনা কেবল বুর্জোয়ারাই ভোটদাতা; এই বুর্জোয়ারা প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করে, আর এই বুর্জোয়া প্রতিনিধিরা যোগান দিতে অস্বীকার করার অধিকার অনুসারে নির্বাচিত করে বুর্জোয়া সরকার।

আরো পড়ুন:  ছন্নছাড়া সর্বহারা হচ্ছে বুর্জোয়া শ্রেণি থেকে বিচ্ছিন্ন সর্বহারার হঠকারী ও ছন্নছাড়া অংশ

তৃতীয়ত, যে-পরিমাণে বুর্জোয়া শ্রেণিকে সেই পরিমাণে প্রলেতারিয়োতকে গড়ে তুলল শিল্প-বিপ্লব। যে-মাত্রায় বুর্জোয়ারা ধনদৌলত লাভ করল, সেই মাত্রায় সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটল প্রলেতারিয়ানদের। যেহেতু প্রলেতারিয়ানদের কাজে নিয়োগ করতে পারে কেবল পুঁজি, আর যেহেতু পুঁজি বাড়তে পারে কেবল শ্রম নিযুক্ত করলে, তাই প্রলেতারিয়েতের বৃদ্ধি ঘটে ঠিক পুঁজির বৃদ্ধির সঙ্গে সমান তালে। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে শিল্প-বিপ্লব বুর্জোয়াদের আর প্রলেতারিয়ানদের জড়ো করে বড় শহরে, যেখানে শিল্প চালান সবচেয়ে লাভজনক; একটা জায়গায় এইভাবে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড জন রাশির যুথবদ্ধতা প্রলেতারিয়ানদের তাদের ক্ষমতা সম্বন্ধে সচেতন করে তোলে। তাছাড়া, শিল্প-বিপ্লব যত বেশি সম্প্রসারিত হয়, যত বেশি যন্ত্র উদ্ভাবিত হয়, যেগুলো উচ্ছেদ করে কায়িক শ্রমকে, বৃহদায়তনের শিল্প মজুরি নামিয়ে দেয় ততই নানকল্প মাত্রায়, যা আমরা আগেই বলেছি, এইভাবে প্রলেতারিয়েতের অবস্থা ক্ৰমাগত বেশি অসহনীয় হয়ে ওঠে। এইভাবে, একদিকে প্রলেতারিয়েতের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ দিয়ে এবং অন্যদিকে সেটার ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা দিয়ে শিল্প-বিপ্লবী প্রলেতারিয়েতের সমাজ-বিপ্লবের পথ প্রস্তুত করে।

প্রশ্ন-১২: শিল্প-বিপ্লবের অন্যান্য ফলাফল কি?

উত্তর: যাতে অলপকালের মধ্যে এবং সীমান্য খরচায় অঢেল পরিমাণে শিল্পোৎপাদন বাড়ান সম্ভব তার উপায় শিল্প-বিপ্লব সৃষ্টি করল স্টীম ইঞ্জিন এবং অন্যান্য যন্ত্র দিয়ে। বৃহদায়তনের শিল্পের অপরিহার্য ফল হলো অবাধ প্রতিযোগিতা, সেটা উৎপাদনের স্বচ্ছন্দতার কল্যাণে চরম মাত্রায় তীব্র হয়ে উঠল অচিরে ; বহুসংখ্যক পুঁজিপতি লেগে গেল শিল্পে, অচিরেই উৎপন্ন হলো যা কাজে লাগান যেতে পারে তার চেয়ে বেশি। তার ফল ম্যান্যুফ্যাকচারের পণ্যদ্রবের কাটতি থাকল না, আর দেখা দিল তথাকথিত বাণিজ্যিক সংকট। কল-কারখানা অচল হয়ে থাকল, কল-কারখানার মালিকেরা হলো দেউলিয়া, শ্রমিকদের অন্ন ঘুচল। শোচনীয় দুর্দশা লেগে গেল! কিছুকাল পরে উদ্বৃত্ত উৎপাদ বিক্রি হলো। আবার চালু হলও কল-কারখানা, মজুরি বাড়ল, ব্যবসা বাণিজ্য হলো অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে তেজী। কিন্তু অনতিকাল পরেই আবার পণ্য উৎপন্ন হলো বড় বেশি, লাগল আর-একটা সংকট, সেটারও গতিপথ হলো আগেরটার মতো। এইভাবে, এই শতাব্দীর শহর থেকে শিল্পের হাল বিভিন্ন বাড়বাড়ন্তের কালপর্যায় এবং সংকটের কালপর্যায়ের মধ্যে ওঠাপড়া করেছে অবিরাম, অন্যরূপে সংকট পনরাবৃত্ত হয়েছে প্রায় নিয়মিতভাবে পাঁচ থেকে সাত বছর অন্তর-অন্তর, সেগলো সঙ্গে নিয়ে এসেছে শ্রমিকদের যৎপরোনাস্ত অসহনীয় দুর্গতি, ব্যাপক বৈপ্লবিক আলোড়ন, আর সমগ্র বিদ্যমান ব্যবস্থার চূড়ান্ত বিপদ।

আরো পড়ুন:  একটি সমবায়ের পরিচিতি

টীকা:

১. এরপরে পাণ্ডুলিপিতে এঙ্গেলস উত্তরটা দেবার জন্যে একটা জায়গা খালি রেখেছিলেন । — সম্পাদক

Leave a Comment

error: Content is protected !!