রাষ্ট্র ও বিপ্লব বইয়ের প্রথম রুশ সংস্করণের ভূমিকা

তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক-রাজনৈতিক উভয় দিক থেকেই রাষ্ট্রের প্রশ্নটি বর্তমানে বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করছে। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের ফলে একচেটিয়া পুঁজিবাদরূপে একচেটিয়া পুঁজিবাদের রূপান্তর প্রক্রিয়া অসাধারণ ত্বরান্বিত ও তীব্র হয়েছে। পুঁজিপতিদের সর্বশক্তিমান সঙ্ঘগুলির সংগে ক্রমাগত নিবিড় হয়ে মিলিত রাষ্ট্রশক্তি কর্তৃক বীভৎস মেহনতি জনগণের বিকট পীড়ন হয়ে উঠছে বিকটতর। অগ্রণী দেশগুলি পরিণত হচ্ছে — বলছি তাদের পশ্চাৎভাগের কথা — মজুরদের সামরিক কয়েদখাটুনির কারাগারে।

দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের অভূতপূর্ব দুর্দশা ও বিভীষিকার ফলে জনগণের অবস্থা অসহনীয় হয়ে উঠছে, এবং তাদের বিক্ষোভ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। একটা আন্তর্জাতিক মজুর-বিপ্লব স্পষ্টতই পেকে উঠছে। রাষ্ট্রের সংগে এই বিপ্লবের কী সম্পর্ক, সেই প্রশ্নও তাই ব্যবহারিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ বিকাশের যুগে সুবিধাবাদের উপাদানগুলি একসঙ্গে জোড়া হবার ফলে, সারা দুনিয়ার সরকারী সোসালিস্ট দলগুলির মধ্যে সোসাল-শভিনিস্ট প্রবণতা দেখা দিয়েছে। এই প্রবণতা — মুখে সমাজতন্ত্র আর কাজে জাতীয়তাবাদ — (রাশিয়াতে প্লেখানভ, পোত্রেসভ, ব্রেশকোভস্কায়া, রুবানোভিচ এবং সামান্য প্রচ্ছন্নভাবে ৎসেরেতেলি, চের্নভ প্রভৃতি; জার্মানিতে শাইদেমান, লেগীন, ডেভিড প্রভৃতি; ফ্রান্স ও বেলজিয়ামে রেনোদেল, গেদ, ভান্দেরভেলদে; ইংল্যান্ডে হাইন্ডমান ও ফেবিয়ানরা ইত্যাদি ইত্যাদি)। সমাজতন্ত্রের এই নেতাদের এই যে প্রবণতা মূর্ত হয়ে উঠছে, তার বিশিষ্ট লক্ষণ হলো এই যে, এরা শুধু ‘তাদের’ জাতীয় বুর্জোয়াশ্রেণীর স্বার্থের সাথেই নয়, ‘তাদের’ রাষ্ট্রের স্বার্থের সাথেও হীনভাবে গোলামের মতো নিজেদের খাপ খাওয়ায়া নিয়েছে; কারণ তথাকথিত বৃহৎ শক্তিগুলির অধিকাংশই দীর্ঘকাল যাবৎ কতকগুলি ক্ষুদ্র ও দুর্বল জাতিকে শোষণ করছে এবং দাসত্বের শৃঙ্খলে বেঁধে রেখেছে। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ এই ধরনের লুটের মাল ভাগাভাগির যুদ্ধ। সাধারণভাবে বুর্জোয়াশ্রেণীর, বিশেষভাবে সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়াশ্রেণীর প্রভাব হতে মেহনতী জনগণের মুক্তির সংগ্রাম রাষ্ট্র সম্পর্কে সুবিধাবাদিসুলভ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ব্যতীত অসম্ভব।

প্রথমে আমরা রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কস ও এঙ্গেলসের মতবাদ কী সেটা দেখব; তাঁদের শিক্ষার যে সব দিক সুবিধাবাদীরা বিকৃত করেছে অথবা আমরা বিস্মৃত হয়েছি, বিশেষভাবে সেই সব দিকের পূর্ণ আলোচনা আমরা করব। তারপর, যারা মার্কস ও এঙ্গেলসের শিক্ষা বিকৃত করেছে, তাদের মুখ্য প্রতিনিধি কার্ল কাউটস্কির মতামত বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করব; দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের (১৮৮৯-১৯১৪) নেতারূপে সর্বাপেক্ষা সুপরিচিত এই কার্ল কাউটস্কি বর্তমান যুদ্ধের সময় অতি-করুণ রাজনৈতিক দেউলিয়া মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। সর্বশেষে প্রধানত ১৯০৫ সালের বিশেষত ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের অভিজ্ঞতা সংক্ষেপে আলোচনা করিব। বিপ্লবের বিকাশের প্রথম স্তর (১৯১৭ সালের আগস্ট মাসের প্রারম্ভে) স্পষ্টতই সম্পূর্ণ হচ্ছে; কিন্তু সাধারণভাবে এটাই বলতে হয় যে, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের ফলে যে সব সমাজতান্ত্রিক  প্রলেতারিয় বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে, এই বিপ্লবকে সেই বিপ্লব-শৃঙ্খলের একটি গ্রন্থিরূপে বিচার করলেই এটার সমগ্রতা উপলব্ধি করা যেতে পারে; সুতরাং রাষ্ট্রের সাথে প্রলেতারিয়েতের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সম্পর্ক কী, এই প্রশ্ন যে কেবল ব্যবহারিক রাজনীতির ক্ষেত্রেই গুরুত্ব লাভ করেছে, তাই নয়, আজকার দিনের এক জরুরি সমস্যা হিসাবেও প্রশ্নটি গুরুত্ব লাভ করয়াছে; অদূর ভবিষ্যতেই পুঁজিবাদের জোয়াল হতে মুক্তি লাভের জন্য জনগণকে কী করতে হবে, আজিকার দিনের জরুরি সমস্যা হলো জনগণের নিকট সেই কর্তব্য ব্যাখ্যা করে বলা।

আরো পড়ুন:  যুদ্ধ ও বিপ্লব

ভ. ই. লেনিন
আগস্ট, ১৯১৭

Leave a Comment

error: Content is protected !!