দেখে যাতে তোমাদের কষ্ট না হয়,
চোখে যাতে ভালো লাগে
তার জন্যে
আমার বুকে-বেঁধানো সমস্ত কাটায়
আমি গুজে দিয়েছি
একটি করে ফুল—
তোমরা হাসো।
শুনে যাতে তোমাদের দুঃখ না হয়,
কানে যাতে ভালো ঠেকে
তার জন্যে
আমার বুক-ভাসানো সমস্ত কান্নায়
আমি জুড়ে দিয়েছি
একটি করে সুর –
তোমরা হাসো গো,
আনন্দ করে।
আগুনে তো অনেক পুড়েছি
এবার যাব জল সইতে।
নঙর তুলে ফেলেছি
গাঙ থেকে দরিয়ার দিকে
ফেরানো আছে
আমার গলুইয়ের মুখ
তোমরা এবার
আমার মনপবনের নাওটাকে
পায়ের ডগা দিয়ে একটু ঠেলে দিলেই –
হৈ হৈ ক’রে পালে বাতাস লাগবে।।
২
চালের বাতায় গুঁ’জে রেখে এসেছি
গাজীর পট
শিকের ওপর ভোলা রইল
গুপীযন্ত্র
কালের হাত সেখানে পৌছুতে না পৌঁছুতে
আমি ফিরে আসব।
সঙ্গে নিয়েছি চালচিঁড়ে
হুকোতামাক
আর মাছ ধরার জাল
আপাতক ওতেই চলুক।
ফুলছে ফুসছে ঢেউ –
একবার তুলছে মাথায়
একবার ফেলছে পায়ে।
ও মাঝির পো,
দরিয়া আর কতদূর?
ঘর-বার সমান রে বন্ধু
আমার ঘর-বার সমান।
পায়ের নিচে একটুকু মাটি
পেলাম না তার সন্ধান
আমার সেই পোষা পাখি
আকাশের নীল রঙে আঁকি
যত্নে বুকে ক’রে রাখি।
তবু কেন সে করে আনচান
আমার ঘর-বার সমান।
৩
দিন আসে রাত আসে এইভাবেই যায়
দিন আসে রাত আসে এইভাবেই যায়
জল সইতে যাই
একবার এ-চরে
একবার ও-চরে।
একটু করে ঘটে ভরি
আর কাপড়ের খুঁটে গেরো দিই।
পিটুলিতে-গড়া সুখসোহাগের ছিরিছাঁদে
সব-পেয়েছির নয়
সবাই-পেয়েছির দেশ গো !
মোহানার ঠিক মুখে
বিদ্যুতের বাঘনখে
আশমানে চেরাই হচ্ছে যখন আবলুশ কাঠ
ভয়ে চোখ বন্ধ ক’রে আছে যখন তারার দল
ঠিক তখনই ধেয়ে এল বান –
ও মাঝির পো,
ভাটি ছেড়ে নাও কি যায় উজানে?
তবে তাই সই
দরিয়া থেকে গাঙে ফিরে
এবার পট নাচিয়ে
চৌদুনে
কি রকম চব্বর বাধিয়ে দিই দেখ।।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৯ – ৮ জুলাই ২০০৩) ছিলেন বিশ শতকের উল্লেখযোগ্য বাঙালি বামপন্থী কবি ও গদ্যকার। তিনি কবি হিসেবে খ্যাতিমান হলেও ছড়া, প্রতিবেদন, ভ্রমণসাহিত্য, অর্থনীতিমূলক রচনা, অনুবাদ, কবিতা সম্পর্কিত আলোচনা, উপন্যাস, জীবনী, শিশু ও কিশোর সাহিত্য ইত্যাদি রচনাতেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। সম্পাদনা করেছেন একাধিক গ্রন্থ এবং বহু দেশি-বিদেশি কবিতা বাংলায় অনুবাদও করেছেন। “প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য় এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা” বা “ফুল ফুটুক না ফুটুক/আজ বসন্ত” প্রভৃতি তাঁর অমর পঙক্তি বাংলায় আজ প্রবাদতুল্য।