দ্বন্দ্ব সম্পর্কে

৫. দ্বন্দ্বের দিকগুলোর অভেদ এবং সংগ্রাম

দ্বন্দ্বের সর্বজনীনতা ও বিশিষ্টতা উপলব্ধি করার পর আমাদের অবশ্যই দ্বন্দ্বের দিকগুলোর অভেদ এবং সংগ্রামের সমস্যাটি পর্যালোচনা করতে হবে।

অভেদ, একত্ব, মিল, আন্তঃঅনুপ্রবেশ, আন্তঃঅন্তর্ভেদ পরস্পর-নির্ভরশীলতা, (বা অস্তিত্বের জন্য পারস্পরিক নির্ভরতা), আন্তঃসংযোগ বা পরস্পর-সহযোগিতা—এসব ভিন্ন ভিন্ন কথা একই জিনিসকেই বোঝায় এবং নিম্নলিখিত দুটি বিষয়ের প্রতি নির্দেশ দেয়: প্রথম, একটি বস্তুর বিকাশের প্রক্রিয়ায় একটি দ্বন্দ্বের দুটি দিকের প্রত্যেকটির নিজস্ব অস্তিত্বের পূর্বশর্ত হিসেবে অপরটিকে প্রয়োজন এবং উভয় দিকই একক সত্তার মধ্যে সহঅবস্থান করে; দ্বিতীয়, নির্দিষ্ট অবস্থায় দ্বন্দ্বমান দুটি দিকের প্রত্যেকটি নিজেকে তার বিপরীতটিতে রূপান্তরিত করে। এই হচ্ছে অভেদ-এর অর্থ।

লেনিন বলেছেন:

“দ্বন্দ্ববাদ হচ্ছে সেই শিক্ষা যা দেখিয়ে দেয় কেমন করে বিপরীতগুলো অভিন্ন হতে পারে এবং হয়ে থাকে (কেমন করে সেগুলো পরিণত হয়),—কোন অবস্থায় তারা অভিন্ন, নিজেদের একটা থেকে অন্যটাতে রূপান্তরিত করে চলে, — মানুষের ধারণায় কেন এই বিপরীতগুলোকে মৃত, অনড় বলে গ্রহণ না করে বরং জীবন্ত, শর্তসাপেক্ষ, গতিশীল, নিজেদেরকে একটা থেকে অন্যটায় রূপান্তররত বলে গ্রহণ করতে হবে।”[১৬]

এই অনুচ্ছেদটির অর্থ কি?

প্রত্যেক প্রক্রিয়ায় দ্বন্দ্বমান দিকগুলো পরস্পরকে বর্জন করে, পরস্পরের সাথে সংগ্রাম করে এবং পরস্পরের বিরুদ্ধ। বিশ্বের সকল বস্তুর বিকাশের প্রক্রিয়ায় এবং মানুষের চিন্তাধারায় এই দ্বন্দ্বমান দিকগুলো ব্যতিক্রমহীনভাবে বিদ্যমান থাকে। একটি সরল প্রক্রিয়ায় কেবলমাত্র এক জোড়া বিপরীত থাকে, জটিল প্রক্রিয়ায় থাকে তার বেশি। এবং পর্যায়ক্রমে, বিপরীত জোড়াগুলোও পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী। এইভাবেই বাস্তব বিশ্বের সমস্ত বস্তু ও মানবিক চিন্তাধারা গঠিত হয় এবং এইভাবে তারা গতিশীল হয়।

এমতাবস্থায়, অভেদ বা একত্বের চরম অভাব রয়েছে। তাহলে কেমন করে অভেদ বা একত্বের কথা বলা যায়?

ঘটনা হচ্ছে এই যে, কোনো দ্বন্দ্বমান দিক একাকী থাকতে পারে না। বিপরীত দিকের অস্তিত্ব ছাড়া, প্রত্যেকটি দিক তার অস্তিত্বের শর্তই হারিয়ে বসে। ভেবে দেখুন তো, কোনো বস্তুর বা মানুষের মনে কোনো ধারণার কোনো একটা দ্বন্দ্বমান দিক কি স্বাধীনভাবে থাকতে পারে? জীবন না থাকলে মৃত্যু থাকত না; মৃত্যু না থাকলে থাকত না কোনো জীবন। ‘ঊর্ধ্ব’ না থাকলে ‘অধঃ’ থাকত না; ‘অধঃ’ না থাকলে ‘ঊর্ধ্ব’ থাকত না। দুর্ভাগ্য না থাকলে সৌভাগ্য থাকত না; সৌভাগ্য না থাকলে থাকত না দুর্ভাগ্য। সুবিধা না থাকলে অসুবিধা থাকত না; অসুবিধা না থাকলে সুবিধা থাকত না। জমিদার না থাকলে প্রজা-কৃষক থাকত না; প্রজা-কৃষক না থাকলে থাকত না জমিদার। বুর্জোয়া শ্রেণি না থাকলে সর্বহারা শ্রেণি থাকত না; সর্বহারা শ্রেণি না থাকলে থাকত না বুর্জোয়া শ্রেণি। জাতিসমূহের ওপর সাম্রাজ্যবাদী নিপীড়ন না থাকলে উপনিবেশ বা আধা-উপনিবেশ থাকত না; উপনিবেশ বা আধা-উপনিবেশ না থাকলে থাকত না জাতিসমূহের উপর সাম্রাজ্যবাদী নিপীড়ন। সমস্ত বিপরীতগুলোই এই রকমের; কোনো নির্দিষ্ট অবস্থায় একদিকে তারা পরস্পরবিরোধী, আবার অন্যদিকে তারা পরস্পর-সংযুক্ত, পরস্পর-অন্তর্ভেদ্য, পরস্পর-অনুপ্রবিষ্ট এবং পরস্পর-নির্ভরশীল, এই বৈশিষ্ট্যকে বলা হয় অভেদ। নির্দিষ্ট অবস্থায় সকল দ্বন্দ্বমান দিকগুলোর থাকে ভিন্নতর বৈশিষ্ট্য, তাই তাদের বলা হয় দ্বন্দ্বমান। কিন্তু তাদের অভেদের বৈশিষ্ট্যও থাকে, তাই তারা পরস্পর সংযুক্ত। লেনিন যখন বলেছেন যে, দ্বন্দ্ববাদ পর্যালোচনা করে “কেমন করে বিপরীতগুলো অভিন্ন হতে পারে……”, তখন তিনি এটাই বুঝিয়েছেন। তাহলে কিভাবে তারা অভিন্ন হতে পারে? কারণ প্রত্যেকটি হচ্ছে অপরটির অস্তিত্বের শর্ত। এটাই হচ্ছে অভেদ-এর প্রথম অর্থ।

কিন্তু দ্বন্দ্বমান দিকগুলোর প্রত্যেকটি অপরটির অস্তিত্বের শর্ত, তাদের মধ্যে রয়েছে অভেদ এবং ফলস্বরূপ, তারা একক সত্তায় সহঅবস্থান করতে পারে—এটুকু বলাই কি যথেষ্ট? না, যথেষ্ট নয়। তাদের অস্তিত্বের জন্য পরস্পরের ওপর নির্ভরতার সাথেই ব্যাপারটা শেষ হয়ে যায় না; তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ তাদের পরস্পরে রূপান্তর। অর্থাৎ নির্দিষ্ট অবস্থায় একটা বস্তুর অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বমান দিকগুলোর প্রত্যেকটি নিজেকে তার বিপরীতে রূপান্তরিত করে, নিজের অবস্থানকে বিপরীতের অবস্থানে পরিবর্তন করে। এটা দ্বন্দ্বের অভেদ-এর দ্বিতীয় অর্থ।

এখানেও অভেদ রয়েছে কেন? দেখুন, শাসিত সর্বহারা শ্রেণি বিপ্লব দ্বারা শাসকে রূপান্তরিত হয়, একদা যারা ছিল শাসক সেই বুর্জোয়া শ্রেণি রূপান্তরিত হয় শাসিতে এবং তার বিপরীতের আদি অবস্থানে নিজের অবস্থানকে পরিবর্তন করে। সোভিয়েত ইউনিয়নে ইতিমধ্যে এটা ঘটেছে, এবং ভবিষ্যতে সারা দুনিয়াতেও তাই ঘটবে। যদি নির্দিষ্ট অবস্থায় বিপরীতগুলোর আন্তঃসংযোগ ও অভেদ না থাকত, তাহলে এ রকম পরিবর্তন কেমন করে ঘটতে পারত?

আরো পড়ুন:  প্রয়োজনীয়তা ও স্বাধীনতা হচ্ছে মানুষের ও প্রকৃতির সম্পর্কের দার্শনিক ধারণা

যা আধুনিক চীনের ইতিহাসে একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিল, সেই কুওমিনতাঙ ১৯২৭ সালের পরে তার সহজাত শ্রেণি-প্রকৃতি এবং সাম্রাজ্যবাদী প্রলোভনের দরুন (এইগুলো শর্ত হওয়ায়) একটা প্রতিবিপ্লবী পার্টিতে পরিণত হয়; কিন্তু চীন ও জাপানের মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে ওঠায় এবং কমিউনিস্ট পার্টি যুক্তফ্রন্টের নীতি গ্রহণ করায় (এইগুলো শর্ত হওয়ায়) কুওমিনতাঙ বাধ্য হয়েছে জাপানকে প্রতিরোধ করতে সম্মত হতে। দ্বন্দ্বমান বস্তুসমূহ একটি অপরটিতে রূপান্তরিত হয় এবং এর মধ্যে নিহিত থাকে নির্দিষ্ট অভেদ।

আমরা যে ভূমি-বিপ্লব কার্যকর করেছি তা এমন একটি প্রক্রিয়া ছিল এবং আবারও হবে যার ফলে জমির মালিক জমিদার শ্রেণি জমিহারা শ্রেণিতে রূপান্তরিত হয়, আর যারা একদা তাদের জমি হারিয়েছিল সেই কৃষকরা জমি দখল করে রূপান্তরিত হয় ক্ষুদে মালিকে। নির্দিষ্ট অবস্থায়, থাকা এবং না থাকা, অর্জন করা এবং হারানো, পরস্পর সংযুক্ত; উভয় দিকের রয়েছে অভেদ। সমাজতন্ত্রের অধীনে, কৃষকদের ব্যক্তিগত মালিকানা রূপান্তরিত হয় সমাজতান্ত্রিক কৃষির গণ-মালিকানায়, সোভিয়েত ইউনিয়নে ইতিমধ্যে এটা ঘটেছে, এবং ঘটবে সারা বিশ্বেও। ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে সাধারণ সম্পত্তিতে পৌছার জন্য রয়েছে একটা সেতু, যাকে দর্শনশাস্ত্রে বলা হয় অভেদ, বা পরস্পরে রূপান্তর, বা আন্তঃঅনুপ্রবেশ।

সর্বহারা শ্রেণির একনায়কত্ব বা জনগণের একনায়কত্বকে সংহত করা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে ওই একনায়কত্বের অবসানের জন্য এবং যখন সকল রাষ্ট্রব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে যাবে সেই উচ্চতর স্তরে অগ্রগমনের জন্য শর্ত প্রস্তুত করা। কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ সাধন করা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে কমিউনিস্ট পার্টি ও সমস্ত পার্টিব্যবস্থাই বিলুপ্ত করার জন্য শর্ত প্রস্তুত করা। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে একটা বিপ্লবী সেনাবাহিনী গঠন করা এবং বিপ্লবী যুদ্ধ পরিচালনা করা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধের স্থায়ী বিলুপ্তির জন্য শর্ত প্রস্তুত করা। এই বিপরীতগুলো হচ্ছে একই সময়ে পরস্পরের পরিপূরক।

সকলেরই জানা আছে, যুদ্ধ ও শান্তি নিজেদের একে অন্যটিতে রূপান্তরিত করে। যুদ্ধ রূপান্তরিত হয় শান্তিতে; যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ রূপান্তরিত হয়েছিল যুদ্ধোত্তর শান্তিতে, এবং এখন চীনের গৃহযুদ্ধ থেমে গেছে, তার স্থানে এসেছে অভ্যন্তরীণ শান্তি। শান্তি যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়; যেমন, ১৯২৭ সালে কুওমিনতাঙ-কমিউনিস্ট সহযোগিতা রূপান্তরিত হয়েছিল যুদ্ধে, এবং বিশ্বশান্তির বর্তমান অবস্থা একটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপান্তরিত হতে পারে। এমন কেন হয়? কারণ শ্রেণি সমাজে যুদ্ধ এবং শান্তির মত দ্বন্দ্বমান বস্তুর নির্দিষ্ট অবস্থায় অভেদ থাকে।

দ্বন্দ্বমান সব কিছুই পরস্পর সংযুক্ত; নির্দিষ্ট অবস্থায় তারা কেবল একক সত্তায় সহঅবস্থানই করে না, পরন্তু অপর নির্দিষ্ট অবস্থায় তারা নিজেদের একে অন্যতে রূপান্তরিত করে। এই হচ্ছে দ্বন্দ্বের অভেদের পূর্ণ অর্থ। লেনিন যখন আলোচনা করেছেন — “কেমন করে বিপরীতগুলো অভিন্ন হয়ে থাকে (কেমন করে তারা পরিণত হয়), — কোন অবস্থায় তারা অভিন্ন, নিজেদের একটা থেকে অন্যটাতে রূপান্তরিত করে চলে”, তখন তিনি এটাই বোঝাতে চেয়েছেন।

“মানুষের ধারণায় কেন এসব বিপরীতগুলোকে মৃত, অনড় বলে গ্রহণ না করে বরং জীবন্ত, শর্তসাপেক্ষ, গতিশীল, নিজেদেরকে একটা থেকে অন্যটায় রূপান্তররত বলে গ্রহণ করতে হবে?” কারণ প্রকৃত বস্তু বা বিষয় ঠিক এইভাবেই বিরাজ করে। আসল কথা এই যে, প্রকৃত বস্তু বা বিষয়ে দ্বন্দ্বমান দিকগুলোর একত্ব বা অভেদ মৃত বা অনড় নয়, বরং তারা জীবন্ত, শর্তসাপেক্ষ, গতিশীল, ক্ষণস্থায়ী এবং আপেক্ষিক; নির্দিষ্ট অবস্থায় প্রত্যেক দ্বন্দ্বমান দিক নিজেকে তার বিপরীতে রূপান্তরিত করে। মানুষের চিন্তাধারায় প্রতিফলিত হয়ে, এটাই হয়ে দাঁড়ায় বস্তুবাদী দ্বন্দ্ববাদের মার্কসীয় বিশ্বদৃষ্টি। কেবল অতীত এবং বর্তমানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকশ্রেণিগুলো এবং তাদের সেবাদাস আধিবিদ্যকেরা বিপরীতগুলোকে জীবন্ত, শর্তসাপেক্ষ, গতিশীল এবং একে অন্যতে রূপান্তররত বলে নয়, বরং মৃত ও অনড় বলে বিবেচনা করে, এবং ব্যাপক জনসাধারণকে প্রতারিত করার জন্য ঐ কুযুক্তি সর্বত্রই প্রচার করে, এইভাবে তাদের শাসন টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। কমিউনিস্টদের কর্তব্য হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল ও আধিবিদ্যকদের কুযুক্তিকে খুলে ধরা, বস্তুর সহজাত দ্বন্দ্ববাদকে প্রচার করা, এবং এইভাবে বস্তুর রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করা এবং বিপ্লবের লক্ষ্য অর্জন করা।

আরো পড়ুন:  ফয়েরবাখ সম্বন্ধে থিসিসসমূহ

নির্দিষ্ট অবস্থায় বিপরীতগুলোর অভেদের কথা বলতে আমরা বাস্তব ও মূর্ত বিপরীতগুলোকে এবং বিপরীতগুলোর একে অন্যতে বাস্তব ও মূর্ত রূপান্তরকেই বোঝাই। পৌরাণিক কাহিনীতে বহু রূপান্তরের কথা আছে, যেমন “শান হাই চিং” (“পর্বত ও সমুদ্রের কাহিনী”) গ্রন্থে সূর্যের সঙ্গে কুয়া ফু-র দৌড় প্রতিযোগিতা[১৭] “হুয়াই নান জি” সংকলনে ঈ কর্তৃক নয়টি সূর্যকে তীর মেরে নামানো[১৮] , “সী ইয়ৌ চী” (“পশ্চিমে তীর্থযাত্রা”) উপন্যাসে বানর-দেবতা সুন উ-খোং-এর বাহাত্তর রকমের রূপ পরিগ্রহণ[১৯] , এবং “লিয়াও চাই চি ই” (“দিলখুশ তসবীরখানার অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প”)[২০] নামক গ্রন্থে ভূতেদের ও খেকশিয়ালদের মানুষের রূপ গ্রহণের বহু অণুকাহিনী ইত্যাদি। এইসব পৌরাণিক কাহিনীতে বর্ণিত বিপরীতগুলোর পরস্পরে রূপান্তর মূর্ত দ্বন্দ্বে প্রকাশিত মূর্ত রূপান্তর নয়, এগুলো হচ্ছে বিপরীতগুলোর একে অন্যতে বহু জটিল ও বাস্তব রূপান্তর দ্বারা মানুষের মনে কল্পনায় সাজিয়ে তোলা শিশুসুলভ, অলীক ও মনগড়া রূপান্তর। মার্কস বলেছেন: “সমস্ত পুরাণকাহিনী কল্পনায় এবং কল্পনার মাধ্যমে প্রকৃতির শক্তিগুলোর ওপর প্রভুত্ব ও আধিপত্য করে এবং তাদের রূপায়িত করে; তাই প্রকৃতির শক্তিগুলোর ওপর মানুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই তা বিলুপ্ত হয়ে যায়।”[২১] পৌরাণিক কাহিনীতে (এবং ছেলেভুলানো গল্পেও) যে অসংখ্য রূপান্তরের বিবরণ রয়েছে মানুষকে তা আনন্দ দেয়। এই জন্য যে, সেগুলো প্রাকৃতিক শক্তির ওপর মানুষের জয়লাভকে কল্পনায় রূপ দেয়; তা ছাড়া শ্রেষ্ঠ পুরাণকাহিনীগুলোর রয়েছে “চিরন্তন সৌন্দর্য” (মার্কসের ভাষায়); কিন্তু পুরাণকাহিনী মূর্ত দ্বন্দ্বগুলোর নির্দিষ্ট অবস্থার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়নি এবং এজন্য বাস্তবের বৈজ্ঞানিক প্রতিফলন নয়। অর্থাৎ পুরাণকাহিনী বা ছেলেভুলানো গল্পে দ্বন্দ্ব গঠনকারী দিকগুলোর কেবল কাল্পনিক অভেদ রয়েছে, মূর্ত অভেদ নয়। বাস্তব রূপান্তরগুলোতে অভেদ-এর বৈজ্ঞানিক প্রতিফলন হচ্ছে মার্কসবাদী দ্বন্দ্ববাদ।

একটা ডিম মুরগির ছানায় রূপান্তরিত হতে পারে, কিন্তু একটা পাথর পারে না কেন? যুদ্ধ ও শান্তির মধ্যে অভেদ রয়েছে, কিন্তু যুদ্ধ ও পাথরের মধ্যে নেই কেন? কেন মানুষ কেবল মানুষকেই জন্ম দিতে পারে, অন্য কিছুকে নয়? একমাত্র কারণ এই যে, কেবল নির্দিষ্ট প্রয়োজনীয় অবস্থায় বিপরীতগুলোর অভেদ বিদ্যমান থাকে। এই নির্দিষ্ট প্রয়োজনীয় অবস্থা ছাড়া কোনো অভেদ থাকতে পারে না।।

কেন রাশিয়ায় ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারির বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ঐ বছরেই অক্টোবর সর্বহারা শ্রেণির সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত ছিল, আর ফ্রান্সে বুর্জোয়া বিপ্লব কেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত ছিল না এবং ১৮৭১ সালের প্যারী কমিউন কেন ব্যর্থতায় পরিণতি পেয়েছিল? অন্যদিকে, কেন মঙ্গোলিয়া এবং মধ্য এশিয়ার যাযাবর ব্যবস্থা প্রত্যক্ষভাবে সমাজতন্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে? কেন চীনের বিপ্লব পাশ্চাত্য দেশগুলোর পুরোনো ঐতিহাসিক পথ গ্রহণ ছাড়াই এবং বুর্জোয়া একনায়কত্বের পর্যায় অতিক্রম না করেই ধনতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ পরিহার করতে এবং সরাসরি সমাজতন্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে? এর একমাত্র কারণ হচ্ছে ঐ সময়ের মূর্ত অবস্থা। যখন কতগুলো নির্দিষ্ট প্রয়োজনীয় অবস্থা বিদ্যমান থাকে তখন বস্তুর বিকাশের প্রক্রিয়ায় কতগুলো দ্বন্দ্বের উদ্ভব ঘটে এবং তদুপরি সেগুলোর মধ্যে নিহিত বিপরীতগুলো পরস্পরের উপর নির্ভরশীল হয় এবং পরস্পরে রূপান্তরিত হয়; নতুবা কোনো কিছুই সম্ভব হয় না।

এটাই অভেদের সমস্যা। তাহলে সংগ্রাম কি? আর অভেদ ও সংগ্রামের মধ্যে সম্পর্কই-বা কি?

লেনিন বলেছেন:

বিপরীতের একত্ব (মিল, অভেদ, সমক্রিয়া) হচ্ছে শর্তসাপেক্ষ, সাময়িক, ক্ষণস্থায়ী এবং আপেক্ষিক। পরস্পরব্যতিরেকী বিপরীতগুলোর সংগ্রাম অনাপেক্ষিক, ঠিক যেমন বিকাশ ও গতি অনাপেক্ষিক।[২২]

এই অনুচ্ছেদটির অর্থ কি ?

সকল প্রক্রিয়ার আছে শুরু ও শেষ, সকল প্রক্রিয়া নিজেদের একে অন্যতে রূপান্তরিত করে। সকল প্রক্রিয়ার স্থায়িত্ব আপেক্ষিক, কিন্তু এক প্রক্রিয়া থেকে অন্য প্রক্রিয়ায় রূপান্তরের মধ্যে আত্মপ্রকাশকারী পরিবর্তনীয়তা অনাপেক্ষিক।

সকল বস্তুর মধ্যে গতির দুটি অবস্থা আছে, আপেক্ষিক নিশ্চলতা এবং দৃশ্যমান পরিবর্তন। উভয়ই বস্তুর মধ্যে নিহিত দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী উপাদানের মধ্যকার সংগ্রাম থেকে উদ্ভূত হয়। যখন বস্তুটি গতির প্রথম অবস্থাটিতে থাকে, তখন তার পরিমাণগত পরিবর্তন ঘটে, গুণগত নয়, কাজে কাজেই মনে হয় সে আপাতনিশ্চল অবস্থায় রয়েছে। যখন বস্তুটি গতির দ্বিতীয় অবস্থাটিতে থাকে, তার আগেই প্রথম অবস্থাটির পরিমাণগত পরিবর্তন কোনো চরম বিন্দুতে পৌঁছে যায় এবং বস্তুর সত্তার বিয়োজন সংঘটিত করায় এবং অবিলম্বে একটা গুণগত পরিবর্তন উদ্ভূত হয়; অতএব দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়। আমরা প্রাত্যহিক জীবনে যেরূপ একত্ব, সংহতি, সংযুক্তি, সামঞ্জস্য, সমক্রিয়া, অচলাবস্থা, বন্ধ্যাবস্থা, নিশ্চলতা, সুস্থিতি, ভারসাম্য, জমাট অবস্থা ও আকর্ষণ ইত্যাদি দেখতে পাই সবই হচ্ছে পরিমাণগত পরিবর্তনের অবস্থায় বস্তুসমূহের বাইরের চেহারা। অন্যদিকে, একত্বের বিয়োজন অর্থাৎ ঐ সংহতি, সংযুক্তি, সামঞ্জস্য, সমক্রিয়া, অচলাবস্থা, বন্ধ্যাবস্থা, নিশ্চলতা, সুস্থিতি, ভারসাম্য, জমাট অবস্থা ও আকর্ষণের ধ্বংস এবং প্রত্যেকটির বিপরীতে পরিবর্তন—এ সবই হলো গুণগত পরিবর্তনের অবস্থায়, একটি প্রক্রিয়া থেকে অন্য প্রক্রিয়ায় রূপান্তরকালে বস্তুর বাইরের চেহারা। বস্তু সর্বদাই নিজেদেরকে গতির প্রথম অবস্থা থেকে দ্বিতীয় অবস্থায় রূপান্তরিত করে চলেছে, আর উভয় অবস্থাতেই বিপরীতগুলোর সংগ্রাম চলতে থাকে, এবং দ্বন্দ্বের মীমাংসা হয় দ্বিতীয় অবস্থার মধ্য দিয়ে। এজন্যই আমরা বলি যে, বিপরীতগুলোর একত্ব হচ্ছে শর্তসাপেক্ষ, অস্থায়ী ও আপেক্ষিক, আর পরস্পরব্যতিরেকী বিপরীতগুলোর সংগ্রাম হচ্ছে অনাপেক্ষিক।

আরো পড়ুন:  আপোষহীন ও আপোষমূলক বিরোধ সমাজের ক্রমবিকাশের ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত শব্দ

ওপরে আমরা যখন বলেছিলাম যে, দুটি বিপরীত জিনিস একক সত্তায় সহঅবস্থান করতে পারে এবং নিজেদের পরস্পরে রূপান্তরিত করতে পারে যেহেতু তাদের মধ্যে রয়েছে অভেদ, তখন আমরা শর্তাধীনতার কথাই বলেছিলাম, অর্থাৎ নির্দিষ্ট অবস্থার দুটি দ্বন্দ্বমান জিনিস ঐক্যবদ্ধ হতে পারে এবং পরস্পরে রূপান্তরিতও হতে পারে; কিন্তু এসব অবস্থা অনুপস্থিত থাকলে তারা একটা দ্বন্দ্ব গঠন করতে পারে না, তারা সহঅবস্থান করতে পারে না এবং নিজেদের পরস্পরে রূপান্তরিত করতেও পারে না। বিপরীতগুলোর অভেদ কেবল নির্দিষ্ট অবস্থায় বিদ্যমান থাকে বলেই আমরা বলেছি যে, অভেদ হচ্ছে শর্তসাপেক্ষ ও আপেক্ষিক। আমরা আরও বলতে পারি যে, বিপরীতগুলোর মধ্যে সংগ্রাম একটা প্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রবহমান এবং একটা প্রক্রিয়াকে অপর একটা প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত করে, অর্থাৎ এই সংগ্রাম সর্বব্যাপী, এবং এজন্য, শর্তহীন ও অনাপেক্ষিক।

শর্তসাপেক্ষ ও আপেক্ষিক অভেদ এবং শর্তহীন ও অনাপেক্ষিক সংগ্রামের সমন্বয় সকল বস্তুতে বিপরীতগুলোর গতিকে গঠন করে।

আমরা চীনারা প্রায়ই বলে থাকি, “যেসব জিনিস পরস্পরবিরোধী তারা পরস্পরের পরিপূরক।”[২৩] অর্থাৎ পরস্পরবিরোধী জিনিসের অভেদ রয়েছে। এই উক্তি হচ্ছে দ্বন্দ্ববাদী এবং অধিবিদ্যার বিরোধী। “পরস্পরবিরোধী” দ্বারা দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী দিকের পারস্পরিক বর্জন বা সংগ্রামকে বোঝায়। “পরস্পরের পরিপূরক” মানে নির্দিষ্ট অবস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বী দিক দুটি সংযুক্ত হয় এবং অভেদ অর্জন করে। অধিকন্তু, অভেদের মধ্যেই সংগ্রাম নিহিত থাকে এবং সংগ্রাম ছাড়া কোনো অভেদ থাকতে পারে না।

অভেদ-এর মধ্যে রয়েছে সংগ্রাম, বিশিষ্টতার মধ্যে রয়েছে সর্বজনীনতা এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে সাধারণ বৈশিষ্ট্য। লেনিনের ভাষায় “……….আপেক্ষিকের মধ্যে রয়েছে অনাপেক্ষিক।”[২৪]

Leave a Comment

error: Content is protected !!