৪ঠা মে’র আন্দোলন

মে, ১৯৩৯[১]

বিশ বছর আগে সংঘটিত ৪ঠা মে’র আন্দোলন সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে চীনের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের একটি নতুন স্তর চিহ্নিত করে দিয়েছে। ৪ঠা মে’র আন্দোলন থেকে সাংস্কৃতিক সংস্কারের আন্দোলন জন্ম নিয়েছিল, যেটা ছিল এই বিপ্লবেরই অন্যতম অভিব্যক্তি। সে সময়ে নতুন সামাজিক শক্তিগুলির উন্মেষ ও বিকাশের সংগে সংগে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে একটি শক্তিশালী শিবিরের আবির্ভাব ঘটে। এই শিবিরের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল শ্রমিকশ্রেণী, ব্যাপক ছাত্র ও নতুন জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী। ৪ঠা মে’র আন্দোলনের সমসাময়িককালে শত-সহস্র ছাত্র সাহসের সংগে অগ্রগামী ভূমিকা গ্রহণ করে। এদিক থেকে ৪ঠা মে’র আন্দোলন ১৯১১ সালের বিপ্লবের চেয়েও একধাপ এগিয়ে গিয়েছিল।

চীনের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রারম্ভিক গঠনকাল থেকে বিচার করে দেখলে দেখা যাবে, এর বিকাশধারার কয়েকটি স্তরের মধ্য দিয়ে তা পেরিয়ে এসেছে। আফিম যুদ্ধ, তাইপিং স্বর্গীয় রাজ্যের যুদ্ধ, ১৮৯৪ সালের চীন-জাপান যুদ্ধ[২], ১৮৯৮’র সংস্কার আন্দোলন[৩], ঈ হো তুয়ান আন্দোলন[৪], ১৯১১ সালের বিপ্লব, ৪ঠা মে’র আন্দোলন, উত্তরাভিমুখী অভিযান, এবং কৃষি-বিপ্লবের যুদ্ধ। বর্তমান জাপ-বিরোধী প্রতিরোধ-যুদ্ধও এরই আরেকটি পর্যায়, এবং এটি হচ্ছে সবচেয়ে বিরাট, সবচেয়ে প্রাণবন্ত ও সবচেয়ে গতিশীল পর্যায়। বিদেশী সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় সামন্তবাদের শক্তির মূলগত উৎখাত এবং একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেই কেবল এই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে বলে ধরা যেতে পারে। আফিম যুদ্ধ থেকে শুরু করে বিপ্লবের বিকাশধারার প্রত্যেকটি স্তরেই নিজস্ব স্বাতন্ত্রমূলক বৈশিষ্ট্য আছে। কিন্তু তাদের মধ্যেকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছে এই যে, সেগুলি কমিউনিস্ট পার্টির জন্মের আগে না পরে সংঘটিত হয়েছে তাই। যাই হোক, সামগ্রিকভাবে, সবগুলি স্তরই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের চরিত্র বহন করছে। এই গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যই হচ্ছে এমন একটি সামাজিক ব্যবস্থার প্রবর্তন বা চীনের ইতিহাসে অপূর্ব অর্থাৎ এমন একটি গণতান্ত্রিক-সামাজিক ব্যবস্থা যার পূর্বসূরী হলো সামন্ততান্ত্রিক সমাজ (বিগত সহস্র বছরের আধা-ঔপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক সমাজ) এবং যার উত্তরাধিকারী হলো সমাজতান্ত্রিক সমাজ। যদি কেউ প্রশ্ন করেন, কেন প্রথমে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সমাজ এবং তারপর সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কমিউনিস্টরা চেষ্টা করবেন, তবে তার উত্তরে আমাদের বক্তব্য হলো: আমরা ইতিহাসের অবশ্যম্ভাবী ধারা অনুসরণ করছি মাত্র।

আরো পড়ুন:  চীন এশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী প্রতিক্রিয়াশীল গণবিরোধী সন্ত্রাসবাদী সামরিক রাষ্ট্র

চীনের গণতান্ত্রিক বিপ্লব তার সম্পূর্ণতার জন্য নির্দিষ্ট সামাজিক শক্তি সমূহের ওপর নির্ভরশীল। এই সামাজিক শক্তিসমূহ হলো শ্রমিকশ্রেণী, কৃষক, বুদ্ধিজীবী এবং বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যেকার প্রগতিশীল অংশ, অর্থাৎ — শ্রমিকশ্রেণী ও কৃষকদের মৌলিক বিপ্লবী শক্তি হিসেবে এবং শ্রমিক শ্রেণীকে বিপ্লবের নেতৃত্বকারী শ্রেণী হিসেবে নিয়ে বিপ্লবী শ্রমিক, কৃষক, সৈন্য, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী এবং ব্যবসায়ীরা। আজ এইসব মৌলিক বিপ্লবী শক্তিগুলি ছাড়া এবং শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্ব ছাড়া সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ও সামন্তবাদ-বিরোধী গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। আজ বিপ্লবের প্রধান শত্রু হচ্ছে জাপানী সাম্রাজ্যবাদীরা ও চীনা বিশ্বাসঘাতকরা, এবং বিপ্লবের মৌলিক নীতি হচ্ছে জাপবিরোধী জাতীয় যুক্তফ্রন্টের নীতি, যে যুক্তফ্রন্টের মধ্যে সমাবেশ ঘটেছে জাপ-আক্রমণবিরোধী শ্রমিক, কৃষক, সৈন্য, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী এবং ব্যবসায়ীদের। প্রতিরোধ-যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়লাভ তখনই ঘটবে, যখন এই যুক্তফ্রন্ট দৃঢ়ভাবে সংগঠিত ও বিকশিত হবে।

চীনের গণতান্ত্রিক বিপ্লবী আন্দোলনে বুদ্ধিজীবীরাই সর্বপ্রথম জাগ্রত হয়েছিল। ১৯১১ সালের বিপ্লব এবং ৪ঠা মে’র আন্দোলনে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে এটা দেখা গিয়েছে, এবং ৪ঠা মের আন্দোলনের দিনগুলিতে বুদ্ধিজীবীরা ১৯১১ সালের বিপ্লবের সময়ের তুলনায় সংখ্যায় ছিলো অনেক বেশি, তাদের রাজনৈতিক চেতনাও ছিল অনেক বেশি উন্নত। কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা শ্রমিক ও কৃষকদের সঙ্গে একাত্ম হতে না পারলে কিছুই করতে সক্ষম হবে না। শেষ বিচারে, বিপ্লবী ও অবিপ্লবী বা প্রতিবিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেকার পার্থক্যরেখা হচ্ছে এটাই যে, তারা শ্রমিক-কৃষকদের সংগে একাত্ম হতে চাইছে কি চাইছে না, এবং প্রকৃতই তারা সেটা করছে কিনা। পরিশেষে, এটাই, এবং শুধুমাত্র এটাই, তিন গণ-নীতি বা মার্কসবাদে বিশ্বাস করার ঘোষণা নয়, এদের থেকে অন্যদের পার্থক্য নির্ণয় করে। সত্যকারের বিপ্লবী হচ্ছে সেই, যে নিজেকে শ্রমিক ও কৃষকদের সঙ্গে একাত্ম হতে ইচ্ছুক, এবং সত্যসত্যই যে তা করছে।

৪ঠা মে’র আন্দোলনের পর বিশ বছর এবং জাপ-বিরোধী যুদ্ধ শুরু হবার পর দু’বছর পার হয়ে গেল। যুবকদের এবং দেশের সমগ্র সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীগুলির গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও প্রতিরোধ-যুদ্ধের প্রতি বিরাট দায়িত্ব আছে। আমি আশা করি, তারা চীনা বিপ্লবের চরিত্র ও তার পরিচালিকাশক্তিগুলি অনুধাবন করতে পারবেন, তাদের কাজ দিয়ে শ্রমিক ও কৃষকদের সেবা করবেন, তাদের মধ্যে যাবেন, এবং তাদের মধ্যে প্রচারক ও সংগঠকের কাজ করবেন, জাপানের বিরুদ্ধে সমগ্র জনতা সামিল হলে বিজয় আমাদের হবেই। সমগ্র দেশের যুবকবৃন্দ, উদ্যোগী হয়ে উঠুন!

আরো পড়ুন:  হোক্সাপন্থা হচ্ছে সংশোধনবাদ বিরোধী মার্কসবাদ-লেনিনবাদের একটি ভিন্নধারা

টীকা

১. কমরেড মাও সে-তুঙের এই রচনাটি লেখা হয়েছিল ইয়েনানের সংবাদপত্রগুলির জন্য ওঠা মে’র আন্দোলনের বিংশত বার্ষিকী উপলক্ষে। এখানে লেখাটি মাও সেতুং নির্বাচিত রচনাবলীর দ্বিতীয় খণ্ড, নবজাতক প্রকাশন কলকাতার ৩০৪-৬ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে।

২. কোরিয়া ও চীনকে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে জাপানী সাম্রাজ্যবাদ ১৮৯৪ খ্রীষ্টাব্দে চীন-জাপান যুদ্ধ আরম্ভ করে। বহু চীনা সাধারণ সৈন্য ও কিছু কিছু দেশব্রতী সেনাপতি বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেন কিন্তু প্রতিরোধ-যুদ্ধ প্রস্তুতির ব্যাপারে চিং সরকারের দুর্নীতির দরুণ চীন পরাজিত হয়। ১৮৯৫ খ্রীষ্টাব্দে চিং সরকার জাপানের সঙ্গে অত্যন্ত অপমানকর ঘৃণ্য শিমনশেকি চুক্তি করতে বাধ্য হয়।

৩. ১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দের সংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে মাও সেতুং রচনাবলীর ২য় খণ্ডে প্রকাশিত “দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ সম্পর্কে” নামক প্রবন্ধের ১১নং টীকা দ্রষ্টব্য।

৪. ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দের ‘ঈ হো তুয়ান আন্দোলন’ ছিল উত্তর চীনের কৃষক ও হস্তশিল্পীদের এক ব্যাপক সাম্রাজ্যবাদ-বরোধী সশস্ত্র স্বতঃস্ফুর্ত লড়াই। ধর্ম ও অন্যান্য সূত্রে যোগাযোগ করে গুপ্ত সমিতির মাধ্যমে তারা ব্যাপক যুদ্ধ চালায়। কিন্তু অত্যন্ত হিংস্র বর্বরতার সঙ্গে এই আন্দোলনকে অবদমিত করা হয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন, জার্মানি, জাপান, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইতালী ও অস্ট্রিয়া — এই আটটি সাম্রাজ্যবাদী দেশের সৈন্যবাহিনী পিকিং ও তিয়েনসিন দখল করে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!