অগ্নিকোণের তল্লাট জুড়ে দুরন্ত ঝড়ে তোলপাড় কালাপানি
খুন হয়ে যায় সাদা সাদা ফেনা
ঘুমভাঙা দলবদ্ধ ঢেউয়ের
ক্ষুরধার তলোয়ারে।
বনেজঙ্গলে ঝটপট করে প্রতিহিংসার পাখা।
কাঁধের জোয়াল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে
ধনুকের মতো বাঁকা পিঠগুলো
টান ক’রে ঘুরে দাড়ায়—
পেরাকে পেনঙে টিনের খনিতে
রবারের বনে, মশলার দ্বীপে
সোনাফলা ইরাবতীর দুধারে
উপত্যকায়
বদ্বীপে, নীলকান্তমণির
ঝিকিমিকি দেশে
শ্যামে, কম্বোজে
আনামী পাহাড়ে
মেকং নদীর বানডাকা জলে
ঘুম-ভেঙে-ওঠা অগ্নিকোণের মানুষ।
রক্তের পাকে শত্রুকে পুঁতে
অন্ধকারের বুকে হাঁটু দিয়ে দুহাতে উপড়ে আনে
দুঃশাসনের ভিং।
মেঘে মেঘে তারা চকমকি ঠুকে
পথের নিশানা করে।
বজ্রের সুরে বেঁধে নেয় গলা। হাঁকে :
দিন এসে গেছে, ভাইরে—
রক্তের দামে রক্তের ধার
শুধবার।
দিন এসে গেছে, ভাই রে—
বিদেশীরাজের প্রাণ-ভোমরাকে
নখে নখে টিপে মারবার।
দিন এসে গেছে
লাঙলের ফালে আগাছা উপড়ে
ফেলবার।
দিন আসে, ভাই,
কাস্তের মুখে নতুন ফসল
তুলবার ।
২
কুঠিয়াল এক সাহেবের লাশে
শকুনিতে খায় ছিঁড়ে
লুণ্ঠনকারী পঁচিশটা যুগ
সাম্রাজ্যের নেশাতুর চোখ থেকে!
সে দৃশ্য দেখে –
দেশটাকে ভালবেসে
বাপদাদা যার প্রাণ দিল ফাঁসিকাঠে।
সে দৃশ্য দেখে-
সাদা ছেলে পেটে ধ’রে
যার কচি মেয়ে দিয়েছে গলায় দড়ি।
সে দৃশ্য দেখে –
যার বংশের বাতি
নিভে গেছে মারীমড়কের হাওয়া লেগে ।
দেশের মাটিতে গড়াগড়ি যায়
সুলতান, রাজারাজড়া, উজির, শিখণ্ডীদের মাথা।
অত্যাচারীর পাড়ায় পাড়ায়
ত্রাহি ত্রাহি হাঁক ওঠে,
দলে দলে ত্রাণকর্তা বিমান
বাতাসে বারুদ ঠেসেঠুসে দিয়ে
কামানের মুখে মৃত্যুর ঝড় তোলে।
দুধের শিশুকে বুকেতে আঁকড়ে ধ’রে
মরে শত শত শহর গাঁয়ের
অগ্নিকোণের মানুষ।
সে আগুনে পথ চেনে
বঞ্চিতদের দিগন্তজোড়া মিছিল।
রক্তে রক্তে ভিজে ওঠে লাল নিশান।
জঙ্গলেজলে পাহাড়ের কোলে
ঝটপট করে প্রতিহিংসার পাখা।
মৃত্যুর ঝড় ঠেলে
অন্ধকারের গলা টিপে ধরে
রক্তের নদী উজিয়ে এগোয়
অগ্নিকোণের পোড়খাওয়া যত মানুষ।
ব্যারাকে ব্যারাকে বিদ্রোহী সেনা জাগে।
অস্ত্রাগারের দ্বার খুলে তারা
জনতার পাশে দাড়ায়।
লক্ষ লক্ষ পায়ের আওয়াজে
কেঁপে কেঁপে ওঠে মাটি।
ছত্রভঙ্গ দস্যুর দল
আগুনে আগুনে রাজ্য পুড়িয়ে দিয়ে
ল্যাজ তুলে ছোটে জাহাজে আকাশযানে ।
লক্ষ লক্ষ হাতে
অন্ধকারকে দু-টুকরো ক’রে
অগ্নিকোণের মানুষ
সূর্যকে ছিঁড়ে আনে।
কোটি কণ্ঠের হুঙ্কার লাগে
বজ্রের কানে তালা।
পোড়া মাঠে মাঠে বসন্ত ওঠে জেগে।।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৯ – ৮ জুলাই ২০০৩) ছিলেন বিশ শতকের উল্লেখযোগ্য বাঙালি বামপন্থী কবি ও গদ্যকার। তিনি কবি হিসেবে খ্যাতিমান হলেও ছড়া, প্রতিবেদন, ভ্রমণসাহিত্য, অর্থনীতিমূলক রচনা, অনুবাদ, কবিতা সম্পর্কিত আলোচনা, উপন্যাস, জীবনী, শিশু ও কিশোর সাহিত্য ইত্যাদি রচনাতেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। সম্পাদনা করেছেন একাধিক গ্রন্থ এবং বহু দেশি-বিদেশি কবিতা বাংলায় অনুবাদও করেছেন। “প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য় এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা” বা “ফুল ফুটুক না ফুটুক/আজ বসন্ত” প্রভৃতি তাঁর অমর পঙক্তি বাংলায় আজ প্রবাদতুল্য।