১৯৫০ সালে আমার হঠাৎ একবার ভারতবর্ষে আসতে হয়। পারিতে অধ্যাপক জোলিও-কুরি আমায় ডেকে একটি দৌত্যকার্যে যাওয়ার জন্য অনুরােধ করলেন। দিল্লিতে যেতে হবে। সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের মতামত জেনে ভারতবর্ষে বিশ্বশান্তি আন্দোলনকে আরও জোরদার করতে হবে।
অধ্যাপক কুরি তখন বিশ্বশান্তি মহাসভার ফ্রান্স শাখার সভাপতি। তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। কারণ, শান্তিবাদ বা যুদ্ধবিরােধী মতবাদ ভারতবর্ষে তেমন গুরুত্ব লাভ করছিল না, যদিও সবাই জানে যে ভারতবর্ষ শান্তিপ্রয়াসী দেশগুলাের মধ্যে অন্যতম। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু নিজে শান্তি ও সহাবস্থান নীতির একজন বড়াে প্রবক্তা, কাজেই ভারতের মাটিতে এই নীতি অনেকখানি শিকড় গেড়ে বসেছিল।
কুরি আমায় দুটি চিঠি দিলেন, একটি প্রধানমন্ত্রীকে লেখা এবং অন্যটি বােম্বের (বর্তমান মুম্বাই) একজন বৈজ্ঞানিককে লেখা। চিঠি দুটি যাতে আমি নিজের হাতে তাঁদের দিই, সে জন্যও অনুরােধ করলেন। এই সামান্য কাজের জন্য আমাকে নির্বাচিত করা আমার কাছে বেশ আশ্চর্যের লাগল। ভাবলাম, হয়তাে ভারতবর্ষের প্রতি আমার দীর্ঘস্থায়ী ভালােবাসার জন্য এবং এ দেশেই আমার যৌবনের কয়েকটি বছর কেটেছিল বলে আমাকে নির্বাচিত করা হলাে। অথবা এও হতে পারে, আমি ‘রেলের ঝনঝনানিতে জেগে ওঠো’ রচনার জন্য সেই বছরেই শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলাম—যে সম্মান পাবলাে পিকাসাে ও হিকমেতও পেয়েছিলেন।
বােম্বের প্লেনে উঠে বসলাম। প্রায় ৩০ বছর পর আবার যাচ্ছি ভারতবর্ষে। এখন আর ভারতবর্ষ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য নয়, এখন সে স্বাধীন দেশ, গণতন্ত্রী রাষ্ট্র। গান্ধীজির স্বপ্ন—যার প্রথম মহাসভায় আমিও ১৯২৮ সালে যােগ দিয়েছিলাম। হয়তাে সেদিনের কোনাে বিপ্লবী বন্ধুই আর বেঁচে নেই, যারা ভারতবর্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামের গল্প একজন সহযােদ্ধার মতাে আমাকেও শােনাতে পারতেন।
প্লেন থেকে নেমে শুল্ক বিভাগের অনুমতিপত্রের জন্য গেলাম। ঠিক ছিল যে সেখান থেকে বেরিয়ে সােজা হােটেলে যাব, সেখানে পদার্থবিদ অধ্যাপক রামনকে কুরির চিঠিটা পৌছে দিয়ে রওনা হব দিল্লি।
শুল্ক বিভাগের কিছু কর্মচারী তখন আমার জিনিসপত্র খুলে পরীক্ষায় ব্যস্ত, যেন সরু একটা চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ানাে হচ্ছে। জীবনে অনেক অনুসন্ধানপর্ব দেখেছি, কিন্তু এমনটি আর দেখিনি। আমার মালপত্র বলতে ছিল কাপড়জামা ভরা একটা স্যুটকেস আর ছােট একটা চামড়ার ব্যাগ—তার মধ্যে সাবান, তােয়ালে, চিরুনি, মাজন ইত্যাদি। কিন্তু আমার প্যান্ট-শার্ট-গেঞ্জি—প্রতিটি পােশাককে দেখলাম পাঁচজোড়া চোখ আর ৫০টা আঙুল তন্ন তন্ন করে খুঁজল। আমার জুতােকে উল্টে ঠুকে দাঁড় করিয়ে সব রকমভাবেই খোঁজাখুঁজি হলাে। প্যান্ট আর জামার পকেটগুলাের সুতা খুলে দেখা হলাে। ইতালির বহু পুরােনাে একটা সংবাদপত্র দিয়ে মুড়ে জুতােজোড়াকে সুটকেসে রেখেছিলাম, যাতে জামাকাপড় নােংরা না হয়, সেই কাগজ খুলে আলাের সামনে ধরে সেটাকে অনেকক্ষণ যাবৎ পরীক্ষা করা হলাে যেন আমি কোনাে গুপ্ত দলিল সঙ্গে এনেছি। পরীক্ষার পর সেই কাগজটি আমার আরও কিছু কাগজপত্র চিঠি পাসপাের্ট ইত্যাদির সঙ্গে আলাদা করে সরিয়ে রাখা হলাে। এরপর আমার জুতােজাড়ার ভেতরে-বাইরে এমনভাবে পরীক্ষা করা হলাে, যেন তারা এক অভূতপূর্ব প্রস্তরীভূত জীবদেহ।
প্রায় দুই ঘণ্টা যাবৎ এই অবিশ্বাস্য অনুসন্ধানপর্ব চলল। তারপর আমার পাসপাের্ট, ঠিকানা লেখা ডায়েরি, ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠি এবং জুতাে থেকে খুলে নেওয়া সেই পুরােনাে সংবাদপত্র একটি বান্ডিলে বেঁধে তার ওপর জাঁকজমকপূর্ণ একটি সিল মারা হলাে। এবার হােটেলে যাওয়ার অনুমতি পেলাম।
অনুমতি তাে পেলাম, কিন্তু কোনাে হােটেলে থাকতে তাে পারব না। তাই চিলির মানুষের প্রশংসনীয় ধৈর্যের সবটুকু অক্ষুন্ন রেখে আমার সমস্ত শক্তি নিয়ে আমি বললাম, বিনা পাসপাের্টে এবং পরিচয়পত্র ছাড়া কোনাে হােটেলই তাে আমাকে থাকতে দেবে না। তা ছাড়া এ দেশে আসার উদ্দেশ্যই তাে হচ্ছে এখানকার প্রধানমন্ত্রীকে জোলিও-কুরির লেখা পত্রটি দেওয়া-সেটা বাজেয়াপ্ত হলে আমার আসাই ব্যর্থ । ওঁরা উত্তর দিলেন, আমরা বলে দিচ্ছি, হােটেলে থাকায় আপনার কোনাে অসুবিধা হবে না। আর কাগজপত্র চিঠি ইত্যাদি যথাসময়েই ফেরত পাবেন।
এই সেই দেশ, যে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলাে আমার যৌবনের অভিজ্ঞতা, আমার যৌবনের সেই রােমাঞ্চময় মুহূর্ত, যা এ দেশের বিপ্লবী বন্ধুদের সঙ্গে সেদিন ভাগ করে নিয়েছিলাম। স্যুটকেস এবং নিজের মুখ বন্ধ করার সময় শুধু একটি শব্দই আমার মনে এসেছিল, ‘বিষ্ঠা।
হােটেলে অধ্যাপক বড়ুয়ার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হওয়ার সময় তাঁকে এই ঘটনার কথা জানালাম। তিনি এতে কোনাে গুরুত্বই দিলেন না। তাঁর মতে, নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ভারতবর্ষে পরিবর্তনের জোয়ার চলেছে, কাজেই এসব ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু আমার কাছে এর সবটাই একটা বিপথগামী বিশৃঙ্খলা বলে প্রতিভাত হয়েছিল। নবলব্ধ এক স্বাধীন দেশের কাছে যে সামান্য অভ্যর্থনাটুকু আশা করেছিলাম, এ যেন তার থেকে অনেক অনেক দূরের মনে হয়েছিল।
পারমাণবিক গবেষণাগারটি বেশ ঝকঝকে আর পরিষ্কারভাবে সাজানাে গােছানাে একটি বাড়ি, যার অলিন্দে অলিন্দে সাদা ধবধবে পােশাক পরা গবেষক ছেলেমেয়ে সব সময়ই ব্যস্তসমস্ত হয়ে চলাফেরা করেন। গবেষণাগারটি নানা যন্ত্রপাতি আর ব্ল্যাকবাের্ড প্রভৃতিতে পূর্ণ। পদার্থবিদ্যার নানা দুর্বোধ্য তত্ত্বে গােটা বাড়ি গমগম করছে—এর অধিকাংশই আমার বােধশক্তির বাইরে। পুলিশ আর শুল্ক দপ্তরের কাছে যে অপমান ও তাচ্ছিল্য আমাকে সহ্য করতে হয়েছিল, এখানে এসে তার কিছুটা লাঘব হলাে। আমার অস্পষ্ট মনে আছে, ছােট্ট একটা বাটির মধ্যে রাখা তরল পারদ দেখেছিলাম। এই পদার্থটির মতাে আশ্চর্যজনক কোনাে বস্তুই আমি দেখিনি । অবিশ্বাস্য এক অসীম ক্ষমতা প্রাণীদেহের মতাে এর মধ্যে রয়েছে; এর গতি তরলতা আর নিজেকে নানান রূপে-কখনাে গােল, কখনাে চ্যাপ্টা করে বদলানাের ব্যাপারটি আমার ধারণার বাইরেই ছিল।
সেদিন যার কাছে মধ্যাহ্ন ভােজের নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছিলাম, নেহরুর সেই বােনের নামটি আমার ঠিক মনে নেই, তবে তার উপস্থিতিতে আমার মানসিক ক্লেশ অনেকটা কমে আনন্দে মনটা ভরে উঠেছিল। অপরূপ সুন্দরী সেই মহিলাকে একজন অভিনেত্রীর মতাে দেখাচ্ছিল। নানা রঙে উদ্ভাসিত তার শাড়ি আর দামি মুক্তো-হিরের অলংকারে ভূষিত এই রমণীটিকে দেখে মনে হচ্ছিল অচিন দেশের রাজকন্যা। আমার শুধু একটা জিনিসই বিসদৃশ লেগেছিল—যখন তিনি হিরে-জহরতের অলংকারে মােড়া আঙুল দিয়ে ভাত তরকারি তুলে মুখে দিচ্ছিলেন, আমি তাকে বলেছিলাম, আমি তার ভাইয়ের সঙ্গে এবং শান্তি সভার অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। তিনি আমাকে বলেছিলেন, তাঁর মতে, ভারতবর্ষের সমস্ত মানুষেরই তাে এই শান্তি আন্দোলনে যােগ দেওয়া উচিত।
সেদিন অপরাহ্ণে হােটেলে আমার কাছে আমার বাজেয়াপ্ত বান্ডিলটি ফেরত দিয়ে গেল পুলিশ, যে বান্ডিলটি এয়ারপাের্টে আমারই সামনে সিল করা হয়েছিল; দুমুখাে পুলিশের দল সেটাকে খােলা অবস্থায় হাজির করল! আমি নিঃসন্দেহ ছিলাম, এর মধ্যকার সবকিছুই যে তারা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করেছে তা-ই নয়, তার ছবিও তারা তুলে রেখেছে। হাসি পেয়েছিল এই কথা ভেবে যে আমার ধােপার বিলটারও ছবি তুলতে ভােলেনি তারা। পরে জেনেছিলাম, আমার ডায়েরিতে যাদের নাম-ঠিকানা ছিল, তাদের প্রত্যেকের কাছে গিয়ে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তাদের মধ্যে আমার শ্যালিকা—রিকার্দো গিরালদেসের বিধবা পত্নীও বাদ যাননি। এই অগভীর দিব্যজ্ঞানী ভদ্রমহিলার ভারতীয় দর্শনের ওপর ছিল অগাধ বিশ্বাস। তিনি সে সময়ে গ্রামে থাকতেন। আমার ডায়েরিতে তার নাম থাকার জন্য পুলিশের হাতে তাকে অনেক নিগ্রহই সেদিন সহ্য করতে হয়েছিল।
দিল্লিতে পৌছে সেখানকার বেশ কয়েকজন নামকরা ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হলাে। তারা কেউ সাহিত্যিক, কেউ দার্শনিক, কেউ বা হিন্দু, কেউ আবার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। তারা সেই সব ভারতীয়, যারা সরল-সহজ মানুষ। সবাইই সেদিন স্বীকার করেছিলেন, সুপ্রাচীন এই ভারতবর্ষের দর্শনে শান্তির জন্য এই সুসংবদ্ধ হওয়ার এক বিরাট ঐতিহাসিক মূল্য ও প্রয়ােজনীয়তা আছে। এই মুহূর্তে শান্তি আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য যেটি সবচেয়ে প্রয়ােজনীয়, সেটি হচ্ছে বিভিন্ন মতের মানুষকে একত্র করে একটি ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচির মাধ্যমে মানবসমাজের কল্যাণের জন্য এই শান্তি আন্দোলনের হাতকে শক্ত করা।
হুয়ান আমার একজন পুরােনাে বন্ধু, তিনি চিকিৎসক ও সাহিত্যিক। মারিন তখন ভারতে চিলির রাষ্ট্রদূত। রাতে খাওয়ার সময় তিনি দেখা করতে এলেন। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে অনেক কথার পর তিনি জানালেন, পুলিশপ্রধানের সঙ্গে দেখা করার জন্য যেতে হবে আমাকে। দূতাবাসের লােকদের সঙ্গে আমলারা যেমন শান্ত ও ভদ্রভাবে কথা বলে থাকেন, ঠিক তেমনিভাবেই পুলিশপ্রধান তাকে জানিয়েছিলেন যে ভারতবর্ষে আমার উপস্থিতিটা তদানীন্তন ভারত সরকারের ঠিক পছন্দ নয়, কাজেই যত শিগগির সম্ভব আমি যেন এ দেশ ছেড়ে চলে যাই। রাষ্ট্রদূত বন্ধুটিকে জানিয়েছিলাম যে আমার একমাত্র ইচ্ছা এই হােটেলের অনাবৃত লনে বসে আমার চিন্তার অংশীদারদের সঙ্গে কিছু মতবিনিময় করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়ার জন্য নিয়ে আসা চিঠিটা নেহরুর হাতে তুলে দেওয়ার পরই আমি এ দেশ ছেড়ে চলে যাব। যদিও একসময় এ দেশের মুক্তিসংগ্রামের জন্য আমার সমস্ত অনুভূতি জড়িয়ে ছিল; তবুও দেখলাম, এখানে এসে এই অসম্মান-নিগ্রহ আর সন্দেহ—যার কোনাে কারণই জ্ঞানত আমার জানা নেই, সেখানে আর এক মুহূর্তও আমি থাকতে চাই না।
আমার বন্ধু এই রাষ্ট্রদূতটি চিলিতে একসময় সমাজতন্ত্রী দলের একজন প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, কিন্তু বয়স এবং রাষ্ট্রদূতের আরামদায়ক চাকরির জন্য তিনি বেশ নরম ও ভীরু হয়ে পড়েছিলেন। আমার প্রতি ভারত সরকারের এই অসৌজন্যমূলক ব্যবহারের প্রতিবাদের পরিবর্তে চাকরির মােহে চুপ করে থাকাটাকেই তিনি শ্রেয় মনে করেছিলেন। কাজেই সেদিন দুজনই আমরা দুজনের কাছ থেকে বেশ দূরে সরে গেলাম। তিনি মুক্ত বােধ করেছিলেন যখন তাঁর গুরুদায়িত্ব আমার সহযােগিতায় সহজেই সুসম্পন্ন হয়েছিল। আর আমি আমার বন্ধু সম্বন্ধে সহজেই মােহমুক্ত হতে পেরেছিলাম।
পরদিন সকালে নেহরুর সঙ্গে তাঁর অফিসঘরে দেখা করার অনুমতি পেয়েছিলাম। উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দনের সময় তার মুখে অভ্যর্থনার স্মিত হাসিটুকুও আমি দেখিনি সেদিন। তার এত ছবি আমরা দেখে থাকি যে সে বর্ণনা নিষ্প্রয়ােজন। ঠান্ডা দুটি কালাে চোখের প্রাণহীন শীতল দৃষ্টি আমার দিকে সব সময়ই নিবদ্ধ ছিল। ৩০ বছর আগে স্বাধীনতা সংগ্রামের মহতী এক জনসভায় তিনি ও তার পিতার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়ের ঘটনা যখন উল্লেখ করেছিলাম, তখনাে তার মধ্যে কোনাে ভাবান্তর দেখিনি। আমার সব কটি প্রশ্নেরই উত্তর তিনি অল্প কথায় দিচ্ছিলেন এবং সর্বক্ষণ তার সেই শীতল দৃষ্টি দিয়ে আমাকে পরীক্ষা করছিলেন।
তার বন্ধু জোলিও-কুরির চিঠিটা তাকে দিলাম। এই ফরাসি বৈজ্ঞানিকের ওপর শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি চিঠি পড়লেন। এই চিঠিতেই জোলিও আমার পরিচয় দিয়ে আমাকে আমার কাজে সাহায্য করার জন্য নেহরুকে অনুরােধ জানিয়েছিলেন। চিঠি পড়া শেষ হলে সেটা দেরাজে রেখে কোনাে কথা না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। সেই সময়ে আমার হঠাৎ মনে হলাে, আমার উপস্থিতিটা তার মােটেই পছন্দ নয়। সেই সঙ্গে এটাও আমার মনে হয়েছিল যে খিটখিটে মেজাজের এই মানুষটির মধ্যে শারীরিক, মানসিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চলেছে। বিরাট শক্তিধর এই মানুষটি শুধু আদেশই করতে শিখেছেন, কিন্তু আদেশ করার মতাে নেতৃত্বের গুণ তার মধ্যে অনুপস্থিত। তাঁর পিতা পণ্ডিত মতিলাল ছিলেন একজন অভিজাত বংশােদ্ভূত জমিদার, যার মধ্যে ছিল সামন্তবাদী ভুইয়ার মনােবৃত্তি। তিনি গান্ধীকে শুধু রাজনৈতিক নয়, তার বিরাট ঐশ্বর্যের দ্বারাও প্রভূত সাহায্য করেছিলেন। সেদিন আমার মনে হয়েছিল যে আমার সামনে বসা এই মানুষটি কোনাে এক দুর্বোধ্য ক্ষমতাবলে আবার সেই জমিদারির যুগে ফিরে গেছেন এবং তার সামনে উপস্থিত আমাকে দেখে যেন একজন নগ্নপদ দরিদ্র কৃষকের কথাই মনে মনে পােষণ করছেন। কাজেই আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘পারিতে ফিরে অধ্যাপক জোলিওকে কী বলব?
শুষ্ক কণ্ঠের জবাব এল, ‘এ চিঠির উত্তর আমি দেব।’
কয়েক মুহুর্তের এই নীরবতা আমার কাছে মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকাল। বােঝাই যাচ্ছিল, নেহরু আমার সঙ্গে কথা বলাটা ঠিক পছন্দ করছেন না অথচ এর জন্য তিনি মৌখিক কোনাে কিছুই প্রকাশ করেননি। আমারও খারাপ লাগছিল যে আমার উপস্থিতির জন্যই গুরুত্বপূর্ণ এই ব্যক্তির অমূল্য সময়ের অপব্যবহার হচ্ছে। তখন মনে হলাে, যে কাজের ভার দিয়ে আমায় ভারতবর্ষে পাঠানাে হয়েছিল, সে বিষয়ে দু-চারটা কথা বলা প্রয়ােজন, তা না হলে এই ঠান্ডা যুদ্ধ যে কোনাে সময়েই উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। যে কোনাে সময়ই এক নতুন মহাপ্লাবন এসে সমগ্র মানবজাতিকে গ্রাস করতে পারে। তাকে পারমাণবিক যুদ্ধের বিপদের কথাও জানালাম এবং আরও জানালাম যুদ্ধবিরােধী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আশু প্রয়ােজনীয়তার কথাও।
গভীর চিন্তায় নিমগ্ন নেহরু আমার কথা না শােনার ভান করে কিছুক্ষণ পরে বললেন, ‘শান্তির কথা বলতে বলতে দুই পক্ষই তাে পরস্পর ঢিল ছুঁড়ে চলেছে।’ বললাম, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, যারা শান্তির কথা বলেন এবং পৃথিবীব্যাপী শান্তি সৃষ্টির জন্য কিছু কাজ করতে যারা আগ্রহী, তাঁরা সবাই একদিকে থেকে শান্তির জন্য আন্দোলনকে জোরদার করতে পারেন।’
নিস্তব্ধ ঘরটিতে নেমে এল আরও গভীর নীরবতা। বুঝলাম, আমার বলা ও শােনা শেষ হয়েছে, এবার যেতে হবে। উঠে নীরবে হাত বাড়িয়ে দিলাম, নীরবেই করমর্দন করলেন তিনি।
দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ স্বরে বললেন, আপনার জন্য আমি কি কিছু করতে পারি, কোনাে কিছু কি আপনার পছন্দ?
যে কোনাে ঘটনার প্রতিক্রিয়া আমার মধ্যে একটু দেরিতেই হয়, এবং দুর্ভাগ্যবশত কারাের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ হতে পারি না আমি। যা-ই হােক, জীবনে এই একটিবার আমি রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। উত্তর দিলাম, ‘ও হ্যা, আপনাকে বলতে ভুলে গেছি যে একসময় আমি ভারতবর্ষে বেশ কিছুকাল ছিলাম, কিন্তু দিল্লির খুব কাছে থাকা সত্ত্বেও তাজমহল দেখা হয়নি আমার। তাই ভেবেছিলাম যে অপূর্ব সুন্দর স্মৃতিসৌধ তাজমহলটা দেখে যাব এবার, অবশ্য যদি পুলিশ এই শহরের সীমানা অতিক্রমের অনুমতি আমাকে দিত। যা-ই হােক, আগামীকাল ভােরেই আমায় চলে যেতে হচ্ছে এ দেশ ছেড়ে । ধন্যবাদ।’
মনের মতাে তীক্ষ উত্তর দিতে পেরে খুশি হয়ে তাকে বিদায় জানিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম।
আমার হােটেলের ম্যানেজার রিসেপশনে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমি প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বললেন, এইমাত্র সরকারি অফিস থেকে খবর দিয়ে গেছে যে ইচ্ছা করলে যে কোনাে সময়ে আপনি তাজমহল দেখতে যেতে পারেন।
আমি বলেছিলাম, শিগগিরই আমার বিল ইত্যাদি দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। আমি হােটেল ছেড়ে এখনই এয়ারপাের্টে যাব, পারির প্রথম প্লেন ধরতে হবে।
এর পাঁচ বছর বাদে ‘লেনিন শান্তি পুরস্কার সম্মেলন’-এর বার্ষিক অধিবেশনে বিশ্বের অন্যান্য অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তির সঙ্গে আমিও উপস্থিত ছিলাম। যখন সময় এল সেই পুরস্কার প্রাপকের নাম মনােনীত করার এবং সে জন্য ভােট নেওয়ার তখন উপস্থিত ভারতীয় প্রতিনিধি প্রধানমন্ত্রী নেহরুর নাম উত্থাপন করেছিলেন। বিচিত্র এক হাসির একটি ছায়া সেদিন আমার মুখে ভেসে উঠেছিল—যদিও অন্যান্য বিচারকেরা কেউই সেটা লক্ষ করেননি। অন্যদের সঙ্গে নেহরুর পক্ষেই ভােট দিয়েছিলাম আমি। এই পুরস্কার নেহরুকে সেদিন বিশ্বশান্তির একজন সংগ্রামী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।[১]
টিকা:
১ পাবলো নেরুদার এই স্মৃতিচারনমূলক লেখাটি তার অনুস্মৃতি, অনুবাদ ভবানীপ্রসাদ দত্ত, প্রথমা, ঢাকা দ্বিতীয় মুদ্রণ, জানুয়ারি, ২০১৩, পৃষ্ঠা ২১৭-২২৩ গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।