পূর্ব বাংলায় আমি সম্প্রতি একটা ছবি করেছি ‘তিতাস একটি নদীর নাম‘। সেটা করতে গিয়ে ঢাকা থেকে প্রায় আশি মাইল দুরে আড়িচাঘাট বলে একটা জায়গা আছে সেখান থেকে লঞ্চ নিয়ে পদ্মা-যমুনার সংগমস্থল পেরিয়ে প্রায় বারো মাইল দূরে আমায় কাজ করতে যেতে হতো। তীরেই একটি মুসলমান পল্লী, তার পরে একটি হিন্দু মালো পল্লী। দু’গ্রামেই আমি কাজ করেছি প্রায় দশ দিন। যেদিন আমার কাজ শেষ হয়েছে, সেদিন দুপুরবেলায় ঐ হিন্দু গ্রামের মাতব্বর আমায় বলে, “তোকে খেয়ে যেতে হবে”। যদিও লঞ্চে আমার যথেষ্ট খাবার ছিল, তবুও আমি আমার দলের ছেলেমেয়েদের বললাম, “তোরা লঞ্চে যা, আমি খেয়ে আসছি”।
তার পরে ঐ মাতব্বর সিঁড়ি পেতে উঠোনে আমায় খেতে বসাল। ভাত, ডাল, একটা ঘাট আর এইটুকু ছোটো ছোটো কই মাছের বাচ্চা। তার পরে ঘরে পাতা দই। সার্ভ করল তার মেয়ে, ভীষণ ভালো বেসে বেসে। আমি অনেক বড়ো বড়ো হোটেলে খেয়েছি, কিন্তু এমন তৃপ্তি সহকারে খাওয়া ভোলা যায় না। তার পরে আমি জিগ্যেস করলাম, “পদ্ম যমুনার মোহনায় তোমরা বসে আছ, যেখানে আমারও দেশ যেখানে অঢেল মাছ। সেখানে এইটুকু-টুকু কই, ব্যাপারটা কী?”
সে বলল, “বাবু, তুই বুঝিস না যা মাছ তুলি, সেগুলো গঞ্জে গিয়া বেচি, তবে কেরাসিন পাই, নুন কিনি, তবে ঘর-সংসার চলে। তোরা কি বুঝবি যে আমাদের গাঙ, দুঃখের গাঙ কত গহীন। সেদিন আর নাই, সাড়ে তিন ট্যাহা দিয়া খরিদ করতে হইছে এই কইয়ের বাচ্চা। এই তো আমাগো স্বাধীনতা।”
তার পরে কোনো কথা বলার ক্ষমতা আমার ছিল না। হেঁটে চলে আসছি একা, মুসলমান গ্রামের মধ্যে দিয়ে আসছি। মাতব্বর তালেব মিঞা আমাকে ধরেছে, “তুই ওখানে খেলি আজকে, আমার এখানে তোকে কালকে খেতে হবে।” আমি বললাম, “আজকে তো আমি জাহাজ নিয়ে চলে যাব, কারণ আমার কাজ তো এখানে শেষ।” সে বলল, “তুই হালায় যাইতে পারবি না। দ্যাখ, তরে কাউলকা থাকতে হইবো গিয়া।”
তার পর আড়িচাঘাটে ইনসপেকশন বাঙলোতে গিয়ে আমি তখন থাকলাম। ততক্ষণে আমার ক্যামেরাম্যান ঢাকা ঘুরে এসে আমায় বলল, “দাদা, তিনটে শট নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের কালকে থাকতেই হবে।” ফলে, আমাকে যেতেই হল এই গ্রামে। এবং সেই মুসলমান মাতব্বর গাণ্ডে পিণ্ডে আমাকে গেলাল।
আমার জীবনের কাজ করতে গিয়ে এই যে মানবিক ব্যাপারটা পেয়েছি, এটা কোনো দাম দিয়ে হয় না। এই যে বিভিন্ন প্রত্যন্তে মানুষের ভালোবাসা, এর কোনো তুলনা আছে বলে আমার মনে হয় না।
আবার বলি, যুক্তি, তর্ক, গপ্পো’ কাজ করার সময় আমি উত্তর ভাগে কাজ করতে গিয়েছিলাম। সেখানে এক কৃষক পরিবারের চুড়ান্ত ভাঙাবাডি, তাতে কাজ করেছি। স্বামী স্ত্রী, আর কেউ নেই। পাশে একটা খাল, একটা ছোট্ট ফালি জমি, সেখানে ওরা ঢেড়স উৎপাদন করে। যখন খালে জল আসে তখন কিছু মাছ আসে। ভাগচাষী, প্রায় কাজই পায়।
এরা সারাদিন কিচ্ছু খায় না, সন্ধে বেলায় চালের মুখ তো দেখেই না। ভুট্টাও না, মকাইও না, যবারের ছাতু- ঐ একবেলা খেয়ে থাকে। ঐ মাছ যখন ধরে, সেগুলো নিয়ে গিয়ে সোনারপুরে বেচে। তবে কিছু কেরাসিন মেলে, নুনের দামও প্রচণ্ড বেড়ে গেছে। ঐ ঢেঁড়স বেচে যখন দু’পয়সা বেশি পায়, তখন একটু আচার খরিদ করে আনে। এই যবারের ছাতুর সঙ্গে একটু আচার ও একটু নুন এই যোগ করলে ওদের জীবনের পরম খাদ্য। তবু তারা আদর করে আমাকে তাদের খাবার খাওয়াল।
আমি অন্যদের খাবার খাওয়াতে পাঠালেম, কারণ তারা ফিল্মের লোকজন, আহ্লাদ না হলে তাদের চলবে না। আমি ওদের সঙ্গে পরমানন্দে বসে বসে খেলাম। আমি জানি না আজকে তাদের এটুকুও জুটছে কি না। অবস্থা বীভৎস থেকে বীভৎস হয়ে আসছে।
এদের ওপরে ছবি করা একটি প্রাথমিক আয়োজন। সেটা করার জন্যে কোনো শিল্পী আছেন কিনা আমার জানা নেই। এরাই আমার দেশ ন্যাকামি আর বীভৎসতাপূর্ণ যে-সব ছবির খবর আমি পাই, কীভাবে এগুলো বেঁচে আছে আমার জানা নেই। দেশের মানুষ না খেয়ে মরছে, দুর্ভিক্ষ এসে পড়েছে, সেই বিষয়ে বলার কেউ নেই? রাগ করবার কেউ নেই? তা হলে শিল্প কেন? বাকতেপ্পাবাজি করে, আর বড়ো বড়ো কথা বলে, আর শিল্প-সংস্কৃতির কথা বলে আমাদের বাঁচার কী কোনো অধিকার আছে?
এর উত্তরটা ভীষণভাবে দরকার। এবং কেউ যদি না দেয়, তা হলে ইতিহাস তার বারোটা বাজাবে।
টিকা:
১. ঋত্বিককুমার ঘটক; চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরও কিছু দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা; পুনর্মুদ্রণ নভেম্বর ২০১৫; পৃষ্ঠা ১৬৩-১৬৪।
ঋত্বিক ঘটক (জন্ম : ৪ নভেম্বর, ১৯২৫ – মৃত্যু : ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬) একজন বিখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর নাম বহুবার বহুভাবে উচ্চারিত। তিনি পরিচালনা করেছেন নাগরিক (১৯৫২, মুক্তি ১৯৭৭), অযান্ত্রিক (১৯৫৮), বাড়ী থেকে পালিয়ে (১৯৫৮), মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০) কোমল গান্ধার (১৯৬১), সুবর্ণরেখা (১৯৬২), তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩), যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৭) প্রভৃতি চলচ্চিত্র।