ভাঙায় কোন বাহাদুরী নাই — সম্পাদকীয়, দৈনিক ইত্তেফাক, ৩ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১

দেশের প্রবীণতম রাজনীতিক মওলানা ভাসানী সকলেরই শ্রদ্ধাভাজন। পারতপক্ষে এই অশীতিপর বৃদ্ধ রাজনীতিকের সমালোচনায় আমরা লিপ্ত হইতে চাই না। কিন্তু এমন সময় আসে তখন কিছু না বলিয়াও পারা যায় না। তার ন্যাপ-দলীয় অনুগামীরাও অনেকে বলেন, ‘স্ববিরোধিতা তোমারই নাম ভাসানী’। আবার কেহ কেহ বলেন, এই বয়সে রাজনীতি হইতে তাঁর সরিয়া পড়ায় সমীচিন। কিন্তু তিনি সরিতেছেন না। তাই তার পার্টির নেতা ও কর্মীদের মধ্যে অন্ততঃ ১৫ আনা লোক তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করিয়া সরিয়া পড়িতেছেন। কিন্তু ভাসানী সাহেব একাই একশো। তিনি তাঁর ‘কর্ম’ যথারীতি করিয়া চলিতেছেন। সে-কর্ম হইতেছে, পাকিস্তানকে ভাঙা, দেশটাকে টুকরো করা।

স্বৈরতন্ত্রের অবসানে, গণতন্ত্র পূণঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, একটি সত্যিকার কার্যোপযোগী গণতান্ত্রিক সংবিধানের সাহায্যে তের কোটি নর-নারীর এই দেশকে সকল ভুলবোঝাবুঝি-মুক্ত করিয়া আবার সর্বক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ, সুসংহত করার যখন একটা নিশ্চিত সুযোগ ও সম্ভাবনা জাগিয়াছে, ঠিক সেই সময় প্রবীণ মাওলানা সাহেব ভাঙার গান গাহিতে আরম্ভ করিয়াছেন। তিনি বিচ্ছিন্নতার আওয়াজ তুলিতে শুরু করিয়াছেন। ৫ই নভেম্বরের বেতার ও টিভি বক্তৃতায় পাশ্চাত্য সম্রাজ্যবাদী ও তাদের অনুচরদের ‘পাকিস্তান ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতির কঠোর সমালোচনা করিয়া তিনি পাকিস্তানের ঐক্য-সংহতি-অখণ্ডতার উপর সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব প্রদান করিয়াছিলেন, এই কিছুদিন পূর্বেও যিনি বলিতেছিলেন যে, ‘রোজ কেয়ামত অবধি আল্লার দেওয়া পাকিস্তান এক-অখণ্ড-অবিভাজ্য রূপে কায়েম থাকিবে’, তিনিই জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের দিন দুই পর হইতে পূর্বাঞ্চলের ‘সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা’র বুলি কপচাইতেছেন।

৯ই ডিসেম্বর সাংবাদিক সম্মেলনে মওলানা সাহেব পশ্চিম পাকিস্তানের ‘ন্যাপ’কে ‘চিরমুক্তি’ দিয়া দিয়াছেন, ‘লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়া দীন’ বলিয়া সেই অঞ্চলের সহিত সকল সম্পর্ক ছিন্ন করিয়াছেন, এমনকি ২৪শে ডিসেম্বর বাগেরহাটের বক্তৃতায় পশ্চিম পাকিস্তানসহ সকল “বৈদেশী” পণ্য বর্জনের আহ্বান জানাইয়াছেন। তিনি নির্বাচনের ফলাফলকে পূর্ব পাকিস্তানের “স্বাধীনতার” প্রশ্নে গণভোটের রায় বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন। ‘অশুভ শক্তির’ বিরুদ্ধে লড়াই করিয়া এই ‘গণভোটের রায়’ কার্যকর করার জন্য শেখ মুজিবকে পীরান-পীর দস্তগীর মওলানা ভাসানী সাহেব অযাচিতভাবে দোয়া খায়ের পর্যন্ত করিয়াছেন।

আরো পড়ুন:  দেশপ্রেম ও আন্তর্জাতিকতাবাদ

এক কথায় পাকিস্তানকে ভাঙিয়া টুকরা করার জন্য এই জীবন-সায়াহ্নেও মওলানা সাহেবের চেষ্টার কোনই ত্রুটি নাই। অথচ আর দশ জনার মত তিনিও উত্তমরূপে জানেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ‘জয়বাংলা’ গাহিয়াছে, সায়ত্ব শাসনাধিকার চাহিয়াছে, কিন্তু কোনটাই পাকিস্তানের বাহিরে নয়। এই শ্রেণীর দুই-একজন অব্যবস্থিতচিত্ত, অপরিণামদর্শী, স্ববিরোধীতার প্রতিমূর্তি ব্যক্তি বা কতিপয় হঠাৎ-গজাইয়া-উঠা ‘ফাও’ নেতা যাহাই বলুন, শেখ মুজিব বাংলাদেশের মানুষকে সবচেয়ে নিবিড়ভাবে জানেন এবং জানেন বলিয়াই তাঁহার ইহা বুঝিবার এতটুকু বাকি নাই যে, জনগণ পূর্ণ স্বায়ত্ব শাসনাধিকার অবশ্যই আদায় করিবে, কিন্তু ‘পীরান-পীর দস্তগীর’ ভাসানী যতই তাবিজ কবজ আর ঝাড়-ফুঁক দিন, একটি পূর্ব পাকিস্তানীও বিচ্ছিন্নতাবাদ সমর্থন করিবে না। এবং ‘তপ্ত কড়াই হইতে জ্বলন্ত উনুনে’ ঝাঁপ দিতে রাজী হইবে না। অতএব, বাঙালী জাতীয়তাবাদের মাত্রাতিরিক্ত ভাবাবেগ প্রচার করিয়া, আওয়ামী লীগের নেতৃবর্গকে পূর্বাঞ্চলের ‘সার্বভৌমত্ব’ ও ‘স্বাধীনতার’ নামে উস্কাইয়া দিয়া কোন বিশেষ বৈদেশীক মহলের নিগূঢ় উদ্দেশ্যকে আগাইয়া লইয়া যাইতে ভাঙ্গনের দূত ভাসানী যত চেষ্টা করুন, সে-চেষ্টা কোনকালে সফল হইবে না। এবং উহাকে কোনক্রমেই সাফল্য লাভ করিতে দেওয়া হইবে না।

মওলানা ভাসানী তথা তাঁর ভাবাদর্শের অনুসারী যে কোন ব্যক্তি জানিয়া রাখুন, ভাঙ্গায় কোন বাহাদূরী নাই, গড়ার মধ্যেই বাহাদূরী। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ অবশ্যই একটি বড় শক্তি ও সম্পদ। ইহাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাইলে ইহা সাত কোটি বাঙ্গালীকে তাহার পশ্চাদমুখিতা ও অনগ্রসরতা জয় করিয়া আগাইয়া চলার শক্তি ও প্রেরণা যোগাইতে পারে এবং বাঙ্গালীকে সারা পাকিস্তানে সর্বাধিক উন্নত ও অগ্রসর করিতে পারে। কিন্তু আশু ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে এই বিরাট শক্তিকে দেশ গঠনমূলক কার্যে নিয়োজিত না করিয়া ভাসানীর আরদ্ধ ….. কার্যে নিয়োজিত করিলে এই জাতীয়তাবাদ কাহারো কোন কল্যাণে না লাগিয়া হয়তো ফ্যাঙ্কোস্টাইন রূপে উহার স্রষ্টার ঘাড়ও মটকাইতে উদ্যত হইবে। তখন উহা আর শক্তি ও সম্পদ থাকিবে না, বরং আপদে রূপান্তরে হইবে। পৃথিবীতে এইরূপ দৃষ্টান্তের অভাব নাই।

আরো পড়ুন:  কমরেড হো চি মিন ভিয়েতনামের জাতিয়তাবাদী সাম্যবাদী বিপ্লবী নেতা

ভাসানী সাহেব সাত কোটি মানুষের সীমাহীন দারিদ্র ও পর্বতপ্রমাণ অসমতা লইয়া আলাদা হইতে বলিতেছেন, স্বাধীনতা ঘোষণা করিতে উস্কানী প্রদান করিতেছেন। অথচ হঠাৎ মৃত্তিকা-ভেদ-করিয়া-গজাইয়া-উঠা কতিপয় ‘বিশেষজ্ঞ’ ও ‘ফাও’-নেতা ও মওলানা ভাসানীর মত ‘পরিসংখ্যানবিদরা’ যাহাই বলুন, একথা পাগলেও বোঝে যে, এই দারিদ্র-বেকারী-বুভুক্ষার বিরাট বোঝা মাথাই লইয়া নিছক শূণ্য হাতে আলাদা হইয়া যাওয়াই দুই-চারিটা ব্যক্তির স্বার্থ থাকিতে পারে, উহাতে বিশেষ-বিশেষ পাওয়ার ব্লকের বা কোন কোন বৃহৎ শক্তির স্বার্থ নিহিত থাকাও বিচিত্র নয়, কিন্তু যাহাদের ‘রায়’ বলিয়া উহাকে চালানো হইতেছে সেই ভুখা-বঞ্চিত-বিশীর্ণ কৃষক-শ্রমিক-মধ্যবিত্তের উহাতে কোন স্বার্থ নাই, বরং রহিয়াছে তপ্ত কড়াই হইতে জ্বলন্ত উনুনে নিক্ষিপ্ত হইবার নিশ্চিত সম্ভাবনা। বাংলার জনগণের স্বার্থ নিহিত রহিয়াছে, এতদিনের বঞ্চনা ও অসমতার খেসারত সুদে-আসলে আদায় করায়, সেই খেসারত দ্বারা এই অর্থনৈতিক অসমতা নির্দিষ্ট স্বল্পতম সময়ে দূর করায়, শাসনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতায়, আঞ্চলিক শোষণ-বঞ্চনার সকল সুযোগ শাসনতান্ত্রিক বিধান বলে চিরতরে নির্মূল করায় এবং বাঙ্গালী-পাঞ্জাবী-পাঠান-সিন্ধী-বালুচ সকলের সুসম উন্নয়নকে সুনিশ্চিত করায়। বস্তুত: ইহাই বৈষয়িক ও বাস্তববাদী পদক্ষেপ। ইহারই মধ্যে মহান ও যোগ্য নেতৃত্বের মাহাত্ম্য নিহিত। অথচ মওলানা ভাসানী যে ‘স্বাধীনতার’ নামে উস্কাইতেছেন তাহার অর্থ নিজের ন্যায্য প্রাপ্য বিসর্জন দিয়া পুঞ্জীভূত অন্নাভাব, অর্থাভাব, এক কোটি লোকের বেকারী এবং হাজারো অর্থনৈতিক সমস্যা লইয়া ‘স্বাধীন’ হওয়া। ইহা পূর্ব বাংলাকে এই চরম প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে আত্মনির্ভরশীল করিয়া তো তুলিবেই না, বরং স্বাধীনভাবে কোন বৃহৎ শক্তির মুখাপেক্ষী এবং পরিণামে উহার কুক্ষিগত করিয়া তুলিবে। তখন এই ‘স্বাধীনতার’ অর্থ দাঁড়াইবে বাজপক্ষীর শিকার হইবার ‘স্বাধীনতা’। মওলানা সাহেব ৩১শে ডিসেম্বরও চট্টগ্রামে বলিয়াছেন, অশিক্ষিত জনগণ ছয়-দফাকে ভোট দেয় নাই, দিয়াছে ‘জয়বাংলা’-কে- যাহার অর্থ ‘তোমরা বাংলা ছাড়, আমরা স্বাধীন হইব’। বলাবাহুল্য, ইহা জনগণের রায়ের উদ্দেশ্যমূলক অপব্যাখ্যা। ইহা অসত্যাচার।

জনগণ সম-অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানেই বিশ্বাসী। তাহারা চায় সংক্ষিপ্ততম সময়ে এই বিরাট আঞ্চলিক অসমতার অবসান। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এল,এফ,ও-তেও ইহা সুস্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত হইয়াছে। আশার কথা এই যে, দুরীকরণের উপলব্ধি জাগ্রত হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবর্গ এখন আগাইয়া আসিতে আরম্ভ করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহাদের আরো উদার ও দূরদর্শী কার্যক্রম দ্বারা বাঙালীর মানসিক সংশয় মোচন করিতে হইবে; তাহাদের আস্থা অর্জন করিতে হইবে। পূর্ব বাংলার নেতৃত্বেরও এক ঠাই বসিয়া থাকিলে চলিবে না, দুই-এক কদম আগাইয়া যাইতে হইবে। মূল নীতিতে অটল থাকিয়াও সেইটুকু এ্যাডজাস্টমেন্ট করা সম্ভব। সেটাই প্রকৃত নেতৃত্ব বা স্টেট্‌সম্যানশীপ। এবং উহাতেই বাহাদুরী। মওলানা ভাসানী যে-ভাঙ্গার উস্কানী দিতেছেন সেই ভাঙ্গায় কোন বাহাদুরী নাই।

আরো পড়ুন:  জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে লেনিনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে জাতিসমূহের সমতাভিত্তিক বিকাশ

বিশেষ দ্রষ্টব্য: লেখাটি দৈনিক ইত্তেফাক, বুধবার, ২০শে মাঘ, ১৩৭৭ (৩ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১) তারিখের সম্পাদকীয়। লেখাটি মাসিক সংস্কৃতি পত্রিকায় জুলাই ২০১৮ সংখ্যা থেকে নেয়া হয়েছে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!