পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি
— ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস
১৮৮৪ সালের প্রথম সংস্করণের ভূমিকা
নিচের অনুচ্ছেদগুলি এক দিক দিয়ে একটি অর্পিত দায়িত্ব পালনেরই ফলশ্রুতি। পরিকল্পনাটি ছিল স্বয়ং কার্ল মার্কসের, আর কারও নয়; তিনি তার নিজের — বলা যেতে পারে আমাদের দুজনের পর্যালোচিত ইতিহাসের বস্তুবাদী শিক্ষার অনুষঙ্গে মর্গানের গবেষণার ফলগুলি বিবত করতে এবং এভাবে তার সামগ্রিক তাৎপর্য ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কারণ, মর্গান তাঁর নিজস্ব পদ্ধতিতে আমেরিকায় ইতিহাসের সেই একই বস্তুবাদী ধারণা পুনরাবিষ্কার করেন, যা মার্কস চল্লিশ বছর আগেই আবিষ্কার করেছিলেন, এবং বর্বরতা ও সভ্যতার তুলনামূলক বিচারে ঐ ধারণা থেকে তিনি প্রধান প্রধান বিষয়ে মার্কসেরই সমসিদ্ধান্তে পৌঁছন। এবং ঠিক যেমন জার্মানির সরকারঘেঁষা অর্থনীতিজ্ঞরা বহু বছর ধরে ‘পুঁজি’ গ্রন্থ থেকে প্রবল আগ্রহে কুম্ভিলকবৃত্তি করে তা ক্রমাগত অবগোপনে প্রয়াসী হয়েছিলেন তেমনি ইংলণ্ডের ‘প্রাগেতিহাস’ সংক্রান্ত বিজ্ঞানের প্রবক্তরাও মর্গানের রচিত ‘প্রাচীন সমাজ’[১] সম্পর্কে তারই পুনরাবৃত্তি করেছেন। আমার প্রয়াত বন্ধুর অসমাপ্ত কাজের স্থলবর্তী হিসেবে এই রচনাটি অকিঞ্চিৎকর প্রমাণিত হতে পারে। তবে মর্গান থেকে মার্কসের বিস্তৃত উদ্ধৃতিগুলির[২] মধ্যে তাঁর সমালোচনামূলক মন্তব্যগুলি আমার হাতে আছে এবং সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্রেই আমি সেগুলি পুনরুদ্ধৃত করেছি।
বস্তুবাদী প্রত্যয় অনুযায়ী, শেষ বিচারে প্রত্যক্ষ জীবনের উৎপাদন এবং পুনরুৎপাদনই ইতিহাসের নির্ধারক নিমিত্ত। কিন্তু আবার এর নিজস্ব প্রকৃতিও দ্বিবিধ। এর একদিকে জীবনধারণের উপকরণ — খাদ্য, পরিধেয় ও আশ্রয়, এবং এজন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি উৎপাদন; অপরদিকে খোদ মানুষের উৎপাদন, প্রজাতির প্রসারসাধন। একটি বিশেষ ঐতিহাসিক যুগের, একটি বিশেষ দেশের মানুষ যে যে সামাজিক নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে বসবাস করে, একদিকে শ্রমের বিকাশের স্তর, অপরদিকে পরিবারের বিকাশের স্তর — সেগুলি এই দ্বিবিধ উৎপাদনের শর্তাধীন। শ্রমের বিকাশ যত কম হয়, উৎপন্নের পরিমাণ এবং সেহেতু সমাজের সম্পদ যত সীমাবদ্ধ থাকে, গোত্রীয় সম্পর্কের উপর সমাজব্যবস্থার নির্ভরশীলতা ততই প্রকটিত হয়। তথাপি গোত্রীয় বন্ধনের ভিত্তিতে গঠিত এই সমাজকাঠামোর মধ্যে শ্রমের উৎপাদনশীলতা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়; বৃদ্ধি পায় আনুষঙ্গিক ব্যক্তিগত মালিকানা ও বিনিময়, সম্পদের অসাম্য, পরের শ্রমশক্তি ব্যবহারের সম্ভাবনা এবং ফলত শ্রেণীবিরোধের ভিত্তি : নবজাত সামাজিক উপাদানগুলি কয়েক পুরষ ধরে পুরাতন সমাজব্যবস্থাকে নতুন অবস্থাগুলির সঙ্গে অভিযোজনের চেষ্টা করে, শেষ অবধি, যতদিন না উভয়ের এই অসঙ্গতি থেকে আসে পরিপুর্ণ উলটপালট। গোত্রীয় বন্ধনভিত্তিক পুরাতন সমাজ নবজাত সামাজিক শ্রেণীগুলির সংঘাতে বিদীর্ণ হয়; তার স্থলবর্তী হয় রাষ্ট্রের আকারে সংগঠিত এক নতুন সমাজ — এখানে আর গোত্রীয় বন্ধনভিত্তিক গোষ্ঠী নয় আঞ্চলিক গোষ্ঠীই নিম্নতন একক, — যে সমাজে পারিবারিক প্রথা পুরোপুরি মালিকানা প্রথার অধীন, এবং যে সমাজে এযাবৎকার সমগ্র লিখিত ইতিহাসের মর্মবস্তু শ্রেণীবিরোধ ও শ্রেণীসংগ্রাম অতঃপর অবাধে বিকশিত হতে থাকে।
আমাদের লিখিত ইতিহাসের এই প্রাগৈতিহাসিক ভিত্তির মূল বৈশিষ্ট্যগুলি আবিষ্কার ও পুনরুদ্ধার এবং উত্তর আমেরিকার ইন্ডিয়ানদের গোত্রীয় বন্ধনের মধ্যে প্রাচীন গ্রীক, রোমান ও জার্মান ইতিহাসের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ এবং অদ্যাবধি দুর্বোধ্য ধাঁধার চাবিকাঠির সন্ধানলাভ — মর্গানের মহৎ কৃতিত্ব। তাঁর গ্রন্থটি একদিনের রচনা নয়। প্রায় চল্লিশ বছর তাঁর বিষয়বস্তুর সঙ্গে যুঝে যুঝে শেষ পর্যন্ত তিনি সেগুলিকে সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করেন। এজন্যই তাঁর রচনা আমাদের কালের যুগান্তকারী অল্প কয়েকটি গ্রন্থের অন্যতম।
বর্তমান রচনার কোন উপাদানগুলি মর্গান থেকে গৃহীত এবং কোনগুলি আমার নিজস্ব, পাঠক মোটামুটি সহজেই তা অনুমান করতে পারবেন। গ্রীস ও রোমের ইতিহাস সম্পর্কিত অংশে আমি মর্গানের তথ্যে আবদ্ধ থাকি নি, পরন্তু আমার জানা তথ্যও যোগ করেছি। কেল্ট ও জার্মানদের সম্পর্কিত অংশগুলি মুখ্যত আমার নিজের; এক্ষেত্রে মর্গানের অবলম্বন ছিল প্রায় একান্তই পরের হাত-ফেরতা তথ্যাদি এবং জার্মানদের সম্পর্কে ট্যাসিটাসের রচনা বাদ দিলে তিনি শুধুমাত্র মি. ফ্রিম্যানের নিম্নমান উদারনৈতিক অপব্যাখ্যার উপরই নির্ভর করেছিলেন। যেসব অর্থনৈতিক যুক্তি মর্গানের উদ্দেশ্যসিদ্ধির পক্ষে যথেষ্ট কিন্তু আমার পক্ষে একেবারেই অনুপযোগী ছিল সেগুলি আমি নবপর্যায়ে উপস্থাপিত করেছি। এবং সর্বশেষে, যেখানে মর্গানকে প্রত্যক্ষভাবে উদ্ধৃত করা হয় নি, বলা বাহুল্য, সেসব সিদ্ধান্তের জন্য আমিই দায়ী।
রচনাকাল: আনুমানিক ২৬ মে, ১৮৮৪[৩]
টিকা:
১. ‘Ancient Society, or Researches in the Lines of Human Progress from Savagery through Barbarism to Civilization’. By Lewis H. Morgan. London, Macmillan, and Co., 1877. গ্রন্থটি আমেরিকায় মুদ্রিত এবং লন্ডনে অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য। লেখক কয়েক বছর আগে লোকান্তরিত হয়েছেন। (এঙ্গেলসের টীকা।)
২. ক, মার্কস, ‘লুইস গ. মর্গানের প্রাচীন সমাজ বইয়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দ্রষ্টব্য। – সম্পাদক
৩. ১৮৮৪ সালের সংস্করণের সঙ্গে মেলানো এবং ১৮৯১ সালের সংস্করণের পাঠ অনুযায়ী মুদ্রিত। মূল রচনা জার্মান ভাষায়। নিম্নোক্ত গ্রন্থে প্রকাশিত: F. Engels. ‘Der Ursprung der Familie, des Privateigenthums und des Staats.’ Hottingen-Zurich, 1884. এই ভূমিকাংশটুকু দ্বিজেন শর্মা ও প্রফুল্ল রায় অনূদিত ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস রচিত পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি গ্রন্থ, মার্কস-এঙ্গেলস নির্বাচিত রচনাবলী ১১ খণ্ড (১২ খণ্ড) প্রগতি প্রকাশন, মস্কো ১৯৮২-এর পৃষ্ঠা ৭-৯ থেকে গৃহীত।
কার্ল মার্কসের সাথে মার্কসবাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস (২৮ নভেম্বর, ১৮২০ – ৫ আগস্ট ১৮৯৫) ছিলেন জার্মান বিপ্লবী, দার্শনিক, সমাজ বিজ্ঞানী, লেখক ও রাজনৈতিক তাত্ত্বিক। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলো হচ্ছে “পবিত্র পরিবার” (১৮৪৪), “ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা” (১৮৪৫) “এ্যান্টি-ডুরিং” (১৮৭৮) “প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা (১৮৮৩), “পরিবার ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি” (১৮৮৪) প্রভৃতি। ১৮৪৮ সালে ছাপা মার্কস ও এঙ্গেলসের সুবিখ্যাত “কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার”।