আদি সঞ্চয়ের রহস্য

আমরা দেখেছি টাকা পরিবর্তিত হয় পুঁজিতে; পুঁজি মারফত উদ্বৃত্ত মূল্য গড়ে ওঠে, এবং উদ্বৃত্ত মূল্য থেকে আসে আরো পুঁজি। কিন্তু পুঁজি সঞ্চয় মানে আগে ধরে নিতে হয় উদ্বৃত্ত মূল্য, উদ্বৃত্ত মূল্যের ক্ষেত্রে আগে পুঁজিবাদী উৎপাদন, পুঁজিবাদী উৎপাদনের ক্ষেত্রে আবার আগে পণ্য উৎপাদন-কর্তাদের হাতে যথেস্ট পরিমাণ পুঁজি ও শ্রমশক্তির অস্তিত্ব ধরে নিতে হয়। সমস্ত গতিধারাটা তাই একটা দুষ্টচক্রে আবর্তিত হচ্ছে বলে মনে হয়, তা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারি কেবল পুঁজিবাদী সঞ্চয়ের আগে একটা ‘আদি’ সঞ্চয়ের (অ্যাডাম স্মিথের “পূর্ব সঞ্চয়”) কথা ধরে নিলে, এমন সঞ্চয় যা পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতির ফল নয়, তার যাত্রাবিন্দু।

ধর্মতত্ত্বে আদি পাপের যা ভূমিকা, অর্থশাস্ত্রে এই আদি সঞ্চয়ের ভূমিকাও প্রায় তাই: অ্যাপেলে কামড় দিল আদম এবং তাতে ক’রে পাপ বর্তাল মানবজাতির ওপর। অতীতের একটি উপাখ্যান রূপে পেশ করে ধরা হয় যে তার উৎপত্তিটা বোঝানো গেল। বহু কাল আগে দুই ধরনের লোক ছিল: একদল পরিশ্রমী, বুদ্ধিমান এবং সর্বোপরি মিতব্যয়ী। উত্তমাংশ, অন্যদল আলসে হারামজাদা, উদ্দাম জীবনযাত্রায় যারা উড়িয়ে দিত নিজেদের সম্পদ এবং আরো কিছু। ধর্মশাস্ত্রীয় আদি পাপের কাহিনীটা আমাদের নিশ্চিত করেই বলে যে মানুষ কপালের ঘাম ঝরিয়ে তার রুটি খেতে পারার নির্বন্ধে দন্ডিত হয়েছিলো; কিন্তু অর্থনৈতিক আদি পাপের ইতিহাস থেকে দেখা যায় যে কিছু লোক আছে যাদের পক্ষে সেটা মোটেই বাধ্যতামূলক নয়। তবে ওসব কথা ভেব না!! দাঁড়াল এই যে, প্রথমোক্ত দল ধন সঞ্চয় করল, আর শেষোক্তদের অবশেষে গায়ের চামড়াটা ছাড়া বেচবার কিছুই রইল না। এবং এই আদি পাপ থেকেই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের দারিদ্র্যের শুরু, যাদের সবকিছ পরিশ্রম সত্ত্বেও নিজেকে ছাড়া বেচবার কিছু নেই, এবং অল্প কিছু লোকের সম্পদের শুরু, যা অবিরত বেড়ে যাচ্ছে যদিও বহু কাল আগেই তারা কাজ করা ছেড়ে দিয়েছে। সম্পত্তির সমর্থনে আমাদের কাছে এই ধরনের নীরস বালখিল্যতা প্রচার করা হয় প্রতিদিন। যেমন ম. তিয়ের এক রাষ্ট্রনায়কের গুরুগাম্ভীর্য নিয়ে তার পুনরাবৃত্তি করার নিশ্চয়তা পেয়েছেন ফরাসি জনগণের কাছে, যারা একদা ছিল অত সুরসিক। কিন্তু সম্পত্তির প্রশ্নটা যেই ওঠে, অমনি শিশুর মানসিক পথ্যটাকেই সমস্ত বয়সের এবং বিকাশের সমস্ত স্তরের পক্ষেই একমাত্র উপযোগী বলে ঘোষণা করাটা পবিত্র কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। এ কথাটা কুখ্যাত যে বাস্তব ইতিহাসে দেশজয়, অধীনস্থকরণ, দস্যুতা, হত্যা—সংক্ষেপে বলই বৃহৎ ভূমিকা নেয়। অর্থশাস্ত্রের সুকোমল ইতিবৃত্তে সমরণাতীত কাল থেকেই পদাবলীর রাজত্ব। সর্বকালেই ধন লাভের একমাত্র উপায় ছিল অধিকার ও ‘পরিশ্রম’, অবিশ্যি ‘চলতি বছরটাকে’ সব সময়েই এ থেকে বাদ দেওয়া হয়। আসলে কিন্তু আদি সঞ্চায়ের পদ্ধতিগুলো আর যাই হোক পদাবলীসুলভ নয়।

আরো পড়ুন:  ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভবিষ্যৎ ফলাফল

টাকা এবং পণ্য এমনিতে পুঁজি নয়, যেমন নয় উৎপাদন ও জীবনধারণের উপায়গুলি। তাদের দরকার পুঁজিতে রপান্তর সাধন। কিন্তু এই রূপান্তর ঘটতে পারে কেবল কতকগুলি নির্দিষ্ট অবস্থায়, যার কেন্দ্রীয় কথাটা হল, দৃষ্টান্তস্বরূপ, এই যে : অতি বিভিন্ন ধরনের দুই দল পণ্যমালিককে মুখোমুখি হতে ও সংস্পর্শে আসতে হবে; একদিকে থাকবে টাকা-পয়সা, উৎপাদনের উপায়, জীবনধারণের উপায়ের মালিকেরা, যারা অন্য লোকের শ্রমশক্তি কিনে নিজেদের হস্তস্থিত মূল্যের পরিমাণ বাড়াতে উৎসুক; অন্যদিকে থাকবে মুক্ত শ্রমিকেরা, নিজেদের শ্রমশক্তির বিক্ৰেতারা, সুতরাং শ্রম-বিক্রেতারা। মুক্ত শ্রমিক দুই অর্থে: ক্রীতদাস, গোলাম প্রভৃতিদের মতো এরা নিজেরা উৎপাদন উপায়ের অঙ্গাঙ্গি অংশ নয়, আবার কৃষক-মালিকদের মতো তারা উৎপাদন উপায়ের মালিকও নয়; সতরাং তারা নিজস্ব কোনো উৎপাদন উপায় থেকে মুক্ত, তার দ্বারা ব্যাহত নয়। পণ্যের বাজারের এই মেরুভূতির ফলে পুঁজিবাদী উৎপাদনের মৌলিক শর্তগুলি মেলে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ধরে নেওয়া হয় যে শ্রমজীবীরা যে সব উপায় মারফত তাদের শ্রম উশুল করতে পারে তার ওপর সবকিছু মালিকানা থেকে তারা পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়েছে। পুঁজিবাদী উৎপাদন একবার তার নিজের পায়ের ওপর খাড়া হওয়া মাত্রই সে এই বিচ্ছেদটাকে বজায় রাখে তাই নয়, ক্রমবর্ধিত আয়তনে তার পপুনরুৎপাদন ঘটায়। সুতরাং যে প্রক্রিয়াটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পথ পরিস্কার করে, সেটা সেই প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না যা শ্রমিকের কাছ থেকে উৎপাদন উপায়ের মালিকানা কেড়ে নেয়; এমন প্রক্রিয়া যা একদিকে জীবনধারণ ও উৎপাদনের সামাজিক উপায়কে পুঁজিতে পরিণত করে, অন্যদিকে অব্যবহিত উৎপাদকদের পরিণত করে মজুরি-শ্রমিকে। তথাকথিত আদি সঞ্চয় তাই উৎপাদন উপায় থেকে উৎপাদককে বিচ্ছিন্ন করার ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছু নয়। এটাকে ‘আদি’ বলে মনে হয়। কারণ এটা হলো পুঁজির এবং তদনুসারী উৎপাদন পদ্ধতির প্রাগৈতিহাসিক পৰ্যায়।

পুঁজিবাদী সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠেছে সামন্ত সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো থেকে। শেষোক্ত সমাজ ভেঙে গিয়ে প্রথমোক্ত সমাজের উপাদানগুলিকে মুক্ত করে দেয়।

জমিতে আবদ্ধ হয়ে থাকা বন্ধ হবার পর, অন্য লোকের ক্রীতদাস, ভূমিদাস, গোলাম হয়ে থাকা বন্ধ হবার পর অব্যবহিত উৎপাদক, শ্রমজীবী শুধু তার গতরটাকেই বেচতে পারত। যেখানেই বাজার পাচ্ছে সেখানেই পণ্য নিয়ে যাচ্ছে, শ্রমশক্তির এই ধরনের এক মুক্ত বিক্রেতা হতে হলে তাকে গিল্ডের আমল থেকে, শিক্ষানবিশ ও গিল্ড-শ্রমিকদের নিয়মকানুন থেকে এবং তাদের শ্রমবিধির বাধানিষেধ থেকেও নিষ্কৃতি পেতে হয়। এইজন্যই যে-ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় উৎপাদকরা পরিণত হয় মজুরি-শ্রমিকে, সেটা এক দিক দিয়ে ভূমিদাসত্ব থেকে ও গিল্ডের নিগড় থেকে তাদের মুক্তিলাভ বলে প্রতিভাত হয়, আর বুর্জোয়া ঐতিহাসিকদের কাছে শুধু এই দিকটাই বৰ্তমান। কিন্তু অন্যদিকে এই নতুন মুক্তিপ্রাপ্ত লোকেরা আত্মবিক্রয়কারী হয়ে ওঠে কেবল তাদের সমস্ত নিজস্ব উৎপাদন উপায় ও সাবেকী সামন্ত ব্যবস্থায় প্রদত্ত জীবনধারণের সমস্ত গ্যারান্টি অপহৃত হবার পর। আর এইটের ইতিহাস, তাদের উচ্ছেদকরণের কাহিনীটা মানবজাতির ইতিবৃত্তে লেখা আছে রক্ত আর আগুনের অক্ষরে।

আরো পড়ুন:  ভূমি থেকে কৃষিজীবী জনগণের উচ্ছেদ

শিল্প পুঁজিপতিদের, এই সব নতুন ক্ষমতাধরদের আবার তাদের দিক থেকে শুধু হস্তশিলেপির গিল্ড-কর্তাদের নয়, সামন্ত প্ৰভুদেরও, সম্পদ উৎসের মালিকদেরও স্থানচ্যুত করতে হয়েছিল। এই দিক থেকে, তাদের সামাজিক ক্ষমতা-জয়টা প্রতিভাত হয় যেন সামন্ত প্ৰভুত্ব, তার জঘন্য সব বিশেষাধিকার এবং গিল্ড আর উৎপাদনের অবাধ বিকাশ ও মানুষ কর্তৃক মানুষের অবাধ শোষণের পথে ন্যস্ত তার প্রতিবন্ধক, —উভয়ের বিরুদ্ধেই এক বিজয়ী সংগ্রামের পরিণামরূপে। শিল্পের বীরব্রতীরা কিন্তু অসিধারী বীরব্রতীদের স্থানচ্যুত করতে পারে যেসব ঘটনাবলির সুযোগ নিয়ে তার পেছনে তাদের কোনো কৃতিত্বই ছিলো না। মুক্তিপ্রাপ্ত রোমকেরা একদা যে উপায়ে তাদের কর্তাদের মালিক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, এরাও ওপরে উঠেছে ঠিক সমান জঘন্য উপায়ে।

যে বিকাশধারায় মজুরি-শ্রমিক ও পুঁজিপতি উভয়েরই উদ্ভব ঘটে, তার যাত্রাবিন্দু ছিলো শ্রমজীবীর দাসত্ব। অগ্রগতিটা কেবল সে দাসত্বের আকার পরিবর্তনে, সামন্ত শোষণকে পুঁজিবাদী শোষণে রপান্তরকরণে। এই পাড়িটা বোঝার জন্য বেশি দূরে যাবার দরকার নেই। পুঁজিবাদী উৎপাদনের প্রথম সূচনাগুলো যদিও আমরা দেখতে পাই ১৪শ কি ১৫শ শতকে, এখানে ওখানে বিক্ষিপ্তভাবে, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের কয়েকটি শহরে, তাহলেও পুঁজিবাদী যুগ শুরু হয়েছে ১৬শ শতক থেকে। যেখানেই তা দেখা দিয়েছে, সেখানেই ভূমিদাসত্বের উচ্ছেদ হয়ে গেছে অনেক আগেই এবং মধ্যযুগের যা সর্বোচ্চ বিকাশ—সার্বভৌম নগরের অস্তিত্ব— তা অনেক আগে থেকেই ক্ষয় পেতে শুরু করেছে।

আদি সঞ্চয়ের ইতিহাসে যে সব বিপ্লব পুঁজিবাদী শ্রেণি গঠনের ক্ষেত্রে হাতলের কাজ করে, সেগুলি সবই যুগান্তকারী; কিন্তু সর্বোপরি যুগান্তকারী হল সেই সব সন্ধিক্ষণ, যখন বিপুলসংখ্যক লোককে সহসা ও সবলে তাদের জীবনধারণের উপায় থেকে ছিন্ন ক’রে এনে শ্রমবাজারে নিক্ষেপ করা হয় মুক্ত ও ‘অনাবদ্ধ’ প্রলেতারীয় হিশেবে। ভূমি থেকে কৃষি-উৎপাদকের, কৃষকের উচ্ছেদই হলো গোটা প্রক্রিয়াটার মূলকথা। বিভিন্ন দেশে এ উচ্ছেদের ইতিহাসটায় ভিন্ন ভিন্ন দিক ফুটে ওঠে এবং তা এগোয় তার নানা পর্যায়ের বিভিন্ন অনুক্রমে ও ভিন্ন ভিন্ন পর্বে। কেবলমাত্র ইংলন্ডেই[১] তা একটা চিরায়ত রূপ নিয়েছিলো এবং একেই আমরা আমাদের দৃষ্টান্ত হিশেবে নেব।[২]

টীকাঃ

১. ইতালিতে, যেখানে পুঁজিবাদী উৎপাদন সবাগ্রে বিকশিত হয়, সেখানে ভূমিদাসত্বও লোপ পায় অন্যান্য স্থানের চেয়ে আগে। ভূমিদাস সে দেশে মুক্ত হয় জমিতে কোনো বৈধ সত্ত্বাধিকার অর্জন করার আগেই। মুক্তির ফলে সে সঙ্গে সঙ্গেই পরিণত হয় মক্ত প্রলেতারীয়তে, তদুপরি সে দেখে যে তার মনিব তার জন্য তৈরি হয়েই অপেক্ষা করছে শহরগুলিতে, যেটা রোমক যুগের ধারাবাহক একটা ব্যাপার। বিশ্ববাজারের বিপ্লব [কথাটায় পরিবহণ বাণিজ্যে জেনোয়া, ভেনিস ও উত্তর ইতালির অন্যান্য শহরের যে প্রাধান্য ছিলো তার প্রচন্ড অবনতির কথা বোঝাচ্ছেন মার্কস। এটা ঘটে ১৫শ শতকের শেষ দিকে, কিউবা, হাইতি, বাহামা দ্বীপপঞ্জ, উত্তর আমেরিকা আবিস্কার, আফ্রিকা ঘুরে ভারতে যাবার সমুদ্র পথ এবং শেষত দক্ষিণ আমেরিকা আবিস্কারের ফলে। – সম্পাদক] যখন ১৫শ শতকের শেষ দিকে উত্তর ইতালির বাণিজ্যপ্রাধান্য ধবংস করে, তখন একটা বিপরীত গতি শুরু হয়। শহরের শ্রমজীবীরা তখন দলে দলে গ্রামাঞ্চলে চলে আসে ও বাগানের আকারে ক্ষুদে চাষ এমন একটা প্রেরণা পায় যা আগে কখনো দেখা যায় নি।

আরো পড়ুন:  এই অতিমারী একটি সিংহদ্বার --- অরুন্ধতী রায়

২. এটি মার্কসের লিখিত পুঁজি গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের অষ্টম অধ্যায় পুঁজির উদ্ভবের প্রথম পরিচ্ছেদ। এখানে অংশবিশেষ সংকলিত হয়েছে প্রগতি প্রকাশন মস্কো, তারিখহীন থেকে প্রকাশিত পুঁজির উদ্ভব গ্রন্থের ৫-৮ পৃষ্ঠা থেকে এবং লেখাটি রোদ্দুরেতে প্রকাশিত হলো।

ভূমি থেকে কৃষিজীবী জনগণের উচ্ছেদ পড়ুন এই লিংক থেকে

পুঁজির উদ্ভব অধ্যায়ের সূচিপত্রে যান এই লিংক থেকে

1 thought on “আদি সঞ্চয়ের রহস্য”

Leave a Comment

error: Content is protected !!