পুঁজিবাদী দেশগুলিতে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ক্ষেত্রে বর্ধমান উত্তেজনা

জানুয়ারি ২৬, ১৯৩৪[১]

দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক সঙ্কটের একটি ফল হয়েছে এই যে পুঁজিবাদী দেশগুলির রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে— সেই দেশগুলির অভ্যন্তরে ও সেই দেশগুলির পারস্পরিক সম্পর্কক্ষেত্রে, উভয়তঃই এক অভূতপূর্ব উত্তেজনা বৃদ্ধি হয়েছে।

বৈদেশিক বাজারের জন্য তীব্র লড়াই, অবাধ বাণিজ্যের শেষ চিহ্নের অবলুপ্তি, নিবারক শুল্ক, বাণিজ্য যুদ্ধ, বৈদেশিক মুদ্রা যুদ্ধ, ডাম্পিং ও অন্যান্য অনেক অনুরূপ ব্যবস্থা যা অর্থনৈতিক কর্মনীতির ক্ষেত্রে চরম জাতীয়তাবাদের পরিচায়ক ও বিভিন্ন দেশের মধ্যে সম্পর্ককে চূড়ান্তভাবে বিষিয়ে তুলেছে, সামরিক সংঘাতের ভিত্তি তৈরি করেছে এবং অধিকতর শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলির অনুকূলে দুনিয়ার ও প্রভাবাধীন এলাকাসমূহের এক নতুন পুনর্বন্টন সম্ভব করার মাধ্যম হিসেবে যুদ্ধকেই সমসাময়িক কর্মসূচি করে তুলেছে।

চীনের বিরুদ্ধে জাপানের যুদ্ধ, মাঞ্চুরিয়া দখল, জাতিসংঘ থেকে জাপানের সরে আসা এবং উত্তর চীনে তার অভিযান পরিস্থিতিকে আরও বেশি ঘনীভূত করে তুলেছে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার জন্য তীব্র লড়াই এবং জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের নৌ-অস্ত্রশস্ত্রের বৃদ্ধি হলো এই বর্ধিত উত্তেজনার ফল।

জাতিসংঘ থেকে জার্মানির সরে আসা এবং লুপ্ত মর্যাদা উদ্ধারের জন্য তার প্রতিহিংসামূলক আচরণের সম্ভাবনার আতঙ্ক এই উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে ও ইউরোপে অস্ত্রবৃদ্ধিতে এই নতুন মদৎ যুগিয়েছে।

এতে বিস্ময়ের কিছু নেই যে বুর্জোয়া শান্তিবাদ আজ এক দুর্দশাজনক অস্তিত্ব নির্বাহ করছে এবং নিরস্ত্রীকরণের অলস প্রলাপের জায়গায় অস্ত্রীকরণ ও পুনরস্ত্রীকরণের ব্যবসায় সুলভ কথাবার্তা স্থান পাচ্ছে। ১৯১৪ সালের মতো আবার উগ্র সাম্রাজ্যবাদের শিবিরগুলি, যুদ্ধ আর প্রতিহিংসাবাদের শিবিরগুলি সম্মুখভাবে হাজির হয়েছে।

বেশ পরিষ্কার যে নতুন নতুন যুদ্ধের দিকেই সব কিছু আগুয়ান। এই একই উপাদানগুলির ক্রিয়াশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাদী দেশগুলির আভ্যন্তরীন পরিস্থিতি আরও উত্তেজক হয়ে পড়ছে। চার বছরের শিল্প সঙ্কট শ্রমিক শ্রেণিকে নিঃশেষ করে দিয়েছে এবং তাকে হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত করেছে। চার বছরের কৃষি-সঙ্কট শুধু প্রধান পুঁজিবাদী দেশেই নয়, সেই সঙ্গে—এক বিশেষ করে পরনির্ভর ও উপনিবেশিক দেশগুলিতে কৃষক সমাজের দরিদ্রতম স্তরকে চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করেছে। এটা ঘটনা যে বেকারত্ব হ্রাস করে দেখানোর জন্য পরিকল্পিত সর্ববিধ আঙ্কিক চাতুরি সত্ত্বেও বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠানগুলির সরকারি হিসেব অনুযায়ী বেকারের সংখ্যা ব্রিটেনে দাঁড়িয়েছে ৩০ লক্ষ, জার্মানিতে ৫০ লক্ষ এবং যুক্তরাষ্ট্রে এক কোটি। অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের কথা ছেড়েই দিলাম। এর সঙ্গে আংশিক বেকার এমন এক কোটিরও বেশি জনকে যোগ করুন; বিধ্বস্ত কৃষকদের বিশাল সাধারণকে জুডুন— আর তাহলেই আপনারা শ্রমজীবী মানুষের দারিদ্র্য আর নৈরাশ্যের এক আনুমানিক চিত্র পেয়ে যাবেন। ব্যাপক জনসাধারণ এখনো পর্যন্ত সেই পর্যায়ে পৌঁছায়নি যখন তারা পুঁজিবাদকে প্রচন্ড আঘাত হানতে প্রস্তুত; কিন্তু তাকে প্রচণ্ড আঘাত হানার ভাবনাটা যে ব্যাপক সাধারণের মনে দানা বেঁধে উঠবে সে ব্যাপারে সামান্যই সংশয় আছে। এ বক্তব্যের সত্যতা চমৎকারভাবে প্রমাণ হয়ে গেছে এই ধরনের তথ্যগুলির, যথা, উদাহরণস্বরূপ, স্পেনীয় বিপ্লব যা ফ্যাসিস্ট জমানাকে উৎখাত করেছে এবং চীনে সোভিয়েত জেলাগুলির প্রসার যাকে স্তব্ধ করতে চীনা ও বিদেশি বুর্জোয়া শ্রেণির মিলিত প্রতিবিপ্লব অক্ষম।

নিঃসন্দেহে এটাই ব্যাখ্যা করে যে পুঁজিবাদী দেশগুলিতে শাসক শ্রেণিগুলি কেন সেই পার্লামেন্টারীয় ও বুর্জোয়া গণতন্ত্রের শেষ চিহ্নগুলিকে এত উদ্দীপনাভরে বিনষ্ট করছে ও নাকচ করে দিচ্ছে যা শ্রমিক শ্রেণি নিপীড়কদের বিরুদ্ধে তার লড়াইয়ে ব্যবহার করতে পারত, কেন তারা কমিউনিস্ট পার্টিগুলিকে গোপনে কাজ করতে ঠেলে দিচ্ছে এবং তাদের একাধিপত্য বজায় রাখার জন্য প্রকাশ্য সন্ত্রাসবাদী পদ্ধতির আশ্রয় নিচ্ছে।

বৈদেশিক নীতির মূল উপাদান হিসেবে উগ্র জাতিদম্ভ ও যুদ্ধ প্রস্তুতি, ভবিষ্যৎ সমরাঙ্গনের পশ্চাদ্ভাগকে শক্তিশালী করার এক আবশ্যক পথ হিসেবে স্বরাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণিকে নিপীড়ন ও সন্ত্রাসবাদ— বিশেষ করে ঠিক এই জিনিসটাই এখন সমসাময়িক সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতিবিদদের মনকে আবিষ্ট রেখেছে।

এতে বিস্ময়ের কিছু নেই যে যুদ্ধবাজ বুর্জোয়া রাজনীতিবিদদের মধ্যে ফ্যাসিবাদই এখন সবচেয়ে কায়দাদুরস্ত পণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি শুধু সাধারণভাবে যা ফ্যাসিবাদ তারই উল্লেখ করছি না, সেই সঙ্গে মূলত জার্মান ধরনের সেই ফ্যাসিবাদের উল্লেখ করছি যাকে ভুলভাবে জাতীয় সমাজতন্ত্রবাদ বলে অভিহিত করা হয়—ভুলভাবে এই জন্য যে সবচেয়ে অনুসন্ধানী পরীক্ষাও এর মধ্যে পরমাণু পরিমাণ সমাজতন্ত্র উদঘাটন করতে ব্যর্থ হবে।

এই প্রেক্ষিতে জার্মানিতে ফ্যাসিবাদের জয়লাভকে অবশ্যই শুধু শ্রমিক শ্রেণির দৌর্বল্যের চিহ্ন হিসেবে এবং ফ্যাসিবাদের পথকে যারা তৈরি করেছে সেই স্যোশাল ডেমোক্রাসির হাতে শ্রমিক শ্রেণির প্রতারণার ফল হিসেবে গণ্য করা চলবে না; সেই সঙ্গে একে অবশ্যই গণ্য করতে হবে বুর্জোয়া শ্রেণির দুর্বলতার একটি চিহ্ন হিসেবে, একটি চিহ্ন হিসেবে যে বুর্জোয়া শ্রেণি আর পার্লামেন্টারীয় ও বুর্জোয়া গণতন্ত্রের পুরানো কায়দা দ্বারা শাসন করতে সক্ষম নয়, এবং ফলত তাদের স্বরাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে তারা সন্ত্রাসবাদী পদ্ধতির শাসনের আশ্রয় নিতে বাধ্য একটি চিহ্ন হিসেবে যে একটি শান্তিবাদী বৈদেশিক নীতির ভিত্তিতে তারা আর বর্তমান পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে পেতে সক্ষম নয় এবং ফলত তারা একটি যুদ্ধনীতির আশ্রয় নিতে বাধ্য।

আরো পড়ুন:  কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, জার্মান অথবা 'খাঁটি' সমাজতন্ত্র

এই হলো পরিস্থিতি।

দেখতেই পাচ্ছেন যে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে মুক্তির পথ হিসেবে এক নতুন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের অভিমুখেই সব কিছু এগিয়ে চলেছে।

অবশ্য এটা মনে করার কোনো ভিত্তিই নেই যে যুদ্ধ কোনো সত্যকারের মুক্তির পথ যোগাতে পারে। পক্ষান্তরে তা পরিস্থিতিকে আরও জট পাকিয়ে তুলতে বাধ্য। তদুপরি প্রথম সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের পথে যেমন ঘটেছিলো তেমনভাবেই তা নিশ্চিত কতকগুলি দেশে বিপ্লবের পথ খুলে দেবে এবং পুঁজিবাদের একেবারে অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলবে। আর যদি প্রথম সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও বুর্জোয়া রাজনীতিবিদরা যুদ্ধকেই আঁকড়ে ধরেন, যেমন ডুবন্ত মানুষ খড়কুঁটোকে আঁকড়ে ধরে, তাহলে সেটাই দেখিয়ে দেবে যে তারা এক নিরাশাব্যঞ্জক বিশৃঙ্খল অবস্থায় নিমজ্জিত হয়েছে, এক কানা-গলিতে ঢুকে পড়েছে এবং দ্রুত এক অতল গহ্বরে সরাসরি অধঃপতিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।

সুতরাং বুর্জোয়া রাজনীতিবিদদের মহলে এখন যে যুদ্ধ সংগঠনের পরিকল্পনা চলছে তাকে সংক্ষেপে পর্যালোচনা করা দরকার। অনেকে মনে করেন যে বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যেই কারুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ সংগঠিত করা উচিত। তাঁরা সেই শক্তিকে এক নিদারুণ পরাজয়ে জর্জরিত করার ও তারই মূল্যে নিজেদের বিষয়াদি উন্নত করার কথা ভাবেন। ধরা যাক যে তাঁরা এমন একটি যুদ্ধ সংগঠিত করলেন। এর ফল কি হতে পারে?

এটা সুবিদিত যে প্রথম সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সময়ও কোনো একটি অন্যতম বৃহৎ শক্তিকে, উদাহরণস্বরূপ, জার্মানিকে, ধ্বংস করার ও তার মূল্যে মুনাফা তোলার অভিপ্রায় হয়েছিলো। কিন্তু তারা জার্মানিতে বিজয়ীদের প্রতি এমন এক ঘৃণার বীজ বপন করেছিলো এবং প্রতিহিংসার প্রকাশের জন্য এমন এক উর্বর মাটি তৈরি করেছিলো যা আজও তারা তাদের সৃষ্ট সেই বিদ্রোহী বিশৃঙ্খলা দূর করতে পারেনি এবং সম্ভবত আগামী কিছু দিনের জন্য তা দূর করতে পারবেও না। পক্ষান্তরে, যে ফলটা তারা পেয়েছে তা হলো রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিনাশ, রাশিয়ায় সর্বহারা শ্রেণির বিপ্লবের বিজয় এবং— অবশ্যই সেভিয়েত ইউনিয়ন। এ বিষয়ে কি গ্যারান্টি আছে যে প্রথম সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধটির চাইতে দ্বিতীয়টি তাদের স্বপক্ষে ‘আরও উত্তম’ সব ফল সম্ভব করবে? বরং উল্টোটা হবে বলে মনে করাই কি আরও সঠিক নয়।

অন্যেরা ভাবেন যে যুদ্ধ সংগঠিত করতে হবে এমন এক দেশের বিরুদ্ধে যা সামরিক অর্থে দুর্বল কিন্তু যেখানে বিস্তৃত বাজার বিদ্যমান— যথা চীনের বিরুদ্ধে। চীনের সম্বন্ধে দাবি করা হয় যে তাকে সঠিক শব্দগত অর্থে রাষ্ট্র বলেও অভিহিত করা যায় না, তা হলো এমন নিছক ‘অসংগঠিত এলাকা’ যা শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলির দ্বারা অধিকৃত হওয়া দরকার। তারা স্পষ্টতঃই চীনকে পুরোপুরি ভাগ করে নিতে ও তার মূল্যে নিজেদের বিষয়াদি উন্নত করতে চায়। ধরা যাক যে তারা এমন একটি যুদ্ধই সংগঠিত করল। এর ফল কি হতে পারে?

এটা সুবিদিত যে আজকে যেমন চীনকে মনে করা হয় তেমনি উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ইতালি আর জার্মানিকেও একই চোখে দেখা হতো অর্থাৎ তাদেরকে রাষ্ট্র হিসেবে নয়, ‘অসংগঠিত এলাকা’ হিসেবেই গণ্য করা হতো এবং তাদের পদানত করে রাখা হয়েছিলো। কিন্তু তার ফলটা কি হয়েছিলো? এটা সুবিদিত যে তার ফলে জার্মানি ও ইতালি স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলো এবং এই দেশ দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলো। তার ফলে এই দেশ দুটির জনগণের হৃদয়ে নিপীড়কদের বিরুদ্ধে এমন বর্ধিত ঘৃণার উদ্রেক হয়েছিলো যার প্রতিক্রিয়া আজও মুছে যায়নি এবং ভবিষ্যতেও সম্ভবত কিছু দিনের জন্য মুছে যাবে না। প্রশ্ন উঠে: চীনের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদীদের যুদ্ধ থেকে যে সেই একই ফল বোরোবে না তার গ্যারান্টি কি আছে?

আবার অন্যেরা মনে করেন যে যুদ্ধ সংগঠিত করতে হবে এক ‘উন্নততর জাতি’কে যথা জার্মান ‘জাতিকে’ এক ‘হীনতর জাতি’র বিরুদ্ধে, মূলত শ্লাভদের বিরুদ্ধে; একমাত্র এরকম একটি যুদ্ধই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের পথ যোগাতে পারে। কারণ ‘উন্নততর জাতি’র মহৎ লক্ষ্য হলো ‘হীনতর জাতি’কে সফল করে তোলা ও তাকে শাসন করা। ধরা যাক যে এই অদ্ভুত তত্ত্বটি, যা আকাশ যেমন মাটি থেকে দূরে থাকে তেমনই বিজ্ঞান থেকে দূরে বিচ্ছিন্ন, ধরা যাক এই অদ্ভুত তত্ত্বটি বাস্তুবে রূপায়িত হলো। তার ফলটা কি হবে?

এটা সুবিদিত যে প্রাচীন রোম বর্তমানকালের জার্মান ও ফরাসিদের পূর্বপুরুষদেরকে তেমন চোখেই দেখত আজ যেমন উন্নততর জাতির প্রতিনিধিরা শ্লাভ জাতিদের দেখে। এটা সুবিদিত যে প্রাচীন রোম তাদের দেখত এক ‘হীনতর জাতি’ হিসেবে, এমন বর্বর হিসেবে যারা ‘উন্নততর জাতি’র মহান রোম’-এর পায়ের তলায় চিরকাল শাসিত হওয়ার জন্য অদৃষ্ট নির্ধারিত; আর আমাদের নিজেদের মধ্যে বলছি যে প্রাচীন রোমের এরকম করার কিছু ভিত্তি ছিলো যা আজকের ‘উন্নততর জাতি’র প্রতিনিধিদের সম্বন্ধে বলা চলে না। (তুমুল হর্ষধ্বনি)। কিন্তু এর পরিণতি কি হয়েছিলো ? পরিণতি হয়েছিলো এই যে অ-রোমানরা অর্থাৎ সকল ‘বর্বর’রা তাদের সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে একজোট হয়েছিলো এবং রোমের নিদারুণ পতন ঘটিয়েছিলো। প্রশ্ন ওঠেঃ আজকের উন্নততর জাতির প্রতিনিধিদের দাবিগুলিরও যে একই শোচনীয় পরিণতি হবে না তার গ্যারান্টি কি আছে? এতে গ্যারান্টি কি আছে যে বার্লিনের ফ্যাসিবাদী সাহিত্যিক রাজনীতিবিদেরা রোমের প্রাচীন ও অভিজ্ঞ বিজয়ীদের চাইতে আরও ভাগ্যবান হবেন? উল্টোটাই হবে বলে মনে করাই কি আরও সঠিক হবে না ?

আরো পড়ুন:  স্নায়ুযুদ্ধ বা ঠাণ্ডা লড়াই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন চালিত ব্যঙ্গ যুদ্ধ

সর্বশেষ অন্য কিছু লোক আছেন যারা মনে করেন যে ইউ.এস.এস.আর-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ সংগঠিত করতে হবে। তাদের পরিকল্পনা হলো ইউ.এস.এস.আর-কে পরাজিত করা, আর জমি ভাগ করে নেওয়া ও তার মূল্যে মুনাফা লোটা। এটা ভাবা ভুল হবে যে কেবল জাপানের কিছু সামরিক মহলই এরকম ভেবে থাকে। আমরা জানি যে ইউরোপের কতকগুলি দেশের রাজনৈতিক নেতাদের মহলেও অনুরূপ পরিকল্পনাই তৈরি হচ্ছে। ধরা যাক যে এই ভদ্রমহোদয়বৃন্দ যা বলেন তা-ই কাজে পরিণত করলেন। তার ফল কি হতে পারে?

এতে সংশয় সামান্যই থাকতে পারে যে এরকম কোনো যুদ্ধ হবে বুর্জোয়া শ্রেণির পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক যুদ্ধ। এটা সবচেয়ে বিপজ্জনক যুদ্ধ হবে শুধু এই কারণে নয় ইউ, এস,এস,আর-এর জনগণ বিপ্লবের অর্জিত লাভগুলিকে সংরক্ষণ করার জন্য প্রাণপাত লড়াই করবে; তা আরও এই কারণে বুর্জোয়া শ্রেণির পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক যুদ্ধ হবে যেহেতু তো শুধু সম্মুখ রণাঙ্গনেই নয়, শত্রুবাহিনীর পশ্চাদ্ভুমিতেও চালানো হবে। বুর্জোয়া শ্রেণির এ ব্যাপারে কোনো সংশয় রাখতে হবে না যে ইউরোপ ও এশিয়ায় ইউ.এস.এস.আর-এর শ্রমিক শ্রেণির যে অসংখ্য বন্ধু আছে তারা তাদের সেই শোষকদের পশ্চাদ্ভূমিতে আঘাত হানার জন্য সচেষ্ট হবে যারা সকল দেশের শ্রমিক শ্রেণির পিতৃভূমির বিরুদ্ধে এক অপরাধীসুলভ যুদ্ধ শুরু করেছে। এবং বুর্জোয়া মহাশয়গণ যেন আমাদের ওপর দোষারোপ না করেন যদি দেখেন যে তাঁদের সেই কাছের ও আদরের সরকারগুলি যেগুলি আজ ঈশ্বরের কৃপায় মহানন্দে শাসন চালাচ্ছে সেগুলির কেউ কেউ ঐ ধরনের একটি যুদ্ধের পর লোপাট হয় যায়। (বজ্রতুল্য হর্ষধ্বনি)

আপনাদের স্মরণ থাকতে পারে যে পনের বছর আগেই ইউ.এস.এস.আর-এর বিরুদ্ধে ঐরকম একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো। এটা সুবিদিত যে বিশ্ববন্দিত চার্চিল সাহেব সেই যুদ্ধকে চোদ্দটি রাষ্ট্রের অভিযান— এই কাব্যিক বক্তব্যে আড়াল দিয়েছিলেন। আপনাদের অবশ্যই স্মরণে আছে যে, সেই যুদ্ধ আমাদের দেশের সকল শ্রমজীবী মানুষকে এমন আত্মত্যাগী যোদ্ধাদের এক ঐক্যবদ্ধ শিবিরে সামিল করেছিলো যারা বিদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে তাদের শ্রমিক ও কৃষকের মাতৃভূমিকে নিজেদের প্রাণ দিয়ে রক্ষা করেছিলো। আপনারা জানেন যে, সে যুদ্ধের শেষ কিভাবে ঘটেছিলো। তা শেষ হয়েছিলো আমাাদের দেশ থেকে আক্রমণকারীদের বিতাড়নে এবং ইউরোপে বিপ্লবী সংগ্রাম কাউন্সিল[২]  গঠনে। এতে সংশয় সামান্যই থাকতে পারে যে ইউ.এস.এস.আর-এর বিরুদ্ধে একটি দ্বিতীয় যুদ্ধ আক্রমণকারীদের সম্পূর্ণ পরাজয়ে পরিণতি লাভ করবে, এশিয়ায় ও ইউরোপের অনেক দেশে বিপ্লব এবং সেই সব দেশে বুর্জোয়া-জমিদার সরকারগুলির ধ্বংস ডেকে আনবে।

হতবুদ্ধি বুর্জোয়া রাজনীতিবিদদের যুদ্ধ-পরিকল্পনাগুলি এমনই। দেখতেই পাচ্ছেন যে মস্তিষ্ক বা বীরত্ব কোনো কিছুতেই তারা বিশিষ্ট নয়।(হর্ষধ্বনি)

কিন্তু বুর্জোয়া শ্রেণি যেখানে যুদ্ধের পথ বেছে নেয়, সেখানে ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে চার বছরের সঙ্কট ও বেকারত্বে হতাশাগ্রস্ত শ্রমিক শ্রেণি বিপ্লবের পথ গ্রহণ করতে শুরু করেছে। এর অর্থ এই যে একটি বৈপ্লবিক সঙ্কট দানা বেঁধে উঠেছে এবং তা অব্যাহতভাবে দানা বেঁধে উঠবে। এবং বুর্জোয়া শ্রেণি যত বেশি তাদের যুদ্ধ পরিকল্পনায় জড়িয়ে পড়বে, যত বেশি করে তারা শ্রমিক শ্রেণি ও শ্রমজীবী কৃষক সমাজের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সন্ত্রাসমূলক পথের আশ্রয় নেবে ততই দ্রুত সেই বিপ্লবী সঙ্কট বিকশিত হবে।

কিছু কিছু কমরেড মনে করেন যে একবার যদি বৈপ্লবিক সঙ্কট আসে তা হলে বুর্জোয়া শ্রেণি এক হতাশাব্যঞ্জক অবস্থায় নিমজ্জিত হতে বাধ্য, তার অবলুপ্তি তাই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি, বিপ্লবের বিজয় তাই এতদ্বারা নিশ্চিত এবং তাদের যেটুকু করতে হবে তা হল বুর্জোয়া শ্রেণির পতনের জন্য অপেক্ষা করা এবং বিজয়ী প্রস্তাবসমূহ প্রণয়ন করা। এটা গুরুতর ভুল। বিপ্লবের বিজয় কখনো আপনা আপনি আসে না। তার জন্য অবশ্যই প্রস্তুতি নিতে হয় ও তা জয় করে নিতে হয়। আর, একমাত্র একটি শক্তিশালী সর্বহারা শ্রেণির বিপ্লবী পার্টিই সেই প্রস্তুতি নিতে পারে ও বিজয় জিতে নিতে পারে। এমন মুহূর্ত আসে যখন পরিস্থিতি বিপ্লবী, যখন বুর্জোয়া শ্রেণির শাসন তার একেবারে ভিত সমেত টলমলে তবু বিপ্লবের বিজয় এলো না কারণ জনসাধারণকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো ও ক্ষমতা দখল করার মতো যথেষ্ট শক্তিও মর্যাদার অধিকারী কোনো সর্বহারার বিপ্লবী পার্টি নেই। এরকম ‘ব্যাপার’ ঘটতে পারে না এই বিশ্বাস রাখাটা মূঢ়তা।

আরো পড়ুন:  গৃহযুদ্ধ হচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতার জন্য শ্রেণি, ধর্ম, জাতি, রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ

এই দিক থেকে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে[৩]  বিপ্লবী সঙ্কট প্রসঙ্গে লেনিনের বিবৃতি এই ভবিষ্যদ্বাণী সমৃদ্ধ কথাগুলি স্মরণ করা কার্যকর হবে;

“আমরা এখন আমাদের বিপ্লবী কার্যক্রমের বুনিয়াদ হিসেবে বিপ্লবী সঙ্কটের প্রশ্নে এসেছি। এবং এখানে আমাদের অবশ্যই দুটি ব্যাপকভাবে চালু ভুলকে সর্বপ্রথমে লক্ষ্য করতে হবে। একদিকে বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা এই সঙ্কটকে নিছক ‘অস্থিরতা’ বলে চিত্রিত করে, ঠিক ইংরেজরা যেমন চমৎকারভাবে এটা প্রকাশ করেছে। অপরদিকে বিপ্লবীরা কখনো কখনো এটা প্রমাণ করার প্রয়াস পান যে এই সঙ্কটটি একেবারেই আশাহীন। এটা ভুল। একেবারেই আশাহীন পরিস্থিতি বলে কোনও কিছু নেই। বুর্জোয়ারা এক মগজহারা উদ্ধত দস্যুর মতো ব্যবহার করে; তারা ভুলের পর ভুল করে আর এইভাবে পরিস্থিতিকে আরও সঙ্গীন করে তোলে এবং তাদের নিজেদের বিনাশই ত্বরান্বিত করে! এ সবই সত্য। কিন্তু এরকম “প্রমাণ” করা যায় না যে ছোটখাট রেয়াৎ ধরনের কিছু দিয়ে শোষিতদের কিছু সংখ্যালঘুকে প্রতারিত করার বা শোষিত ও নিপীড়িতদের কোনো কোনো অংশের কোনো আন্দোলন বা অভ্যুত্থানকে দমন করার কোনো সুযোগই আর আদপেই নেই। আগেভাগেই একটা পরিস্থিতিকে “চূড়ান্ত রকম” আশাহীন বলে “প্রমাণ” করার প্রয়াসটি হবে নিছক পন্ডিতীপনা, বা তত্ত্ব আর অভিনেতাদের শেষ কথা নিয়ে ভোজবাজী। এই বা এই ধরনের প্রশ্নগুলির ক্ষেত্রে একমাত্র সত্যিকারের “প্রমাণ” হলো ব্যবহারিকতা । সারা দুনিয়া জুড়ে বুর্জোয়া ব্যবস্থা এক অত্যন্ত গভীর বিপ্লবী সঙ্কটে পড়ে আছে। এখন বিপ্লবী পার্টিগুলিকে তাদের ব্যবহারিক কার্যক্রমের মাধ্যমে অবশ্যই “প্রমাণ” করতে হবে যে তারা এই সঙ্কটকে এক সফল ও বিজয়ী বিপ্লবের জন্য ব্যবহার করার মতো যথেষ্ট বুদ্ধিমান ও সংগঠিত, শোষিত জনগণের সঙ্গে তাদের যথেষ্ট যোগাযোগ আছে, তারা যথেষ্ট দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও দক্ষতাসম্পন্ন।”[৪]

তথ্যসূত্র ও টিকাঃ

১. সি.পি.এস. ইউ. (বি) -এর সপ্তম কংগ্রেস মস্কোতে ২৬ জানুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৪ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। সেই কংগ্রেসে প্রদত্ত রিপোর্টের অংশবিশেষ এই লেখাটি।
২. বিপ্লবী সংগ্রাম কাউন্সিল: ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশগুলির শ্রমিকদের বিপ্লবী সংগঠনগুলি সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ১৯১৮-২০ সালের সামরিক হস্তক্ষেপে অংশগ্রহণ করেছিলো। “সোভিয়েত রাশিয়ায় হাত গুটাও” এর স্লোগান অধীনে বিপ্লবী সংগ্রাম কাউন্সিল উত্থাপিত হয়েছে বিপ্লবী সংগ্রাম কাউন্সিলের নেতৃত্বে শ্রমিকরা হরতাল ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং যুদ্ধ সরঞ্জামগুলি লোড করতে অস্বীকার করে, যাতে হস্তক্ষেপের পতন ঘটানো যায়। ১৯২০ সালের দিকে ব্রিটেনে বিপ্লবী সংগ্রাম কাউন্সিলগুলি ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ছিল।
৩. কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেস ১৯২০ সালের ১৯ জুলাই- ৭ আগস্ট তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। এটি পেত্রোগ্রাদে আরম্ভ হয় এবং পরে পরবর্তী বৈঠক মস্কোতে অনুষ্ঠিত হয়। ৩৭টিরও বেশি দেশ থেকে শ্রমিক শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী ২০০ জনেরও বেশি প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ভি আই লেনিন কংগ্রেস আহ্বানের জন্য সমস্ত প্রস্তুতিমূলক কাজ পরিচালিত করেন। কংগ্রেসে লেনিন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের প্রধান কর্মসমূহের উপর একটি প্রতিবেদন পেশ করেন, পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিবেদন এবং বক্তৃতাসমূহ একটি রিপোর্ট বিতরণ করেন। ভি আই লেনিন এবং জে ভি স্তালিন আর.সি.পি (বি) প্রতিনিধিদলের দ্বারা কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল নির্বাহী কমিটির বৈঠক করার জন্য নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় কংগ্রেস প্রোগ্রামের ভিত্তি স্থাপন, সাংগঠনিক নীতি কৌশল এবং কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল কৌশল তৈরি করে।
৪. V. I. Lenin, Works, 4th Russ. ed., Vol. 31, pp. 202-03.

Leave a Comment

error: Content is protected !!