গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে বিপ্লবের ফোকো তত্ত্ব, যা ফোকালিজম (স্প্যানিশ: foquismo) নামেও পরিচিত, প্রণয়ন করা হয়েছিল ফরাসি বুদ্ধিজীবী ও সরকারী কর্মকর্তা রেগিস ডেব্রের দ্বারা। দেব্রের মূল অনুপ্রেরণা ছিলেন মার্কসবাদী বিপ্লবী চে গ্যেভারা। ১৯৬০-এর দশকে চে গ্যেভারা ১৯৫৯ সালের কিউবান বিপ্লবের সময় তার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তার বই গেরিলা যুদ্ধে বিপ্লবের ফোকো তত্ত্বটির বিকাশ করেছিলেন।
চে গ্যেভারা পার্টিকে মার্কসবাদী ধারায় না চালিয়ে, ফিদেল ক্যাস্ত্রোর মতোই গেরিলা যুদ্ধের উপর নির্ভর করেছিলেন। এই মতবাদে প্রধান কেন্দ্রবিন্দু থাকে ছোট একটি গেরিলা ইউনিট দ্বারা আক্রমণের মাধ্যমে অতর্কিত ক্ষমতা করায়ত্ব করার দিকে। ফোকোবাদে প্রলেতারিয়েতের অগ্রগামী পার্টির কোন প্রয়োজন নেই, গেরিলাবাদী সামরিক সংগঠন থাকলেই হবে। এই মতবাদ সমরবাদী কারণ তা রাজনীতির ঊর্ধ্বে যুদ্ধকে স্থান দিয়ে থাকে।
ফোকো তত্ত্বের বা ফোকো মতবাদের কেন্দ্রীয় নীতিটি হলো ছোট, দ্রুত-চলমান আধা-সামরিক বাহিনীর ক্যাডারদের দ্বারা পরাক্রমশালী একটি প্রতিষ্ঠিত স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের জনপ্রিয় অসন্তোষের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা [ইংরেজি: Focus, স্প্যানিশ: foco] হতে পারে, এবং এর ফলে সাধারণ বিদ্রোহের সৃষ্টি হয়। চে গেরিলা যুদ্ধ এবং অস্ত্র হাতে তুলে নেবার যুক্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে যা বলেন তাতে এই কথায় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বিদ্রোহ ন্যায়সংগত,
“গেরিলা যোদ্ধারা কেন যুদ্ধ করে? শেষ পর্যন্ত অনিবার্যভাবেই আমাদের বুঝতে হবে যে গেরিলা যোদ্ধা হচ্ছে একজন সমাজ সংগঠক, যে অস্ত্র তুলে নেয় নিপীড়ক শাসকের বিরুদ্ধে জনতার হয়ে উত্তর দেবার জন্য, এবং সে যুদ্ধ করে সেই সমাজব্যাবস্থার বিরুদ্ধে যা তার অস্ত্রহীন ভাইদের অবমাননা ও দুর্দশার ভেতরে রাখে।”[১]
ফোকো মতবাদে যদিও মূল দৃষ্টিভঙ্গি প্রবর্তন করা হয়েছিলো গ্রামাঞ্চলে হামলা চালানোর, তবে ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে ফোকো ধারণা শহুরে গেরিলা যুদ্ধের আন্দোলনে রূপায়িত হয়েছিলো। চে পার্টিতে ক্যাডারদের গুরুত্ব সম্পর্কে লিখেছিলেন,
“‘ক্যাডার’ নিজে একজন স্রষ্টা, খুব উঁচুদরের নেতা, খুব উঁচু স্তরের রাজনৈতিক কুশলী, যে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মধ্যে দিয়ে তার উৎপাদন বিভাগকে নেতৃত্ব দিতে পারে এবং রাজনৈতিক অগ্রদূত হিসেবে জনগণকে শিক্ষিত করে তুলতে পারে।”[২]
গ্যেভারাবাদ
চে’র চিন্তাকে বর্তমানে গ্যেভারাবাদ হিসেবে অভিহিত করা হয়। চে গ্যেভারার চিন্তার সাথে মাওবাদের সাথে পার্থক্য আছে। মাওবাদ পার্টি এবং জনমতের উপর গুরুত্ব দেয়। মাওবাদ দীর্ঘমেয়াদী গণযুদ্ধের উপর গুরুত্ব দেয়। কিন্তু চে এবং ফোকো মতাদর্শ আকস্মিক ক্ষমতা দখলে গুরুত্ব দেয়। এছাড়াও চে খ্রুশ্চেভপন্থী শান্তিবাদী আন্দোলনের পক্ষেও থাকেন। শান্তির সময় এবং যুদ্ধের সময়ের পার্থক্য তৈরি করেন না এবং লেনিনবাদ ও মাওবাদের মতো যুদ্ধ যে রাজনীতিরই ধারাবাহিক রূপ তা খেয়াল করেন না। তিনি গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কে লিখেছেন,
“যখন একটি ভোট ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে একটি সরকার ক্ষমতায় আসে, সেটা প্রতারণা করে হোক আর না হোক, এবং সামান্য হলেও সাংবিধানিক বৈধতা রক্ষা করে, তখন গেরিলা যুদ্ধ সংগঠন করা যাবে না। কারণ তখনও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়নি।”[৩]
গ্যেভারাবাদের পেটি বুর্জোয়া চরিত্রকে সমালােচনা ও বর্জনের পাশাপাশি চে’র মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরােধী সাহসী সংগ্রাম ও আত্মবলিদানের গুরুত্বকে বাতিল করা যাবেনা।
তথ্যসূত্র:
১. চে গ্যেভারা, গেরিলা যুদ্ধ প্রসঙ্গে, (১৯৬০), অধ্যায় ১।
২. চে গুয়েভারা রচনা সমগ্র, মাহবুব কামরান সম্পাদিত, র্যামন পাবলিশার্স, ‘নিপীড়িত মানুষের মেরুদণ্ড’ থেকে
৩. চে গ্যেভারা, গেরিলা যুদ্ধ প্রসঙ্গে, গেরিলা যুদ্ধের সাধারণ নীতিসমূহ, অধ্যায় এক, ১৯৬০
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।