গেরিলা যুদ্ধ তৎপরতা (ইংরেজি: Guerrilla Warfare) হচ্ছে অনিয়মিত যুদ্ধ তৎপরতার একটি ধরন যেখানে যুযুধান ছোট গোষ্ঠীগুলো যেমন আধাসামরিক কর্মী বাহিনী, সশস্ত্র বেসামরিক বাহিনী বা অনিয়মিত বাহিনীরা বিভিন্ন রণকৌশলসমূহ অবলম্বন করে। এসব সামরিক কৌশলের ভেতরে থাকে ঘাপটি মারা, নাশকতা, অতর্কিত হানা, ক্ষুদ্র যুদ্ধ তৎপরতা, আঘাত-ও-পলায়ন কৌশল এবং গতিশীলতার মাধ্যমে একটি বৃহত্তর এবং কম গতিশীল প্রথাগত সামরিক বাহিনির বিরুদ্ধে লড়াই। গেরিলা গোষ্ঠীগুলি হচ্ছে এক ধরণের হিংসাত্মক অ-রাষ্ট্রীয় কর্মী।
অর্থাৎ গেরিলা যুদ্ধ তৎপরতা হচ্ছে বিজেতা বিদেশি শক্তি, দখলকারী সেনাবাহিনী কিংবা দেশেরই উৎপীড়ক শাসকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত এক ধরনের অঘােষিত, বিক্ষিপ্ত ও সশস্ত্র গণসংগ্রাম। এর কর্মপদ্ধতি হলো অন্তরালে গােপনে অবস্থান করে আচমকা ও অন্তর্ঘাতমূলক সশস্ত্র আক্রমণ।[১]
স্পেনীয় ভাষা থেকে শব্দটির উদ্ভব ও প্রচলন হয়। দ্বিতীয় বিশ্ব-মহাযুদ্ধের পূর্বে স্পেনের গৃহযুদ্ধ ও চীনদেশে দখলকারী জাপানি ফৌজের বিরুদ্ধে সংগ্রামসূত্রে এটি দেখা দেয়। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী ও বৈপ্লবিক, উভয় ধরনের সংগ্রামেই এই কৌশল প্রয়ােগ করা হয়। কৌশলটি সম্পর্কে মাও সেতুং, আর্জেন্টিনার চে গুয়েভারা, ফরাসি কমিউনিস্ট রেজিস ডেবরে প্রমুখ বিপ্লবী নেতারা নানা ধরনের তত্ত্ব উদ্ভাবন করেছেন।
১৯৬০-এর দশকে মার্কসবাদী বিপ্লবী চে গ্যেভারা ১৯৫৯ সালের কিউবান বিপ্লবের সময় তার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তার বই গেরিলা যুদ্ধে বিপ্লবের ফোকো (স্প্যানিশ: foquismo) তত্ত্বটি বিকাশ করেছিলেন। চে সেই গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে বলেছেন,
“গেরিলা যোদ্ধারা কেন যুদ্ধ করে? শেষ পর্যন্ত অনিবার্যভাবেই আমাদের বুঝতে হবে যে গেরিলা যোদ্ধা হচ্ছে একজন সমাজ সংগঠক, যে অস্ত্র তুলে নেয় নিপীড়ক শাসকের বিরুদ্ধে জনতার হয়ে উত্তর দেবার জন্য, এবং সে যুদ্ধ করে সেই সমাজব্যাবস্থার বিরুদ্ধে যা তার অস্ত্রহীন ভাইদের অবমাননা ও দুর্দশার ভেতরে রাখে।”[২]
মাও সেতুং মনে করতেন জনগণের সশস্ত্র সংগ্রাম ও ক্ষমতা দখলের ক্রিয়াকৌশলে গেরিলা যুদ্ধ পদ্ধতি একান্তই আবশ্যক। ডেবরে আরও একটু এগিয়ে গিয়ে বলেন যে বিপ্লবের পরিস্থিতি সৃষ্টির পক্ষে জনগণের সমর্থন অপেক্ষা গেরিলা যুদ্ধের প্রক্রিয়া অনেক বেশি কার্যকর। ওই সমস্ত তত্ত্বেই রাজনৈতিক ও সামরিক, উভয় প্রকার ভূমিকায় দলের কর্মপন্থাকে সঠিকভাবে রূপায়ণ গেরিলা আন্দোলনের পক্ষে সম্ভব। শহরাঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধ সন্ত্রাসবাদের সমার্থক হয়ে পড়েছে। গৃহযুদ্ধ অনেক সময় গেরিলা যুদ্ধের কর্মকৌশল অনুসরণ করে। তবে প্রতিবিপ্লবী ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিও ক্ষেত্রবিশেষে গেরিলা যুদ্ধের আকৃতি গ্রহণ করে।
দ্রষ্টব্য: মাওবাদ; গৃহযুদ্ধ
তথ্যসূত্র:
১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ১০১।
২. Guevara, Ernesto; Davies, Thomas M. Guerrilla Warfare, Rowman & Littlefield, 1997, ISBN 0-8420-2678-9, p. 52
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।