ব্যক্তিবাদ বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বলতে কি বুঝায়

ব্যক্তিবাদ বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ (ইংরেজি: Individualism) প্রত্যয়টির মর্মার্থ হলো হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত অবাধ ব্যক্তিসত্তা।[১] রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে ইউরোপে মধ্যযুগের পরবর্তীকালে নিরঙ্কুশ শক্তিসম্পন্ন রাজা বা সরকারকে রাষ্ট্রের প্রতিভূ বিবেচনা করে রাষ্ট্র বনাম ব্যক্তি হিসাবে ব্যক্তির স্বাধীনতা, অধিকার প্রভৃতির পক্ষে যুক্তিমূলক তত্ত্বকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বলে অভিহিত করা হয়। এই পটভূমিতে এমন কথাও বলা হয় যে, কোনো একটি সমাজে ব্যক্তি হচ্ছে সার্বভৌম, সরকার তথা রাষ্ট্র নয়।[২]

ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে রাষ্ট্র ব্যক্তিমানুষকে স্বাধীনভাবে চলতে দেয়। এই মতবাদে সমাজজীবনের কেন্দ্রবিন্দু হলো মানুষ। মানুষের স্থান যাবতীয় বিষয়ের উর্ধ্বে । রাষ্ট্রের কাজ হলো ব্যক্তিমানুষকে হিংসা ও বঞ্চনা থেকে রক্ষা করা; তার জীবনকে কোনও ভাবে নিয়ন্ত্রণ না করা। মানুষের জীবনে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ অনুচিত। এই মতবাদের মূল উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দান এবং তাতে রাষ্ট্রের ন্যূনতম হস্তক্ষেপ।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদীদের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা হলো যাবতীয় বিপদ-আপদ, পারস্পরিক বিরোধ, সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি এবং চুক্তির লঙ্ঘন থেকে নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান। তার বাইরে মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক কোনও ব্যাপারেই রাষ্ট্রের অনুপ্রবেশ বাঞ্ছিত নয়। বাক্তিস্বাতন্ত্রবাদীদের দৃষ্টিতে মানুষের সৃজনশীল শুভসত্তার স্বাধীন বিকাশের পক্ষে রাষ্ট্র এক অশুভ অন্তরায়।

ব্যক্তিবাদ বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ-এর ইতিহাস

ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের উৎপত্তি ঘটে সামাজিক চুক্তি তত্ত্বগুলি থেকে। ইংল্যান্ডে সপ্তদশ শতকে এবং ফরাসি দেশে অষ্টদশ শতকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ তত্ত্বের বিশেষ আলোচনা দেখা যায়। রাষ্ট্রের উদ্ভব কিভাবে হয়েছে? রাষ্ট্রচিন্তার এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের ভিত্তিতে বলা হতে থাকে, ঈশ্বর কিংবা রাজা নয়; রাষ্ট্র উদ্ভূত হয়েছে মানুষের আদি বা প্রাকৃতিক অবস্থাতে সার্বভৌম ব্যক্তির সঙ্গে সার্বভৌম ব্যক্তির চুক্তির ভিত্তিতে। এই তত্ত্ব ‘সোশ্যাল কনট্রাস্ট থিউরি’ বা ‘সামাজিক চুক্তি তত্ত্ব’ নামে পরিচিত।[২]

অষ্টাদশ শতকে স্বৈরতন্ত্রী ও পরমবাদী রাজতন্ত্রী সরকারের নিরন্তর নিপীড়ন-দৃষ্টে রাষ্ট্রদার্শনিকেরা ব্যক্তিমানুষের স্বাধীন সত্তার উপর গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। ফ্রান্সে অবাধ বাণিজ্য নীতির প্রবক্তা ফিজিওক্রাট নামে অভিহিত অর্থনীতিবিদরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে তার আদিপর্বে অর্থনৈতিক ব্যঞ্জনা প্রদান করেন। তাঁরা সমকালীন মার্কেন্টাইলিস্ট নামক অর্থনীতিবিদদের সরকারি নিয়ন্ত্রণমূলক আর্থিক বিধিব্যবস্থার মতবাদকে নাকচ করে দেন।

ফিজিওক্র্যাটদের বাক্তিস্বাতন্ত্রবাদী অবাধ বাণিজ্যের মতবাদ ক্রমে সারা ইউরোপে প্রভাব বিস্তার করে। অ্যাডাম স্মিথ (১৭২৩-৯০) প্রমুখ ইংরেজ অর্থনীতিবিদ মতবাদটিকে পরিপুষ্ট করেন। কিন্তু সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রস্তুত করেন জন স্টুয়ার্ট মিল, হাবার্ট স্পেনসার প্রমুখ রাষ্ট্রদার্শনিকেরা। আলোকিত শতাব্দীর (ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্ট) অনুষঙ্গী বাণী ছিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। ব্যক্তিস্বাধীনতার উপাদানে গড়ে ওঠে উদারনৈতিক মতবাদ

গোড়ায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ যতই জনপ্রিয়তা লাভ করে থাকুক না কেন, কালক্রমে সেটা ক্ষুন্ন হতে শুরু করে। অর্থনৈতিক সংকট, বেকার সমস্যা, জনগণের ক্রমবর্ধিষ্ণু দুর্গতির ফলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা থেকে গোষ্ঠীকেন্দ্রিকতার দিকে ঝোঁকে। সমষ্টিবাদী নানা মতবাদও বেড়ে ওঠে। একনায়কতন্ত্রী রাষ্ট্রের দাপটে ব্যক্তিস্বাধীনতা অস্তমিত হয়। ফলে ভারসাম্য সুরাহার পথ খোঁজার প্রয়াস দেখা দেয়।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও সমাজ

ইংল্যান্ডের টমাস হবস এবং জন লক সপ্তদশ শতকে এবং ফ্রান্সের রূশো অষ্টাদশ শতকে তাঁদের বিখ্যাত গ্রন্থসমূহ যথা ‘লেভিয়াথান’, ‘টু ট্রিটিজেস অন সিভিল গভর্ণমেন্ট’ এবং ‘সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’ এ রাষ্ট্রের উদ্ভব, সরকারের ভূমিকা এবং ব্যক্তির অধিকার প্রভৃতি প্রশ্নের উপর সামাজিক চুক্তি তত্ত্বের ভিত্তিতে তাঁদের নিজ নিজ চিন্তা প্রকাশ করেন। এই সকল চিন্তাবিদের চিন্তায় এবং একালের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থায় ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদ ছিল স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে ব্যক্তির স্বাধীনতা বোধের প্রকাশ। আসলে এই কাল ছিল সামন্ততান্ত্রিক পর্যায় থেকে ধনতান্ত্রিক পর্যায়ে সমাজের বিকাশ কাল।

নতুন উদীয়মান ধনতান্ত্রিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সামন্ততন্ত্র এবং স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ব্যক্তির অধিকারের ঘোষণাই ছিল ইংল্যান্ডের ১৬৪৯ এবং ১৬৮৮ সালের বিপ্লবাত্মক ঘটনাসমূহ, আমেরিকার ১৭৭৬ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য। সেই সময় থেকে ব্যক্তিবাদ বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ তত্ত্বেরও বিকাশ ঘটেছে। গোড়াকার সেই আমলের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ রাষ্ট্র এবং সরকারকে ব্যক্তির বিরোধী অস্তিত্ব বলে বিবেচনা করত। এবং সে কারণে ব্যক্তির জীবনে রাষ্ট্র এবং সরকারের যত কম হস্তক্ষেপ ঘটে, তত মঙ্গল বলে মনে করা হত। রাষ্ট্র বা সরকার ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা এবং বাইরের আক্রমণ থেকে তাকে রক্ষা করবে। এর অধিক কোনো দায়িত্ব ব্যক্তি রাষ্ট্র বা সরকারকে প্রদান করে নি। এ চিন্তার মধ্যে জোর ছিল ব্যক্তির সর্বপ্রকার কর্মকান্ডে, বিশেষ করে তাঁর অর্থনৈতিক উদ্যোগের ক্ষেত্রে, রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তার উপর।

পুঁজিবাদের বিকাশের যুগে অবাধ প্রতিযোগিতার একটি তাত্ত্বিক ভূমিকা একালের ব্যক্তিবাদ বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ পালন করে। হবস, লক এবং রুশোর পরে হার্বাট স্পেন্সারের মধ্যে চরম ব্যক্তিস্বা্তন্ত্র্যবাদী চিন্তার প্রকাশ দেখা যায়। কিন্তু পুঁজিবাদের বিকাশ এবং তার অন্তর্নিহিত সামাজিক সমস্যার ক্রমবৃদ্ধি চিন্তাবিদদের মধ্যে আবার এই বোধের ও সৃষ্টি করতে থাকে যে, রাষ্ট্র বনাম সরকার তথা ব্যক্তি বোধটি বিদ্যমান সামাজিক সমস্যার চরিত্র অনুধাবনে এবং তার সমাধানে যথেষ্ট নয়। রাষ্ট্র এবং সরকার যেমন ব্যক্তির মঙ্গলের জন্য সৃষ্টি, তেমনি ব্যক্তির জীবনের সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয় ভূমিকাকে বাঞ্চিত বলে গণ্য করা যায় না। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের এরূপ ব্যাখ্যার সাক্ষাৎ বেনথাম, জন ষ্টুয়ার্ট মিল এবং টি.এইচ.গ্রীন প্রমুখের রচনার মধ্যে পাওয়া যায়। এরূপ ব্যাখ্যাকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বা উদারতাবাদের সংশোধন বলেও অনেক সময়ে আখ্যায়িত করা হয়।

ব্যক্তিবাদ বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ-এর সমালোচনা

ব্যক্তিমানুষের জীবন, ও মননের স্বাধীন বিকাশের প্রসঙ্গ রাষ্ট্রদর্শনে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের এক মস্ত অবদান। সেইসঙ্গে একথাও উল্লেখ্য যে চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ফলে মানুষ স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক, অসামাজিক ও সংকীর্ণচিত্ত হয়ে পড়ে। কাজেই মানুষের স্বাধীন বিকাশের প্রয়োজন যেমন থাকে, তেমনি সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের সঙ্গে সমাজের পারস্পরিক দায়দায়িত্ব অপরিহার্য। সমাজই অধিকার সৃষ্টি করে এবং উপযোগী পরিবেশে তার বিকাশ ঘটায়। সামাজিক সম্পর্কেই মানুষকে জানা যায়। রাষ্ট্র সমাজের একটি কার্যনিবাহী অঙ্গ। ব্যক্তিমানুষের স্বার্থ, উদ্যম ও নিরঙ্কুশ বিকাশের স্বাধীনতা অব্যাহত রেখে সমষ্টিগত স্বার্থ, চাহিদা, প্রয়োজন ও সমস্যাদির ভারসাম্য বিধিবিধানের ও প্রশাসনিক কার্যনিবাহের সঙ্গে রাষ্ট্রের সুসমঞ্জস ভূমিকা থাকা বাঞ্ছনীয়।

তথ্যসূত্র:

১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ২১৫-২১৬।
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২২২-২২৩।

আরো পড়ুন:  সংস্কারবাদ শ্রমিক শ্রেণির শ্রেণিসংগ্রাম, বিপ্লব ও ক্ষমতাকে অস্বীকার করে

Leave a Comment

error: Content is protected !!