আইন হচ্ছে মানুষের বহির্মুখ আচরণ নির্দেশনা সংক্রান্ত নিয়মাবলির গুচ্ছ

আইন (ইংরেজি: Law) প্রাত্যহিক জীবনে নানান অর্থে ব্যবহৃত একটি শব্দ। কিন্তু আইন শব্দটির সংজ্ঞাও আছে বিভিন্নরকম; তার একটিতে বলা হয়েছে যে আইন হলো কিছু সামাজিক নিয়মাবলির গুচ্ছ যার কাজ হলো বিচারযােগ্য হিসেবে বিবেচিত মানুষের বহির্মুখ আচরণ সম্পর্কে নির্দেশকরণ। সংজ্ঞাটির বিভিন্ন উপাদান, যথা, সামাজিক ‘নিয়মাবলি’, ‘নির্দেশকরণ’, ‘বহির্মুখ’, ‘আচরণ’, ‘বিচারযােগ্য বিবেচিত’ শব্দগুলির তাৎপর্যের ব্যাখ্যা প্রয়ােজন;

(১) ‘সামাজিক’ বলতে স্বতঃই আইন একাধিক মানুষের উপর প্রযোজ্য, যারা সমাজের সদস্য, (২) ‘নিয়মাবলি’র মধ্যে নানাবিধ আইনের অলিখিত রীতিনীতি ও প্রচলিত প্রথা ধর্তব্য। আইন হওয়া উচিত সর্বাত্মক ; (৩) ‘নির্দেশকরণ’ বলতে বাধ্যতা বােঝায়, আইন মেনে চলা ঐচ্ছিক নয়; না মানাটা দণ্ডনীয়, (৪) ‘বহির্মুখ’ বলতে আইনের আওতায় লােকের সমাজ গ্রাহ্য ও প্রকাশ্য আচরণ বিবেচ্য; কারও নিজস্ব চিন্তা বা মনােভাব ধর্তব্য নয়। কোনও কোনও দেশে অবশ্য লােকের নিজস্ব ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা ও আচরণে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করে; সরাসরি কোনও বিশ্বাস কারও উপর চাপিয়ে না দিলেও ধর্মীয় কিংবা দলীয় অনুষ্ঠান ও ক্রিয়াকলাপে বিপক্ষের লোককে যােগ দিতে বাধ্য করে। (৫) আচরণ বলতে কারও নিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিনিধির আচরণ যার কোনও দূষণীয় ব্যাপারে তাকে দায়ী করা যায়; (৬) ‘বিচারযােগ্য’ বলতে রায়দানের ক্ষমতাসম্পন্ন কোনও আদালতের সামনে বিচারভাজন হওয়া; (৭) ‘বিবেচিত’ মানে রাষ্ট্র কর্তৃক আইনসভায় বিবেচিত হওয়া এবং বিষয়টা সেইসব ব্যক্তির কাছে ব্যাখ্যা করা যাদের রাষ্ট্র ও আইন প্রণয়ন সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট।

আইনী তত্ত্ব

মূল নিবন্ধ আইনশাস্ত্র হচ্ছে আইনের উৎপত্তি, প্রকৃতি ও বিকাশ সংক্রান্ত তত্ত্বগত বিদ্যা

আইনশাস্ত্র বা বিধিশাস্ত্র হচ্ছে আইনের উৎপত্তি, প্রকৃতি ও বিকাশ সংক্রান্ত তত্ত্বগত বিদ্যা। ত্রয়ােদশ থেকে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রত্যয়টিকে প্রাকৃত, আইন হিসেবে দেখা হত এবং মনে করা হত যে প্রাকৃত আইনের পিছনে থাকে দিব্য নির্দেশ। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই নানারকম তত্ত্ব গড়ে ওঠে যে আইনের ভিত্তি সার্বভৌম কর্তৃত্বের বিধিবিধান।

আইনের বিভিন্ন রূপ

সাধারণভাবে উল্লিখিত সংজ্ঞার ভিত্তিতে আইন সম্পর্কে কয়েকটি ৩ত্ত্বের আলােচনা করা যেতে পারে।

প্রাকৃত আইন

প্রাকৃত আইন (ইংরেজি: natural law) হচ্ছে প্রাকৃত অধিকারের মতাে কিছু প্রাকৃত আইন আছে, যেগুলির প্রয়োেগ ক্ষেত্রবিশেষে রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের সীমা নির্ধারণ করে। প্রাকৃত আইনে লােকের আস্থা বেশি না থাকলেও, সমাজজীবনে এমন অনেক স্থায়ী মূল্যবোেধ বা নীতি আছে যেগুলি সদাচার ও যুক্তিবােধের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে সেগুলিকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের মাধ্যমে সচল রাখা বিধেয়। প্রাকৃত আইন বিভিন্ন বিষয়ের প্রাকৃতিক গতির সঙ্গে সুসমঞ্জস হওয়া চাই। প্রাকৃত আইনের দু ধরনের উৎসের কথা বলা হয়: একটি হলো ঈশ্বরের বিধান, অপরটি যুক্তিশীলতার আবেদন।

আইনানুগ দৃষ্টবাদ

আইনানুগ দৃষ্টবাদ (ইংরেজি: legal positivism) হচ্ছে বেনথাম ও জন অস্টিনের দার্শনিক চিন্তাধারা এবং তারা দুজন ছিলেন এর প্রবক্তা। এই মতবাদ অনুসারে প্রাকৃত আইনের পরিবর্তে মানুষের সামাজিক প্রথা বা সর্বস্বীকৃত রীতিনীতিগুলি তাদের কর্তৃত্ব বা কার্যকারিতা আইনসভা থেকে অর্জন করে। সার্বভৌম কর্তৃত্বসম্পন্ন ব্যক্তি (রাজা, সম্রাট ইত্যাদি) অথবা আইন প্রণয়নের কর্তৃত্বসম্পন্ন সভা বা সংসদের অনুমােদনভিত্তিক আইন। প্রাকৃত আইনের সঙ্গে এর পার্থক্য হলো যে দৃষ্টবাদী আইন সম্পূর্ণভাবে মানুষের দ্বারাই প্রস্তুত হয়। এগুলিকে সংবিধিও (statute) বলা চলে, যা মূলত সংসদে বিধিবদ্ধ হয়। উল্লিখিত ধরনের আইন থেকে আবার একই গােত্রের প্রচলিত আইনের (common law) পার্থক্য এই যে শেষােক্ত আইনগুলি আদালতে প্রদত্ত রায় থেকে গড়ে ওঠে আইনানুগ বাস্তববাদ (legal realism)। সাধারণত আলােচনাদিতে দেখা যায় আইনের মুখ্য বিষয়ের উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় যখন নির্দেশক বিধান কিছু থাকে না। আইন হলো সমাজেরই একটি কর্মধারা, তাতে শাস্তি ও নিবৃত্তির নির্দেশক বিধানের কথা থাকা উচিত। কাজেই আইনের আলােচনায় তার নির্দেশক বিষয়সমূহ থাকা উচিত; কারণ নির্দেশের দিকগুলির পরিপ্রেক্ষিতেই আদালতে আইনের আলােচনা হয়।

উল্লিখিত আলােচনা থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে সুশৃঙ্খল ও সুসমঞ্জস সমাজজীবনের জন্য আইন অপরিহার্য। আইন প্রণয়ন ও প্রয়ােগে রাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে মতভেদ আছে। আইনের উৎস সম্পর্কে জটিলতাই এর কারণ। অনেক সূত্রেই আইনের সৃষ্টি হতে পারে, যথা সামাজিক প্রথা, ধর্ম, আদালতের সিদ্ধান্ত, ন্যায়পরায়ণতা, আইনজ্ঞদের বিজ্ঞানসম্মত আলােচনা, আইনসভায় গৃহীত নিয়মকানুন ইত্যাদি।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনেকে আইনকে দুভাগে ভাগ করেন: জাতীয় (national) আইন ও আন্তর্জাতিক আইন (international law)। জাতীয় আইনকে সাংবিধানিক আইন (constitutional) ও সাধারণ (ordinary) আইন, এই দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। সাধারণ আইনের মধ্যে পড়ে সরকারি (public) এবং বেসরকারি (private) বা ব্যক্তিগত আইন। সরকারি আইনের মধ্যে পড়ে প্রশাসনিক (administrative) এবং সাধারণ বিষয়ক (general) আইন। সাধারণ বিষয়ক আইনসুত্রে এসে পড়ে দেওয়ানি (civil), ফৌজদারি (criminal), প্রচলিত (common), সংবিধি (statute), অধ্যাদেশ (ordinance) ইত্যাদি।

বৈজ্ঞানিক বিধান

প্রাকৃতিক জগতে বস্তুপুঞ্জের নিত্যগতির নিয়ামক আত্মন্তিক সম্পর্ককে বিধান বা বৈজ্ঞানিক বিধান (ইংরেজি: Scientific Law) বলা হয়। পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বস্তুতে বস্তুতে কার্য্কারণের সুনির্দিষ্ট সূত্রকে আমরা বিধান বলি। মানুষের জ্ঞানের বিকাশে বিধানের বোধ তার চেতনার অগ্রগতির একটি বিশেষ পর্যায় সূচিত করে। বস্তুপুঞ্জের পর্যবেক্ষণে মানুষ যখন তার বহিঃপ্রকাশ এবং অন্তঃসত্ত্বার মধ্যে, অস্থায়ী এবং স্থায়ী চরিত্রের মধ্যে, পরিহার্য্য এবং অপরিহার্য্যের মধ্যে পার্থক্য অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছে তখনিমাত্র মানুষের পক্ষে বস্তুপুঞ্জের বৈচিত্র্য, বৈপরীত্য, অসঙ্গতির মধ্যে ঐক্য, সঙ্গতি এবং অনিবার্য বিধানকে আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। কাজেই বিধানের জ্ঞান লাভের পূর্বশর্ত হচ্ছে মানুষের বিশ্লিষ্ট চিন্তার ক্ষমতার বিকাশ, প্রকাশের অন্তরে সারকে অনুধাবন করার শক্তির স্ফূরণ। প্রাকৃতিক জগতের বিধানসমূহকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়: ১. বিশেষ বিধান অর্থাৎ বস্তুপুঞ্জের কোনো বিশেষ অবস্থার ব্যাখ্যাকারী বিধান। ২. সাধারণ বিধান: বস্তুপুঞ্জের ব্যাপকতর পরিধির ব্যাখ্যাকারী বিধান এবং ৩. বিশ্বজগতের সার্বিক বিধান।[২]

রাষ্ট্রীয় আইন

রাষ্ট্রের নিয়মনীতির অনুসরণকেও বিধান বা রাষ্ট্রীয় আইন (ইংরেজি: State Law) বলা হয়। একটি রাষ্ট্রের মানুষের সামাজিক আচার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাষ্ট্রের শাসকশক্তি বিভিন্ন নিয়ম নিষেধের প্রবর্তন করে। এরূপ নিয়ম নিষেধের অলঙ্ঘনীয়তার মূলে থাকে রাষ্ট্রশক্তির দন্ডদানের ক্ষমতা। এ কারণে কোনো রাষ্ট্রের দন্ডমুন্ডের যারা নিয়ামক তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা স্বার্থ-অস্বার্থের প্রতিফলন ঘটে রাষ্ট্রীয় বিধানে। রাষ্ট্রীয় বিধানকে আপাতদৃষ্টিতে নিরপেক্ষ বলে বোধ হয়। রাষ্ট্রীয় শক্তির মালিক শ্রেণী বিধানকে নিরপেক্ষ হিসাবে দেখাতে চায়। আসলে পরস্পরবিরোধী স্বার্থের দ্বন্দ্বে লিপ্ত কোনো শ্রেণী রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় বিধান নিরপেক্ষ হতে পারে না।

যে কোনো রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, আইনগত ও সাংস্কৃতিক বহিঃকাঠামোর নিয়ন্তা হচ্ছে তার অর্থনৈতিক অন্তঃকাঠামো। আবার অর্থনৈতিক কাঠামো নিয়ন্ত্রিত হয় সমাজের উৎপাদনের উপায় এবং উৎপাদনের সম্পর্ক দ্বারা। উৎপাদনের উপায় অর্থাৎ তার যন্ত্রপাতি, হাতিয়ার এবং উৎপাদনের সম্পর্ক অর্থাৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে শ্রমিক মালিক সম্পর্ক দ্বারা। একটি ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অর্থনীতিক বুনিয়াদের নিয়ন্ত্রক হচ্ছে উৎপাদনের যন্ত্র ও শ্রমিকের উপর মালিক শ্রেণী। যে অর্থনীতিতে শ্রমিক শ্রেণী য্ন্ত্র এবং শ্রম উভয়ের মলিক সেখানে শ্রমিক শ্রেণী তার অর্থনীতিক অন্তঃকাঠামো এবং রাষ্ট্রীয় বহিঃকাঠামোর নিয়ন্তা।[২]

তথ্যসূত্র:

১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ২৬-২৭।
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৬০-২৬১।

আরো পড়ুন:  গণতন্ত্র ও নীতিবিদ্যার পারস্পরিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে

Leave a Comment

error: Content is protected !!