চেতনা প্রবাহ বা চেতনার অন্তঃশীল প্রবাহ (ইংরেজি: stream of consciousness) হচ্ছে সাহিত্য সমালোচনায় একটি বর্ণনামূলক উপায় বা পদ্ধতি যা “বর্ণনাকারীর মনের মধ্যে যে বহুবিধ চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতিগুলি চলতে থাকে তা চিত্রিত করবার” চেষ্টা করে।
১৮৫৫ সালে দ্য সেনসেস অ্যান্ড দ্য ইন্টেলেক্ট-এর প্রথম সংস্করণে সংবেদনগুলির সম্মতি বিভিন্ন ইন্দ্রিয়কে যুক্ত করবার সক্ষমতা ব্যাখ্যা করতে আলেকজান্ডার বাইন এই শব্দটি তৈরি করেছিলেন। তবে এটির উৎসের জন্য সাধারণত উইলিয়াম জেমসকে কৃতিত্ব দেয়া যিনি ১৮৯০ সালে এটি তাঁর মনোবিজ্ঞানের নীতিমালায় ব্যবহার করেছিলেন একটি জাগ্রতমনের নিরবচ্ছিন্ন ভাবনা প্রবাহ এবং সচেতনতাকে বোঝাতে। ১৯১৮ সালে ডরোথি রিচার্ডসনের (১৮৭৩-১৯৫৭) উপন্যাসগুলি নিয়ে আলোচনার সময় উপন্যাসিক মে সিনক্লেয়ার (১৮৬৩-১৯৪৬) চেতনার প্রবাহ শব্দটি প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন। পয়েন্টেড রুফস (১৯১৫), রিচার্ডসনের পিলগ্রিমেজ শীর্ষক ১৩টি আধা-আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের সিরিজের প্রথম কাজ হচ্ছে ইংরেজীতে প্রকাশিত প্রথম চেতনা-প্রবাহ উপন্যাস। যা হোক, ১৯৩৪ সালে, রিচার্ডসন মন্তব্য করেছিলেন যে “প্রুস্ত, জেমস জয়েস, ভার্জিনিয়া উলফ এবং ডরোথি রিচার্ডসন … সবাই যুগপৎভাবে, যদিও খুব আলাদাভাবে “নতুন পদ্ধতি”টি ব্যবহার করছিলেন”। যা হোক, অতীতের অনেক পূর্বসূরীরা এবং এখনও সমকালীন অনেক লেখকরা এই কৌশলটি ব্যবহার করেন।
আধুনিক কালে কথাটি গল্প-উপন্যাসে ব্যবহৃত একটি বর্ণনা পদ্ধতি বা ন্যারেটিভ টেকনিককে বোঝায়। চেতনাপ্রবাহ রীতি আধুনিক কথাসাহিত্যের একটি অভিনব আঙ্গিক। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে Edouard Dujardin নামক একজন গৌণ ফরাসী লেখকের রচিত Les Lauriers Sont coupe’s উপন্যাসে কেন্দ্রিয় চরিত্রের চেতনায় যত দৃশ্য ও ঘটনাবলীর অভিঘাত ফেলে তার সবকিছুকে বিশ্বস্তভাবে ধরবার প্রয়াসে—এই রীতির স্থুল ব্যবহার করেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই আঙ্গিক যথার্থভাবে বিকশিত হয়। লেখক চেতনা প্রবাহ রীতির মাধ্যমে চরিত্রের চেতন ও অর্ধচেতন মনে যেসব স্পষ্ট এবং অস্পষ্ট ভাবনা, অনুভূতি, স্মৃতি ও নানা আপাত বিচ্ছিন্ন অনুষঙ্গ ভেসে ওঠে তার সবকিছু তুলে ধরার চেষ্টা করেন। এখানে ঘটনা ও কালের বাস্তব ধারাবাহিকতা ও পারম্পর্য রক্ষিত হয় না। যৌক্তিকতা কিংবা অযৌক্তিকতার বিষয়টি এখানে গুরুত্ব পায় না। মানব চেতনায় অন্তঃশীল প্রবাহে ঠিক যেমনটি ধরা পড়ে তেমটিই প্রতিফলিত হয় চেতনা প্রবাহ রীতির গল্প বা উপন্যাসের বর্ণনারীতিতে।[২]
জর্জ মেরেডিথ এবং হেনরি জেমসের মতো ঔপন্যাসিকদের রচনায় সুদীর্ঘ মনোবিশ্লেষণাত্মক অনুচ্ছেদ বর্ণনায় চেতনা প্রবাহ রীতির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। জেমস জয়েস ‘ইউলিসিস’ (১৯২২) উপন্যাসে স্ট্রীম অব কনশাসনেস-এর একাধিক টেকনিক নিপুনভাবে প্রয়োগ করেন। এই উপন্যাসের ‘লেস্ট্রিগনিয়ান’ এপিসোড থেকে চেতনা প্রবাহ রীতির বর্ণনা কৌশলের একটু উদ্ধৃতি দেয়া হলো: ডাবলিনের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে লিওপোল্ড ব্লুমের চোখে এবং মনের পর্দায় যা ভেসে ওঠে তার ছবি এখানে জেমস জয়েস উপস্থাপন করেছেন চেতনার অন্ত শীল প্রবাহের আঙ্গিকে:
Pineapple rock, lemon platt, butter scoteh. A sugarsticky girl shoveling scoopfuls of creams for a christian brother. Some school tract. Bad for their tummies. Lozenge and comfit manufacturer to His Majesty the king. God. Save. Our Sitting of his throne, sucking red jujubes white.
ভার্জিনিয়া উলফ তাঁর ‘মিসেস ড্যালওয়ে’ (১৯২৫) এবং ‘টু দি লাইট হাউস’ উপন্যাসে এই আঙ্গিকের ব্যাপক ব্যবহার করেছেন। এছাড়া এই আঙ্গিকের অসামান্য প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় উইলিয়াম ফকনারের বিখ্যাত উপন্যাস ‘দি সাউন্ড এ্যান্ড দি ফিউরী’তে (১৯২৯)।
তথ্যসূত্র
১. J. A. Cuddon, A Dictionary of Literary Terms. (Harmondsworth, Penguin Books,1984), pp. 660–1).
২. কবীর চৌধুরী, সাহিত্যকোষ, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, অষ্টম মুদ্রণ ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা ১২১।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।