আনুগত্য (ইংরেজি: Loyalty) শব্দটির মমার্থ হলো এমন এক মানসিকতা যার মধ্য দিয়ে কারও কোনও কিছুর প্রতি বিশ্বস্ততা, অনুরাগ ও সমর্থন ফুটে ওঠে; সেটা পরিবার, চাকুরির ক্ষেত্রে নিয়ােগকর্তা, ধর্মীয় অথবা বহুত্ববাদী সমাজে যে-কোনও প্রতিষ্ঠানের প্রতি প্রদর্শিত হয়। আনুগত্য স্বভাবতই আত্মস্বার্থ বহির্ভুত একটি আসক্তি।
রাজনীতিতে আনুগত্য হলো দেশভক্তি ও রাষ্ট্রিক বাধ্যতার অন্তর্গত। নিজ দল বা গােষ্ঠীর অন্ধ প্রশংসা এবং অন্যদের সমালােচনা আনুগত্যের অঙ্গ। আনুগত্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো দেশ, দল বা গােষ্ঠীর সঙ্গে একাত্মতা।
প্রাচীন গ্রিক ও রােমান তাত্ত্বিকেরা আনুগত্যকে রাজনীতির সর্বোচ্চ পুণ্য হিসেবে দেখতেন; এবং সেখানে সীমিত সংখ্যক যাঁরা নাগরিকত্বের অধিকারী হতেন, তাঁদের প্রথমে আনুগত্যের পাঠ নিতে হতো। রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্যপালন ছিল শ্রেষ্ঠ পুণ্যকর্ম এবং আনুগত্যের উপর সর্বাধিক মূল্যবত্তা নির্দেশিত হয়। প্লাতাে, আরিস্তোতল প্লুটার্ক, থুকিডাইডিস আনুগত্যের উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেন।
মধ্যযুগের ইউরােপে জাতিরাষ্ট্র গড়ে ওঠার সময়ে একমাত্র সামন্ত প্রভুদের কাছেই সাধারণ লােকের আনুগত্যের প্রশ্ন দেখা দিত। মাকিয়াভেলি রাজনৈতিক আনুগত্যকে প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে দেখেন; সমসাময়িক যুগে আনুগত্যের মনােভাব হয়ে পড়েছিল স্তিমিত। ফরাসি বিপ্লবের সময়ে আনুগত্যের বিষয়টি বড় আকারে দেখা দেয়। জা জ্যাক রুশো আনুগত্যকে আবেগমণ্ডিত করে তােলেন।
উনিশ শতকের গােড়া থেকে আনুগত্যের বিষয়টি জটিল ও স্ববিরােধী হয়ে পড়ে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিকতার আদর্শ প্রসারিত হবার ফলে বিশ শতকে সর্বনিয়ন্ত্রণবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভবের সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক দল, নেতা ও আদর্শের প্রতি লােকের অবিচল আনুগত্য দাবি করা হয়। আন্তজাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে সােভিয়েত দেশ কিংবা চীনের প্রতি আনুগত্য ছিল স্বাভাবিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথমাবধি আনুগত্যের প্রশ্নটি গুরুত্ব পায়। আদিপর্বে সেখানকার অধিবাসীদের ছিল ইংরেজ রাজশক্তির প্রতি আনুগত্য। দ্বিতীয় বিশ্ব-মহাযুদ্ধের পর সাম্যবাদী মতাদর্শের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে নিজেদের অন্তর্ঘাতের আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার দেশের জনগণকে আনুগত্যের নিদর্শন স্বরূপ জনগণের উপর নানা বিধিনিষেধ আরােপ করে।
তথ্যসূত্র:
১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৩৩-৩৪।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।