নৈরাজ্যবাদ রাষ্ট্রহীন সমাজব্যবস্থার প্রচারক মতবাদ

নৈরাজ্যবাদ (ইংরেজি: Anarchism) বা নৈরাষ্ট্রবাদ হচ্ছে রাষ্ট্রহীন সমাজ-ব্যবস্থার প্রচারক একটি সমাজ দর্শন। ইংরেজি এ্যানার্কিজম শব্দের মূল হচ্ছে গ্রিক ‘এ্যানার্কস’ শব্দ।[১] নৈরাজ্যবাদ সমাজের যাবতীয় কেন্দ্রিভূত ক্ষমতা, কর্তৃত্বআধিপত্যের বিরুদ্ধে সর্বোপরি রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তার স্বাধীন, মুক্তশ্রমের মালিকানাহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজের বাসনা নিয়ে।[২] আরো পড়ুন

সপ্তদশ শতকের গৃহযুদ্ধের সময়ে ইংল্যাণ্ডে শব্দটির ব্যবহার দেখা যায়। ‘লেভেলারপন্থীদের’ তখন নৈরাজ্যবাদী বলে আখ্যায়িত করা হতো। ফরাসি বিপ্লবে শব্দটিকে বিভিন্ন দলের মধ্যে পারস্পরিক আক্রমণের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা হয়। যে-কোনো দল তাদের চাইতে বিপ্লবাত্মক মতাদর্শের লোক এবং দলকেই নৈরাজ্যবাদী বলে অভিহিত করত। ফরাসি দার্শনিক প্রুঁধোর রচনার মধ্যেই নৈরাজ্যবাদী মতের সম্যক বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি ১৮৪০ সালে প্রকাশিত তার ‘সম্পত্তি কি’ গ্রন্থে নৈরাজ্যবাদ ব্যাখ্যা করেন। তাঁর মতে নৈরাজ্যবাদ যে-কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরোধী। রাষ্ট্র-ব্যবস্থা হচ্ছে ব্যক্তির বিকাশের প্রতিবন্ধক। মানুষের জীবনে শৃঙ্খল বিশেষ। অত্যাচারের যন্ত্র। মানুষের সমাজে রাষ্ট্র নিষ্প্রয়োজন। পারস্পরিক ইচ্ছা এবং চুক্তির মাধ্যমে গঠিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্থা মানুষের জীবনকে পরিচালিত করবে; আইন, অস্ত্রপ্রয়োগকারী বাহিনী, শাসন, সংগঠন ইত্যাদি দ্বারা গঠিত রাষ্ট্র নয়।[৩]

এই তত্ত্বের পরিপূরক সিদ্ধান্ত হচ্ছে, সমস্ত রাষ্ট্রকাঠামোকে ধ্বংস করে রাষ্ট্রহীন সমাজব্যবস্থা প্রবর্তন করা। এজন্য নৈরাজ্যবাদের সমর্থক কেউ কেউ বিপ্লবের কথা বলেছেন। কেউ বলেছেন বিপ্লব নয়, মানুষের সততার স্বাভাবিক বিজয়ের দ্বারা একদিন নৈরাষ্ট্রবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে। মার্কসবাদীরা যেখানে রাষ্ট্র শুকিয়ে মরার তত্ত্ব হাজির করেন, নৈরাজ্যবাদীরা সেখানে রাষ্ট্র বিলোপের সংগ্রামকেই সমাজতন্ত্রের সংগ্রামে প্রাথমিক গুরুত্ব দিতে চান।

রাষ্ট্রহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য আবার কেউ কেউ গুপ্তহত্যার মারফত ক্ষমতাসীনদের উচ্ছেদ করে উক্ত সমাজ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিমত পোষণ করেছেন। সাধারণত নৈরাজ্যবাদ বলতে অরাজকতা বুঝায়। ব্যক্তিগত সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপও নৈরাজ্যবাদের সঙ্গে সংযুক্ত বলে মনে করা হয়। কিন্তু তত্ত্বগতভাবে নৈরাজ্যবাদের তথা নৈরাষ্ট্রবাদের সঙ্গে অরাজকতা বা সন্ত্রাসবাদের সম্পর্ক দেখা যায় না। নৈরাজ্যবাদ তত্ত্বের ইতিহাসে উক্ত মতের প্রখ্যাত ব্যাখ্যাতা এবং প্রবক্তা হিসাবে ইংল্যাণ্ডের উইলিয়াম গডুইন (১৭৫৬-১৮৩৬ খ্রি.) ফ্রান্সের পিয়েরে যোশেফ প্রুঁধো (১৮০৯-১৮৬৫ খ্রি.), রাশিয়ার মাইকেল বাকুনিন (১৮১৪-১৮৭৬ খ্রি.), প্রিন্স পিটার ক্রোপোটকিন (১৮৪২-১৯২১ খ্রি.) এবং রুশ লেখক কাউন্ট লিও তলস্তয় (১৮২৮-১৯১০ খ্রি.) – এঁদের নাম পাওয়া যায়।

আরো পড়ুন:  নৈরাজ্যবাদ অথবা সমাজতন্ত্র

মার্কসবাদও পরিণামে রাষ্ট্রহীন সমাজব্যবস্থার আদর্শ পোষণ করে। কিন্তু নৈরাজ্যবাদের ব্যাখ্যার সঙ্গে মার্কসবাদ একমত নয়। মার্কসবাদ নৈরাজ্যবাদকে পাতিবুর্জোয়া অবাস্তব দর্শন বলে অভিহিত করে। মার্কসবাদের মতে নৈরাজ্যবাদ শোষণহীন সমাজের কথা বললেও সমাজের শোষণের উদ্ভব এবং শোষণের চরিত্র সম্পর্কে নৈরাজ্যবাদের কোনো বাস্তব এবং যথার্থ বিশ্লেষণ নাই। নৈরাজ্যবাদের অন্যতম সমর্থক মাইকেল বাকুনিন তার মত প্রচারের জন্য সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের আন্তর্জাতিক মৈত্রী নামক একটি সংঘের প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংঘ ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম আন্তর্জাতিকে যোগদান করে। কিন্তু সমাজের ব্যাখ্যা এবং সমাজ পরিবর্তনের পদ্ধতি নিয়ে মার্কসবাদীদের সঙ্গে বাকুনিনপন্থীদের বিরোধ দেখা দেয়। ফলে ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম আন্তর্জাতিক ভেঙে যায়।

শ্রমিক আন্দোলনে সুবিধাবাদ জেঁকে বসলে এই সুবিধবাদের বিপরীতে অতি দ্রুত ফলাফল ও মনোযোগ লাভের জন্য ক্ষুদে বুর্জোয়ারা নৈরাজ্যবাদী কার্যকলাপে জড়িয়ে যায়। সুবিধাবাদের সাথে নৈরাজ্যবাদের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে লেনিন সিদ্ধান্ত টেনেছিলেন যে, “নৈরাজ্যবাদ হলো প্রায়শই শ্রমিক আন্দোলনের সুবিধবাদি পাপের এক ধরনের দণ্ড”[৪]।  অন্যদিকে স্তালিন উল্লেখ করেছেন যে

নৈরাজ্যবাদী মশাইরা আর একটি অভিযোগ উত্থাপন করেন: ‘বিষয়বস্তু ছাড়া রূপ অকল্পনীয়…’, সুতরাং বলা যায় না যে, রূপ বিষয়বস্তুর পেছনে পড়ে থাকে… তারা সহঅবস্থান করে, তা না হলে অদ্বৈতবাদ হয়ে পড়ত একটি অসম্ভব ব্যাপার’ (১নং নোভাতি দেখুন, এস-এইস জি.)। নৈরাজ্যবাদী মশাইরা কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। রূপ ছাড়া বিষয়বস্তু অকল্পনীয় সত্য, কিন্তু বিদ্যমান রূপ বিদ্যমান বিষয়বস্তুর সঙ্গে কখনও হুবহু একরূপ হয় না। নতুন বিষয়বস্তু কিছুদূর পর্যন্ত সব সময়ে পুরানো রূপে আবৃত থাকে। এর ফলে সব সময়ে পুরাতন রূপ এবং নতুন বিষয়বস্তুর মধ্যে একটা সংঘর্ষ বাধে। ঠিক এই কারণেই বিপ্লব সংঘটিত হয়, এবং অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে এটাও একটি যা মার্কসের বস্তুবাদের মূলনীতিকে প্রকাশ করে।[৫]

তথ্যসূত্র:

১. সরদার ফজলুল করিম, ; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ৫৪।

২. অধিকারী, বাধন, “নৈরাজ্যের পয়লা মে” ১ মে ২০১২, মঙ্গলধ্বনি, ইউআরএল: https://mongoldhoni.wordpress.com/2012/05/01/first-may-of-anarchists/

আরো পড়ুন:  প্রুধোঁ প্রসঙ্গে

৩. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ৫৪।

৪. ভি. আই. লেনিন; কমিউনিজমে বামপন্থার শিশুরোগ; এপ্রিল , ১৯২০, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭৪, রচনা সংকলন, চার ভাগে সম্পূর্ণ, চতুর্থ ভাগ, পৃষ্ঠা

৫. জোসেফ স্তালিন, নৈরাজ্যবাদ অথবা সমাজতন্ত্র, ডিসেম্বর ১৯০৬ – জানুয়ারি ১৯০৭।

রচনাকাল: ৫ জুন ২০১৮

1 thought on “নৈরাজ্যবাদ রাষ্ট্রহীন সমাজব্যবস্থার প্রচারক মতবাদ”

Leave a Comment

error: Content is protected !!