আপোষহীন ও আপোষমূলক বিরোধ সমাজের ক্রমবিকাশের ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত শব্দ

আপোষহীন এবং আপোষমূলক বিরোধ (ইংরেজি: Antagonistic and Non-Antagonistic Contradiction) হচ্ছে সমাজের ক্রমবিকাশের ব্যাখ্যায় মাকর্সবাদীগণ  কর্তৃক ব্যবহৃত দুটি শব্দ বা কথা। মাকর্সবাদ তথা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মতে বিরোধী শক্তির সংঘাতের মাধ্যমেই সমাজ বিকাশ লাভ করে, সমাজের এক স্তরের স্থানে নতুন স্তর প্রতিষ্ঠালাভ করে। বিরোধ হচ্ছে সমাজ বিকাশের প্রাণশক্তি। একেবারে বিরোধশূন্য কোনো জীবন বা সমাজের কল্পনা মার্কসবাদের মতে অবাস্তব কল্পনা।

মাকর্সবাদীগণ বিরোধকে প্রধানত দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করেন। এক শ্রেণির বিরোধকে তাঁরা বলেন, আপোষহীন বিরোধ। অপর শ্রেণিকে তাঁরা আপোষমূলক বিরোধ বলে আখ্যায়িত করেন। উৎপাদনের মারফতই মানুষ জীবন ধারণ করে। উৎপাদনের হাতিয়ার বা উপায়ের মালিকানার তারতম্যের ভিত্তিতে কোনো বিশেষ সমাজের অধিবাসীগণ বিভিন্ন আর্থিক শ্রেণিতে বিভক্ত হয়। কোনো বিশেষ যুগের উৎপাদনের হতিয়ার যাদের একচ্ছত্র মালিকানায় কবলিত হয়, তারা শোষক এবং শাসকে পরিণত হয় এবং সে যুগে যাদের হাতে উৎপাদনের উপায়গুলি থাকে না তারা শোষিত এবং নির্যাতিত শ্রেণিতে পরিণত হয়।

ইতিহাসের প্রাথমিক যুগের পরে উৎপাদনের হাতিয়ারের মালিকানার তারতম্যের ভিত্তিতে সমাজে কোনো যুগে মানুষ প্রভু এবং দাসে বিভক্ত হয়েছে; কোনো যুগে ভূস্বামী এবং ভূমিদাসে এবং আর এক যুগে পুঁজিপতি এবং শ্রমিকে বিভক্ত হয়েছে। শ্রেণিতে শ্রেণিতে এরূপ বিরোধকে মাকর্সবাদীগণ আপোষহীন বিরোধ বলে বিবেচনা করেন। এরূপ বিরোধ আপোষহীন এই কারণে যে, এদের উভয়ের স্বার্থ এরূপ পরস্পর-বিরোধী যে, এর কোনো শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব নয়। বিরোধের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে চরম অবস্থায় তীব্রতম সংঘর্ষে বা বিপ্লবের মাধ্যমে এর সমাধান ঘটে।

অর্থ্যাৎ উৎপাদনের হাতিয়ারে নতুন মালিকানার প্রতিষ্ঠা ঘটে, পূর্বতন মালিক শ্রেণি ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং ক্রমান্বয়ে সমাজের আর্থিক কাঠামো থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই নিয়মে বিপ্লবের মাধ্যমে দাস সমাজ সামন্ততান্ত্রিক সমাজে এবং সামন্ততান্ত্রিক সমাজ পুঁজিবাদী সমাজে রুপান্তরিত হয়েছে। আধুনিককালে পুঁজিবাদী সমাজ সমাজতান্ত্রিক সমাজ পুঁজিবাদী সমাজে রূপান্তরিত হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজেও উৎপাদনের হাতিয়ারের উপর মালিকানা নিয়ে শ্রেণি-বিভাগের সৃষ্টি হবে এবং আপোষহীন বিরোধের অবকাশ থাকবে, মার্কসবাদীগণ এরূপ অভিমত পোষন করেন না।

আরো পড়ুন:  আমাদের বিপ্লবের কথা

সমাজতন্ত্রে উৎপাদনের হাতিয়ার নিয়ে অর্থ্যাৎ উৎপাদনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আপোষহীন বিরোধের অবকাশ থাকে না। কিন্তু আপোষমূলক বিরোধের অবকাশ সমাজতান্ত্রিক সমাজেও থাকবে। আপসমূলক বিরোধ বলতে তাঁরা পুরাতন ভাবধারার সাথে নতুন ভাবধারার বিরোধ, এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সত্ত্বেও আঞ্চলিক অসাম্যের বিরোধ, কায়িক এবং মানসিক শ্রমের মূল্য নির্ণয়ের বিরোধ, গ্রাম ও শহরের আপেক্ষিক বিরোধ-ইত্যাদির কথা বুঝান। এ সমস্ত বিরোধ সমাধানের জন্য চরম সংঘর্ষ কিংবা বিপ্লবের আবশ্যক হবে না।

শ্রেণিগত আর্থিক শোষণের বিলোপের পরে প্রাকৃতিক শক্তিকে মানুষ যত অধিক পরিমাণে জয় করে মানুষের সার্বিক কল্যাণে নিয়োজিত করতে থাকবে, তত অধিক পরিমাণে আপসমূলক বিরোধগুলিরও সমাধান ঘটতে থাকবে। সমাজের অগ্রগতির সঙ্গে নতুনতর বিরোধের উদ্ভব ঘটবে কিন্তু সে বিরোধ আপোষহীন নয়; সে বিরোধ আপোষমূলক।

তথ্যসূত্র:

১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ৫৯।

Leave a Comment

error: Content is protected !!