শ্রমের বিভাগ কথাটি আজ অত্যান্ত সুপরিচিত। শ্রমের ক্ষেত্রে মানসিক ও দৈহিক শ্রমের বিভাগটিও পরিচিত। মানসিক ও দৈহিক শ্রমের মধ্যেকার বিরোধ হচ্ছে শ্রেণিবিভক্ত সমাজের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সভ্যতার আদিতে শ্রমের কোনোরূপ বিভাগই ছিল না। অনুন্নত অবস্থায় জীবন রক্ষার্থে প্রত্যেক ব্যক্তিকে প্রয়োজনীয় সমস্ত শ্রমই করতে হতো। কিন্তু প্রকৃতিকে অধিকতর পরিমাণে বশ করার প্রয়োজনে মানুষ একদিন শ্রম বিভাগের আবশ্যকতা বোধ করল।
দৈহিক শ্রমের ক্ষেত্রে অল্প শ্রম এবং অধিক শ্রমের কাজের পার্থক্য প্রথমে শুরু হয়। এই শ্রম বিভাগের উদ্ভব ঘটে দাস সমাজে। অর্থ্যাৎ এক মানুষ অপর মানুষকে শক্তির জোরে অধীনস্থ করে নিজের স্বার্থে খাটাবার কৌশল যেদিন আবিষ্কার করেছে, সেদিন থেকে প্রভু এবং দাসের শ্রমে পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। প্রভু-শ্রেণীর শ্রম তখন থেকে দৈহিক থেকে মস্তিষ্কের ব্যবহারজনিত শ্রমে রুপান্তরিত হতে থাকে।
প্রয়োজনের তাগিদে যেমন এই শ্রমবিভাগের উৎপত্তি তেমনি সমাজের অর্থনৈতিক বিকাশ এবং প্রকৃতিকে জয় করার সংগ্রামে আদিতে এ বিভাগ প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে শ্রমবিভাগ, বিশেষ করে মানসিক ও দৈহিক শ্রমের বিভাগ শ্রেণীগত এবং বংশগতভাবে অপরিবর্তনীয় হতে শুরু করায় শ্রমের বিভাগ মানুষের সামগ্রিক শক্তির বিকাশের সহায়ক না হয়ে তার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে শুরু করে। একদিকে শ্রমবিভাগের আবশ্যকতা, অপরদিকে শ্রমবিভাগের অপরিবর্তনীয়তা সমাজের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি করেছে। এই বিরোধ শ্রেণীবিরোধে রূপান্তরিত হয়ে সামাজিক বিপ্লবের উৎস হিসাবে কাজ করেছে।
দ্বান্দ্বিক বস্তবাদী দর্শন এরূপ অভিমত পোষণ করে যে, অর্থনৈতিকভাবে শ্রেণীহীন সমাজেই কেবল শ্রমবিভাগের অবাঞ্ছিত বিরোধাত্মক বৈশিষ্ট্য বিলুপ্ত হতে পারে। এরূপ সমাজে শ্রমবিভাগের দৈহিক ও মানসিক শ্রমের কোনো অপরিবর্তনীয় বিভাগ থাকবে না। এরূপ বিভাগ বংশগতও হবে না। সমাজের ব্যক্তিমাত্রই জ্ঞান-বিজ্ঞানের কলাকৌশলের এরূপ অধিকারী হবে না, কোনো শ্রেণী শুধুমাত্র দৈহিক শ্রমে এবং অপর কোনো শ্রেণী শুধুমাত্র মানসিক অর্থ্যাৎ মস্তিষ্কের শ্রমে নিয়োজিত থাকবে না। ফলে মানসিক শ্রম এবং তার পরিফল কোনো বিশেষ শ্রেণীরই করায়ত্ত থাকবে না।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ৬২।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।