মার্কসের প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্র এবং বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তি প্রসঙ্গে

সরকারের একচ্ছত্র শাসন, যথেচ্ছাচারী ক্ষমতা; বিশেষ করে যে সরকার কার্যত কোনো আইন, বিরোধী-পক্ষ অথবা প্রথা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না; এবং ক্ষমতাসীনেরা যখন ও যেখানে ইচ্ছা অপরের অধিকার খর্ব করতে পারে এমন শাসনকে যদি স্বৈরতন্ত্র বলি[১] তবে ভারতীয়, অটোমান এবং চীনা সাম্রাজ্যে প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্রের গণবিরোধী ভূমিকা বিশাল। স্বৈরতন্ত্র বঙ্গে বা ভারতে এক অনিবার্য নিয়তি। প্রাচ্যের কৃষিজীবীরা যেই স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তি ছিলো এবং যে স্বৈরতন্ত্র তৈরি করেছিলো, সেই স্বৈরতন্ত্রের ধারাবাহিকতা এখনো চলছে।

ব্রিটিশ উপনিবেশ বাঙলায় যে নতুন জমিদারী ব্যবস্থা তৈরি করে তা মূলত এখানকার কৃষিকে ব্রিটেনের কারখানার কাঁচামাল যোগানোর উপায়ে পরিণত করে। বঙ্গের জমিদাররা কৃষিতে পুঁজিবাদ আনেনি, কারণ এখানে কৃষিনির্ভর শিল্প গড়ে উঠেনি। ফলে বঙ্গের জমিদাররা ব্রিটিশ উপনিবেশের দালাল হয়েছে এবং কৃষকের উপর স্বৈরশাসন কায়েম করেছে। কলকাতায় উনিশ শতকের যে বাবু কালচার তা মূলত পরজীবী ফড়িয়া আর শিক্ষিত চাকুরি করা মেরুদণ্ডহীন উপনিবেশের ঘানি টানা কিন্তু কৃষকের ঘাড়ে চেপে বসা জগদ্দল পাথর অন্য ভাষায় যারা পরজীবী ও মুৎসুদ্দি।  যদিও উঠতি এই শিক্ষিতদের একটা অংশ জাতীয়তাবাদী ও বিপ্লবী নৈরাজ্যবাদী আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। 

প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্র এখনো টিকে আছে, কারণ এখনো এই কৃষকরা মুক্ত হতে পারেনি। গত দুই হাজার বা তারও অধিককাল ধরে স্বৈরতন্ত্র এখানে উর্বর ভূমি পেয়েছে যে ভূমিকে মার্কস বলেছেন ‘এশীয় উৎপাদন-পদ্ধতি’ (ইংরেজি: Asiatic mode of production)। ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়েরের লেখা, মন্টেস্কু এবং হেগেলের যুক্তি, এবং এঙ্গেলসের বিশ্লেষণসমূহ মার্কস খেয়াল করে এই ‘এশীয় উৎপাদন-পদ্ধতি’র সিদ্ধান্ত টেনেছিলেন। প্রাচ্যের বিশেষ ধরনের অর্থনৈতিক প্রকৃতি, বিশেষভাবে সম্পত্তির মালিকানা সংক্রান্ত স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের দৃষ্টিকে মার্কস তুলে ধরেন। মার্কসের মতে, সমগ্র এশিয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি হচ্ছে ব্যক্তি মালিকানার অধিকারের অনুপস্থিতি, যেহেতু এখানে গ্রামীণ কৌম গোষ্ঠীগুলি ছিল স্বায়ত্তশাসিত, ফলে আঞ্চলিক থেকে সাম্রাজ্যিক সমস্ত রাজাই ছিলো একচ্ছত্র মালিক। মার্কস দেখিয়েছেন যে এশিয়ার দেশগুলোর ভৌগলিক অবস্থার ফলে এই রাজনৈতিক ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হয়েছে, এবং উদাহরণ হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই এসেছে শুধুমাত্র একটি শক্তিশালী এবং কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পরিচালিত কৃষিতে প্রয়োজনীয় কৃষি পানিসেচ ব্যবস্থা।[২] কার্ল মার্কস গ্রামের কাঠামোর বিস্তারিত বিবরণ ও ব্যাখা দেবার পর লিখেছেন

“শ্রমপরায়ণ পিতৃতান্ত্রিক ও নিরীহ সামাজিক সংগঠনগুলি … … শান্ত-সরল গ্রাম-গোষ্ঠীগুলি যতই নিরীহ মনে হোক, প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্রের তারাই ভিত্তি হয়ে এসেছে চিরকাল, মনুষ্য-মানসকে তারাই যথাসম্ভব ক্ষুদ্রতম পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে, তাকে বানিয়েছে কুসংস্কারের অবাধ ক্রীড়নক, তাকে করেছে চিরাচরিত নিয়মের ক্রীতদাস, হরণ করেছে তার সমস্ত কিছু মহিমা ও ঐতিহাসিক কর্মদ্যোতনা।” … … এই হীন, অনড় ও উদ্ভিদ-সুলভ জীবন, এই নিস্ক্রিয় ধরনের অস্তিত্ব থেকে অন্যদিকে, তার পাল্টা হিসাবে সৃষ্টি হয়েছে বন্য লক্ষ্যহীন এক অপরিসীম ধ্বংসশক্তি এবং হত্যা ব্যাপারটিকেই হিন্দুস্তানে পরিণত করেছে এক ধর্মীয় প্রথায়। যেন না ভুলি যে ছোটো ছোটো এই সব গোষ্ঠী ছিল জাতিভেদপ্রথা ও ক্রীতদাসত্ব দ্বারা কলুষিত, অবস্থার প্রভুরূপে মানুষকে উন্নত না করে তাকে করেছে বাহিরের অবস্থার অধীন, স্বয়ং-বিকশিত একটি সমাজব্যবস্থাকে তারা পরিণত করেছে অপরিবর্তমান প্রাকৃতিক নিয়তিরূপে এবং এই ভাবে আমদানি করেছে প্রকৃতির পুশবৎ পূজা, প্রকৃতির প্রভু যে মানুষ তাকে হনুমানদেব রূপী বানর এবং শবলদেবী রূপী গরুর অর্চনায় ভুলুষ্ঠিত করে অধঃপতনের প্রমাণ দিয়েছে।”[৩]

নয়া উপনিবেশবাদী সময়ে তারই ধারাবাহিকতা। গত দুশো বছর পুঁজিবাদ উপনিবেশবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদ সেই প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্রকে বঙ্গ অঞ্চলে শক্তিশালী করেছে। গত চল্লিশ বছরে কৃষিতে যে অগ্রগতি তাও শ্যালো মেশিনের মাধ্যমে যা সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর। অধিক ফলনশীল সাম্রাজ্যবাদের সরবরাহ করা বীজগুলো স্থানীয় বীজ ধ্বংস করেছে। ফলে কৃষি এখন সাম্রাজ্যবাদের পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণে। যেহেতু উৎপাদন বৃদ্ধি হয়েছে, ফলে অর্থনীতি শক্তিশালী হয়েছে, কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে নদীগুলোকে শাসন ও খনন প্রাচীন এককেন্দ্রিক শাসনটাকেই ফিরিয়ে এনেছে এবং শক্তিশালী করেছে। এই কৃষককে শোষণ করার জন্য ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি, এবং এবং নির্যাতনের জন্য দৈনিক ২০টি খুন, ফিরে এসেছে সেই ভয়ংকর স্বৈরতন্ত্র।  এই যে নিজের টাকায় পদ্মা সেতুর উদাহরণ, দোতলা সড়ক জাইকা, এডিবি আর বিশ্বব্যাংকের টাকায় অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদের সাথে স্বৈরতন্ত্রের ঐক্যও স্বৈরতন্ত্রকেই শক্তিশালী করেছে। সাথে গত দশ বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার অস্ত্র আমদানির কথা খেয়াল করলেই এই স্বৈরতন্ত্রের শক্তি কোথায় তা খুব সহজেই বোঝা যাবে।

আরো পড়ুন:  একনায়কত্ব কাকে বলে

বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের একটি শক্তিশালী খুঁটি ছিলো হোমো এরশাদ। বর্বর এবং নরপিশাচ বলতে যা বোঝায় তা এরশাদের মাঝে দেখা যায়। মিছিলে ট্রাক তুলে দেয়া, খুন, রক্তলোলুপতা, দুর্নীতি থেকে হেন কোনো অপরাধ নাই, যা এই ইতরটা করেনি। বাংলার বুকে কবিতা, যৌনতা থেকে ধর্মের দূষণে সে ছিলো এক মহা ধড়িবাজ। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করায় সে সাংবাদিক লেখক বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন হারিয়ে ফেলে। আহমদ শরীফ, হুমায়ূন আজাদ, আনিসুজ্জামান, আহমদ ছফা, আবদুল গাফফার চৌধুরীরা তার বিপক্ষে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন। সে রাষ্ট্রধর্ম না করলে আরো ৫-৭ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারত বলে মনে করি। বদমায়েশি, মোনাফেকি আর মিথ্যাচারের সমন্বয় হচ্ছে এরশাদ। এই নর্দমার কীটের মৃত্যু হতে পারে কেবল বাংলার বুকে চেপে বসা স্বৈরতন্ত্রের পাথরটিকে উৎখাতের মাধ্যমে।

বাংলাদেশে অধিকাংশ বামপন্থি দলগুলো আমলাতান্ত্রিক সামরিক শাসনবিরোধি আন্দোলনে বুর্জোয়া জাতিয়তাবাদীদের সাথে যুগপৎ আন্দোলন করায় এবং ১৯৯০ সালের পরে সংসদীয় রাজনীতির বিকাশে নির্বাচনমুখি প্রবণতা অনুসরণ করায় জনগণের মূল সমস্যাগুলোকে জনগণের সামনে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালি শ্রমিক আন্দোলন করতে এবং শ্রেণিসংগ্রামকে আঁকড়ে ধরে ইস্যুভিত্তিক সাময়িক আন্দোলনের বিপরীতে দীর্ঘস্থায়ি রাজনৈতিক শ্রেণিসংগ্রাম চালাতে পারেনি। আর এই আত্মগত ও নৈর্বক্তিক কারণগুলিই বাংলাদেশে গত চার দশকে স্বৈরতন্ত্রের জমিকে পুষ্টি দিয়েছে।

স্বৈরতন্ত্র টিকে থাকে বিশাল পরজীবী বাহিনীর উপরে ভিত্তি করে, আর এই স্বৈরতন্ত্রী কাঠামোর সবার উপরে থাকে সেই স্বৈরতন্ত্রীর অবস্থান। কেন্দ্রীভূত কর্তৃত্ববাদী সেই স্বৈরতন্ত্রীরা সামান্য খুদ-কুড়ার বিনিময়ে একটি বিশাল বাহিনী পুষতে পারে। সেই বাহিনীর এক প্রান্তে প্রান্তিকরূপে নির্যাতনে নেমে পড়ে যে তুচ্ছ মানুষটি তার নাম হতে পারে ফরিদ বা ফরিদা, শ্রাবণ বা শ্রাবণী[৪]।

জাতীয়তাবাদ, স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদে একটি সাধারণ শত্রু উপস্থাপন করা হয়। বাংলাদেশে যেমন উপস্থাপন করা হয় হিন্দুদের; ভারত ও বার্মায় তেমনি উপস্থাপন করা হয় মুসলমানদের। ফলে বাংলাদেশে আজ নতুন করে স্বৈরতন্ত্র আসেনি[৫], এটি হাজার বছর ধরেই টিকে আছে। সমস্যাগুলোর দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য প্রধান সমস্যা খুঁজে বের করে সেটিকে আঘাতের মাধ্যমেই কেবল সকল সমস্যার সমাধান হতে পারে।

আরো পড়ুন:  বাস্তিলের পতন হচ্ছে ফরাসি সম্রাটের বিরুদ্ধে জনতার বিপ্লবী অভ্যুত্থানের সূচক

বাংলাদেশে প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্র, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদনির্ভরতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রবিরোধীতার রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতাবাদ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, গত এক শতক ধরে দাঁড়িয়ে আছে সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, সামাজিক বিভাজন ও শোষণের উপর ভিত্তি করে। শোষণ-মুনাফা-ব্যবসা-লুটেরানির্ভর বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াশীল কংগ্রেস-মুসলিম লীগ এবং আওয়ামি লীগ-বিএনপি ও এই দুইদল-পন্থী রাজনৈতিক দলগুলো পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বশংবদ এবং এই দলগুলো সাধারণ মানুষের মূল সমস্যাগুলো সমাধান না করে অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রু শোষকদেরকে সহায়তা করেছে, যা নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচিকে হাজির করছে।

তথ্যসূত্র ও টিকা:

১. এই বিষয়ে দেখুন, অনুপ সাদি, “স্বৈরতন্ত্র প্রসঙ্গে”, এপ্রিল ২০, ২০১৮; রোদ্দুরে, ইউআরএল: https://www.roddure.com/encyclopedia/marxist-glossary/bases-of-bangladeshi-despotism/

২. Rolando Minuti, “Oriental Despotism”, 5 March, 2012, European History Online in English, http://ieg-ego.eu/, ইউআরএল: http://ieg-ego.eu/en/threads/backgrounds/european-encounters/rolando-minuti-oriental-despotism

৩. কার্ল মার্কস, ভারতে ব্রিটিশ শাসন, ১০ জুন ১৮৫৩, কার্ল মার্কস ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস নির্বাচিত রচনাবলী, তৃতীয় খণ্ড, বারো খণ্ডে, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ১৪২।

৪. এই নামগুলি প্রতীকী, যেমন একটি মেয়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী নিপিড়ন করতে গিয়ে আরেক ছাত্রীকে পেটায় এবং অর্ধ-উলঙ্গ করে। এতে পুরুষেরা স্বৈরতন্ত্রের তুচ্ছ ছাপোষা খুঁটি সেই মেয়টির তীব্র সমালোচনা করে। এই বিষয়ে ২৪ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখের বাংলাদেশী পত্রিকাগুলো দেখা যেতে পারে।

৫. বিবিসি বাংলা, “বিশ্বের নতুন পাঁচ ‘স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকায়’ বাংলাদেশ”, ২৩ মার্চ, ২০১৮, ইউআরএল: http://www.bbc.com/bengali/news-43515895.  

রচনাকাল: ২৩-২৪ মার্চ, ২০১৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!