বুর্জোয়া বিপ্লব সামন্তবাদের পতন ঘটিয়ে পুঁজিবাদের প্রতিষ্ঠা

বুর্জোয়া বিপ্লব বা ধনতান্ত্রিক বিপ্লব বা পুঁজিবাদী বিপ্লব (Bourgeois Revolution) হচ্ছে সামন্তবাদী অর্থনীতি এবং রাজনীতিক ব্যবস্থার পরিবর্তে শ্রমিক ও যন্ত্রশিল্প ভিত্তিক অর্থনীতি এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা ভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামো প্রতিষ্ঠা। বুর্জোয়া বা পুঁজিবাদী বিপ্লব মানুষের সমাজের বিবর্তনে একটা পর্যায়কে সূচিত করে। ঐতিহাসিক এ পর্যায়ের পরিধি বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম হতে পারে। বস্তুত পৃথিবীব্যাপী এ পর্যায়ের শুরু সামন্তবাদী অর্থনীতির ক্ষয়ের যুগে ইউরোপে ষোড়শ শতকে জার্মানির কৃষক বিদ্রোহের মধ্যে সূচিত হয়েছিল বলা যায়। অষ্টাদশ শতকে ১৭৮৯ সালে ফরাসি দেশে এই বিপ্লব একটি ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন করে। ১৯১৭ সালের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে রুশ ভূখণ্ডে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তরকালে আরো কয়েকটি দেশে অর্থনীতিক পরিবর্তনে বুর্জোয়া যুগের অবসান ঘটলেও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বুর্জোয়া পর্যায়ের অবসান এখনো ঘটে নি। অনেক দেশে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ এবং সামন্তবাদী অবশেষের উচ্ছেদে পূর্ণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠিত হয় নি।

পুঁজিবাদী বিপ্লবের মূল ঐতিহাসিক ভূমিকা হচ্ছে, শিল্প কারখানার বিকাশের প্রতিবন্ধক শক্তিসমূকে উচ্ছেদ করা। সামন্তবাদী অর্থনীতি উচ্ছেদের মাধ্যমে পুঁজিবাদী অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা নানা রূপ গ্রহণ করতে পারে। বিপ্লব সাধনকারী শক্তিতেও তারতম্য ঘটতে পারে। বৃহৎ কয়েকটি দেশে পুঁজিবাদী বিপ্লব সাধিত হওয়ার পরে অন্যান্য দেশে এই বিপ্লব সাধনে নতুনতর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পুঁজিবাদী দেশ আন্তর্জাতিকভাবে একচেটিয়া পুঁজি সঞ্চয় ও সরবরাহকারী দেশ হিসাবে সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র গ্রহণ করাতে সাম্রাজ্যবাদের অধীনে এবং অন্যান্য দুর্বল দেশগুলির বুর্জোয়া বিপ্লব নতুনতর চরিত্র ধারণ করেছে। সাম্রাজ্যবাদী যুগের পূর্বে পুঁজিবাদী বিপ্লবের ক্ষেত্রে বিকাশমান ধনিক শ্রেণি বিপ্লবের অগ্রগামী শক্তি ছিলো। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী যুগে শ্রমিক শ্রেণি পুঁজিবাদী বিপ্লব সম্পূর্ণ করার ক্ষেত্রে একটি প্রধান ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছে। ১৯০৫ সালে রাশিয়ায় যে অভূত্থান ঘটে তারও লক্ষ্য ছিল সামন্তবাদী জারতন্ত্রের উচ্ছেদ। কিন্তু এই বিপ্লবে শ্রমিক শ্রেণি নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণ করে। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবেও শ্রমিক এবং কৃষক শ্রেণি সশস্ত্র সংগ্রামের মারফত সামন্তবাদী জারতন্ত্রের পতন ঘটায়। উপনিবেশের পুঁজিবাদী বিপ্লব এবং জাতীয় মুক্তি আন্দোলন মিলিত হয়ে এই নতুনতর শ্রেণী বিন্যাসকে স্পষ্টতর করে তোলে। জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে বুর্জোয়া বিপ্লব সাধন করার ক্ষেত্রে জাতীয় বুর্জোয়ার একাংশ সাম্রাজ্যবাদের আশ্রয়ে জাতীয় মুক্তি এবং অর্থনীতিক উত্তরণের পথে প্রতিবিপ্লবী শক্তি হিসাবে কাজ করে। শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণি এই নেতৃত্বমূলক ভূমিকার কারণে পুঁজিবাদী বিপ্লব অনেক দেশে নতুন বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে।

আরো পড়ুন:  নয়া গণতন্ত্র মাও সেতুংয়ের চিন্তাভিত্তিক তত্ত্ব ও প্রয়োগের মতবাদ

বুর্জোয়া বিপ্লবের পর্যায়টিকে প্রধানত দুভাবে বিভক্ত করা চলে। ১. অবিমিশ্র বুর্জোয়া বিপ্লব : এ বিপ্লবের প্রধান ভূমিকা ধনিক শ্রেণির। শ্রমজীবী জনসাধারণের ভূমিকা গৌণ। এরূপ বিপ্লবে অর্থনীতিক রূপান্তর ঘটলেও শ্রমজীবী জনতা বা গরিব কৃষকের অবস্থান কোনো উন্নতি সাধিত হয় না। ২. বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব; এই বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য এই যে, বিপ্লব সাধনে শ্রমিক এবং কৃষক জনতা জাতীয় শিল্পের বিকাশ ছাড়াও শ্রমিকের অবস্থার উন্নতি এবং জমিতে কৃষকের স্বার্থসাধনকারী কৃষি সংস্কারের দাবিসহ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্র ধনিক শ্রেণির কবলিত হলেও শ্রমিক শ্রেণি তার রাজনীতিক চেতনা, ঐক্য এবং সংগঠিত শক্তির প্রভাবে ধনিক শ্রেণির সরকারকে নিজের স্বার্থে বেশকিছু পরিমাণে নিয়ন্ত্রিত করতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির অধিকতর শক্তির কারণে এরূপ গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া বিপ্লব একাধিক দেশে সাধিত হয়েছে। শ্রমিকশ্রেণীর সংগঠিত ঐক্যবদ্ধ শক্তি, সমাজতান্ত্রিক দেশের নৈকট্য, জাতীয় বুর্জোয়ার দুর্বলতা প্রভৃতি কারণে এরূপ গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া-বিপ্লব জনগণতন্ত্রের রূপ ধারণ করে সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরকে আসন্ন করে তুলতে পারে।

তথ্যসূত্র:

১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ৩৩৪-৩৩৫।

Leave a Comment

error: Content is protected !!